Follow us

পিরামিডের দেশে-৩য় পর্ব

পিরামিডের দেশে-৩য় পর্ব

কায়রোর বিষ্ময়কর মিউজিয়াম

মুখিয়ে ছিলাম কায়রোর মিউজিয়ামটি দেখার জন্য। সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে তৈরি। কাল ইজিপ্টের প্রাচীন শহর আলেকজান্দ্রিয়া থেকে বেড়িয়ে এসেছি। সে-ও যেন মুক্ত আকাশের নীচে বিস্তৃত এলাকাজোড়া এক মিউজিয়াম। তবে, দেখার পরে বলছি, ইজিপ্ট বেড়াতে গেলে কায়রোর অ্যান্টিকুইটি মিউজিয়ামটি মিস করবেন না। সকালেই চলে গেলাম মিউজিয়ামে।

মিউজিয়ামে

এ যেন গোটা একটা সভ্যতা স্থির হয়ে আছে। পুরনো মানুষগুলো নেই। কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে অবস্থিত সংগ্রহশালাটি খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে ৫ হাজার বছর আগে থেকে ৩৬৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্যাপ্ত ইজিপ্টের অতীতের নানা উপাদান কাল অনুসারে যত্ন-সহকারে সংরক্ষণ করছে। মমি দেখলাম, তুতেনখামেনের ঐশ্বর্য চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।

মিউজিয়মে মমি

মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে সালাদিন দুর্গ। এ-ও ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। ১৩ থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত ইজিপ্ট শাসিত হয়েছে এখান থেকে। ঢুঁ মারা গেল দুর্গের চৌহুদ্দির মধ্যেই দি গ্রেট মস্ক অফ মহম্মদ আলিতে। আধুনিক ইজিপ্ট গড়ার প্রধান কারিগর হিসেবে মান্যতা পান মহম্মদ আলি। শাসনকাল ১৮০৫-১৮৪৮ সাল।

সালাদিন দুর্গ

খান অল খলিলি বাজার

ইতিহাস থেকে বর্তমানে ফিরলাম কায়রোর খান অল খলিলি বাজারে। হাঁকডাক, ক্রেতা-বিক্রেতার বিশাল সমাবেশ, আরবের খেজুর, মশলা, দুর্মূল্য কার্পেট, পুরনো কত রাজকীয় ফার্নিচার, পোশাক, অলঙ্কার, অ্যান্টিক শপ, হস্তশিল্প সামগ্রী, পুরনো কাফে। চোখ ধাঁধানো বাজার অঞ্চল যাকে বলে। তবে পরে বুঝলাম, ইতিহাস পাকে পাকে জড়িয়ে ফেলে এখানে। এল ফিশাউই নামের কাফেটি চালু হয়েছিল ১৭৯৭ সালে, এই বাজার এলাকাতেই। রাজধানী হিসেবে কায়রোর প্রতিষ্ঠা দশম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। আর অল খলিলি বাজারের প্রতিষ্ঠা চতুর্দশ শতকে। পুরনো কিছু অংশ রয়েছে এখনো। জানা গেল, মামলুক স্থাপত্যশৈলীতে গড়া হয়েছিল মূল বাজারটি। মামলুক সুলতান সুলতানদের আমলে এই ঘরানার স্থাপত্য রীতির বিস্তার ঘটে ইজিপ্টে।সময় ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতক। বড় পরিসরে মামলুক রীতির স্থাপত্য খোলে ভালো মনে হল। এই প্রকারের স্থাপত্যরীতিতে গড়া ইমারত আসলে এক একটি কমপ্লেক্স। নানা কাজের উপযোগী বিভাগের সম্মেলনে সামগ্রিক স্থাপত্যটি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, থাকবার ব্যবস্থা, মসজিদ সেই কমপ্লেক্সের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিভাগ।

খান অল খলিলি বাজার

অসোয়ান

অল খলিলি বাজারের একটা কাফেতে কফি খেয়ে আমরা রওনা দিলাম গিজা স্টেশনের দিকে। সেখান থেকে ট্রেন ধরে আমরা অসোয়ান পৌঁছাব কাল সকালে। কায়রো থেকে অন্তত হাজার কিলোমিটার। বিমানেও যাওয়া যায়। ট্রেনযাত্রাটা বেশ ভালো ছিল। রেলের কর্মীরাই ট্রেনে মালপত্র তোলা এবং সেগুলো নামিয়ে দেওয়ার কাজ করে দিলেন। ডিনার, ব্রেকফাস্ট ছিল। একটা কুপে দু’জনে ছিলাম।

