আবু সিম্বেল, কম অম্বো, নীলনদে ক্রুজ যাত্রা, এডফু
গতকাল রাত্রিবাস হয়েছে নীলনদের বুকে, একটা ক্রুজে। বেশ প্রশস্ত একটা কেবিনে একাই ছিলাম। কায়রোর মিউজিয়াম, খান এল খলিলি বাজার, অসোয়ান, লুবিয়ান দ্বীপ বেড়িয়ে এই ক্রুজে ঠাঁই নিয়েছি আমরা। চমৎকার ডিনারের পরে দু’ চোখ জড়িয়ে এসেছিল ঘুমে। ক্রুজের দুলুনি, নীলনদের ওপর দিয়ে বয়ে আসা বাতাস, কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। মাঝরাতে একবার ঘুম ভাঙ্গলো। নদী প্রবাহের কত রকমের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। কত কথা যেন। নীলনদের কথকতা। ঘোর লেগে যায়। নীলনদের বাঙ্গয় নৈঃশব্দ ফের ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল।
আজ ২৯ ডিসেম্বর (২০২২)। খুব ভোরে অসোয়ান থেকে আবু সিম্বেলের উদ্দেশে রওনা দেওয়া গেল। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে পথ। পর্যটকদের অনেকগুলো গাড়ির কনভয় চলেছে। সঙ্গে পুলিশ এসকর্ট রয়েছে। সেই মরুভূমির ঘোড়া ছোটানো দস্যুদলের চকিত আবির্ভাব ঘটবে নাকি? অবশ্য নিরাপত্তার প্রশ্নটি আজকাল বহুমাত্রিক। অসোয়ান থেকে আবু সিম্বেল প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ। মরুভূমিতে অপূর্ব সূর্যোদয় দেখলাম। জলের ব্যবস্থা করে মরুভূমির কোথাও কোথাও সবুজায়নের প্রচেষ্টা চলছে দেখা গেল। কোনও কোনও এলাকায় সবুজ রং ধরেছে। ওই আদিগন্ত মরুভূমিতে সত্যিকারের মরীচিকাও দেখা হল এ জীবনে।
নীলনদের পশ্চিম পারে আবু সিম্বেলের প্রাচীন দুটি মন্দির যেন ইতিহাসের গল্প বলা স্থাপত্য। ইজিপ্টের রাজা দ্বিতীয় রামসেসের রাজত্বকালে মন্দির দুটি তৈরি হয়েছিল। যিশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ১২৭৯ বছর আগে দ্বিতীয় রামসেসের রাজত্বকাল শুরু হয়েছিল। ফারাও দ্বিতীয় রামসেস ও তাঁর স্ত্রীর নামে উৎসর্গীকৃত এই মন্দিরদ্বয় আজও বিস্ময়। স্যান্ডস্টোন দিয়ে তৈরি মন্দির। মূল মন্দিরের সামনে রামসেসের বিশালাকার চারটি মূর্তি প্রাচীন ইজিপ্টের বিষ্ময়কর স্থাপত্য ও ভাস্কুর্য শিল্পের পরিচয় দেয়। দীর্ঘকাল আবু সিম্বেলের মন্দির বহির্বিশ্বের মানুষের চোখে আড়ালে ছিল। ১৮১৩ সালে আবু সিম্বেলের মন্দির পুনরাবিস্কৃত হয়। সুইস গবেষক যোহান লুডউইগ ও ইজিপ্টের পুরাতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ জিওভানি বাতিস্তা বেলজনির সেই পুনরাবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাপ্য।
বেশ ভিড় ছিল মন্দির এলাকায়। ইউরোপ, আমেরিকার পর্যটক প্রচুর। যাইহোক, আবু সিম্বেলের মন্দির দেখে আমরা ফের নীলনদে। একটা ক্রুজে এসে উঠলাম। তেমনই ব্যবস্থা করা ছিল। ক্রুজেই তৃপ্তি করে দ্বিপ্রাহরিক আহার সারা হল। তারপর ভেসে পড়া। পৌঁছোলাম কম অম্বো। বাংলা করলে কম অম্বো কথাটির মানে দাঁড়ায় সোনার পাহাড়। অসোয়ান থেকে জায়গাটা ৪৮-৫০ কিলোমিটার। নীলনদের তীরবর্তী প্রাচীন শহরটির প্রধান আকর্ষণ কম অম্বো মন্দির। জোড়া মন্দির বলা চলে। এ-ও যিশু খ্রিস্টের জন্মের অন্তত ৩০০ বছর আগে তৈরি। শ্রদ্ধা করার মতো স্থাপত্যশৈলী, তবে ছোটখাটো মেরামতি ইত্যদির কাজ হয়েছে। গ্রেকো-রোমান স্থাপত্য রীতিতে তৈরি এই জোড়মন্দিরটি।
ফের ক্রুজ যাত্রা। নীলনদের জলে সন্ধ্যা নামল। একটা মায়াবী পরিবেশ। চুপ করে একলা বসে থাকলে যেন সেইসব ফিসফাস শোনা যায়। কত রাজত্ব, কত সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ঘটে গেছে এই নদীটির তীরে। তার চিহ্নগুলো বেড়িয়ে দেখছি আমরা। রাজত্ব, সামাজ্য ইত্যাদি অতীত। কিন্তু এখানকার মানুষের জীবনচর্চায়, স্ংস্কৃতিতে তার ছাপটা তো রয়ে গেছে বর্তমানেও। যাইহোক রাতে এডফু পৌঁছালাম।
পরের দিন, ৩০ ডিসেম্বর, সকালে ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চেপে এডফুর মন্দির দেখতে গেলাম ইতিহাস আর বর্তমানে মাখামাখি সরণি ধরে। নীলনদের পশ্চিম পারে এডফু শহর। এখানকার প্রধান দ্রষ্টব্য দেবতা হোরাসের মন্দির। বাজপাখিরূপী দেবতা। যিশু খ্রস্টের জন্মের ৩৩২ বছর আগে আলেকজান্ডার দি গ্রেট ইজিপ্টে পারসিক শাসকদের পরাজিত করেন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পরে (২২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) শক্তিশালী গ্রিক সামরিক বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় জেনারেলরা আলেকজান্ডার অধিকৃত সেই বিশাল সাম্রাজ্যকে বাঁটোয়ারা করে নিলেন। অলেকজান্ডারের প্রথম সাত বিশ্বস্ত দেহরক্ষীর একজন, গুনী ভৌগলিক ও সমরবিদ ছিলেন প্রথম টলেমি। তাঁর ভাগে পড়ল ইজিপ্ট। টলেমিক যুগ শুরু হল সেখানে। এডফুর মন্দির ওই টলেমিক যুগে গড়ে উঠেছিল। ভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতির পাক হয়েছে কত কাল ধরে। ইজিপ্টের পঁচাশি ভাগ মানুষ সুন্নি ধর্মাবলম্বী। গ্রিকদের তৈরি অবাক করা স্থাপত্যগুলি সযত্নে রক্ষিত হচ্ছে।
এডফুর মন্দির দেখে ক্রুজে ফিরলাম। সকলে ফিরলে ক্রুজ ছাড়ল। আজই এসনা লক হয়ে ক্রুজ লাক্সর শহরে পৌঁছাবে। নীলনদের পূর্ব তীরে লাক্সর শহরটা খোলা আকাশের নীচে আরেকটি প্রাচীন ও বিস্তৃত মিউজিয়াম যেন।
(পরের কথা আগামী পর্বে)
ফটোঃ লেখক।
পশ্চাৎপটে নীলনদ-সহ লেখকের ছবিটি তুলছেন সঙ্গী সহযাত্রী।
প্রথম পর্বের লেখাটি পড়তে পারেন এই লিঙ্কেঃ https://torsa.in/in-the-land-of-the-pyramids-part-1/
দ্বিতীয় পর্বের লেখা পড়ার লিঙ্কঃ https://torsa.in/in-the-land-of-the-pyramids-part-2/
তৃতীয় পর্ব পড়বেন এই লিঙ্কেঃ https://torsa.in/in-the-land-of-the-pyramids-part-3/
2 Comments
[…] চতুর্থ পর্বঃ https://torsa.in/in-the-land-of-the-pyramids-part-4/ […]
[…] চতুর্থ পর্বঃ https://torsa.in/in-the-land-of-the-pyramids-part-4/ […]