ইজিপ্টের দক্ষিণ প্রান্তে নীলনদ তীরের প্রাচীন অসোয়ান প্রাচীন শহর, এখনো অর্থনৈতিক দিক থেকে অসোয়ান গুরুত্বপূর্ণ। ব্যস্ত শহর। শহরের ঐতিহ্যের গুরুত্ব জানা আছে অসোয়ানের বাসিন্দাদের কাছে। ট্রেন থেকে নেমে একটা কোচে উঠতে হল। বড় বড় প্রাচীন পাথরের খাদান আছে অসোয়ানে। এটা এখন স্বীকৃত যে, পিরামিড গড়ার কাজে লেগেছিল সেই পাথর।

অসোয়ানে আমরা প্রথমে গেলাম ফিলার (Philae) মন্দিরে। ছোট্ট দ্বীপ ফিলা। মোটর বোটে পৌঁছতে হল। সেখানে মন্দির কমপ্লেক্স। দেবী আইসিসের মন্দির। নামে গ্রিক প্রভাব। মূল মন্দিরটি গড়ার কাজ শুরু হয়েছিল যিশু খ্রিস্টের জন্মের অন্তত ২৫০ বছর আগে। আমরা ২০২২-এর শেষ লগ্নে দাঁড়িয়ে দেখছি। ফেলুক্কা তথা পালতোলা নৌকায় চড়ে নীলনদের বুকে ভ্রমণ হল খানিকক্ষণ। নদীর দুই তীরের ল্যান্ডস্কেপ খুব সুন্দর। দেশি নৌকায় চড়ে নীলনদ ভ্রমণের অনুভূতি অসোয়ান ভ্রমণের একটা বড় পাওনা।

ফিলার মন্দিরের প্রাচীরের কারুকাজ

নুবিয়ান গ্রামে ঝোলাগুড় ও পরোটা

গিয়েছিলাম নীলনদের তীরের একটি গ্রামে। এখন সাধারণত আসোয়ান বেড়ানোর পরিকল্পনার সঙ্গে নুবিয়ান নামের এই গ্রামটি ভ্রমণ সূচিতে যুক্ত হয়ে থাকে। মোটর বোটে চড়ে নুবিয়ানে নামলাম। দক্ষিন ইজিপ্ট, সুদান ও আফ্রিকার কিছু মানুষ এই নুবিয়ান গ্রামে বসবাস শুরু করেছিল এক সময়। নিজেদের গোষ্ঠীগত স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছে। নিজেদের ঘরানার লোকাচার পালন করে থাকে। অনেকে বাড়িতে কুমির পোষে। শুভ প্রাণী।

নুবিয়ান পরিবারে কুমির হাতে লেখক

এরা নুবা নামের একটি ভাষায় কথা বলে। খুব অথিথিপরায়ণ। ইজিপশিয়ানদের সঙ্গে কোনও বিরোধ নেই। খুব অথিথিপরায়ণ গ্রামের মানুষগুলো। একটি বাড়িতে গিয়েছিলাম, সুদূর দক্ষিণ ইজিপ্টের নীলনদের তীরের একটি গ্রামে ওঁরা হাসিমুখে আমাকে যে দুটি খাদ্য পরিবেশন করলেন, তা নির্ভেজাল পরোটা ও ঝোলাগুড়, অজান্তেই আমার মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল মনে হয়। ওঁরাও নিশ্চিন্ত ও খুশি। পরে কফির সঙ্গে ঘরে তৈরি কেক দেওয়া হয়েছিল।

সারাদিন অনেক বেড়ানো হল। অসোয়ানে আমাদের মূল বাহন ছিল একটা ক্রুজ। ওখান থেকে মোটর বোট, পালতোলা নৌকায় বেড়ানো। রাতে আমরা থাকব ওই ক্রুজেই। বেশ একটা ঘর মিলেছে আমার। রাত্রিবাস আজ আসোয়ানে, নীলনদের বুকে। কাল সকালে আমরা আবু সিম্বেলে যাব। অসোয়ানের দক্ষিণ-পশ্চিমে সুদান সীমান্তে জায়গাটির অবস্থান।

ক্রুজ থেকে দেখা নীলনদ

 

ফটোঃ লেখক

প্রথম পর্বের লেখাটি পড়তে পারেন এই লিঙ্কেঃ https://torsa.in/in-the-land-of-the-pyramids-part-1/

দ্বিতীয় পর্বের লেখাটি পড়তে পারেন এই লিঙ্কেঃ https://torsa.in/in-the-land-of-the-pyramids-part-2/

(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *