ভোররাতে উত্তর আন্দামানের ডিগলিপুরের হোটেল থেকে চেক আউট করে বারাটাং শহরে এসে পৌঁছালাম সকাল সাড়ে ৬টায়। বোটে মিডল স্ট্রেইট পেরিয়ে সেই আসার দিনের মতোই চেকপোস্টে নামধাম নথিভুক্ত করাতে হল। গাড়ির কনভয় জারোয়া জঙ্গল পেরবে। আজ ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২। এক একটি কনভয়ে গাড়ির সংখ্যা নির্দিষ্ট থাকে। সকাল ৮-টায় আমাদের প্রথম কনভয় ছাড়ল।
এই ফেরবার সময়ে দু’জন জারোয়া জনজাতির মানুষের দেখা পেলাম জঙ্গলের পথে। একজন রাস্তার পাশে দাঁডিয়ে আমাদের কনভয়ের দিকে চেয়ে ছিল। আরেকজন একটা ট্রাকে চড়ে চলেছে জঙ্গলের মধ্যেকার হাইওয়ে দিয়ে। বেলা সাড়ে ১০-টা নাগাদ পোর্টব্লেয়ার পৌঁছনো গেল।
বিকেলবেলায় গেলাম চিড়িয়া টাপু। এখান থেকে সমুদ্রে চমৎকার সূর্যাস্ত দেখা যায়। চিড়িয়া টাপু ‘বার্ড আইল্যান্ড’ নামেও খ্যাত। পোর্টব্লেয়ার থেকে চিড়িয়া টাপু ২৫-২৮ কিলোমিটার। গাড়িতে প্রায় ৫০ মিনিট সময় লাগল। দক্ষিণ আন্দামানের দক্ষিণতম প্রান্তে সমুদ্রতীরে জঙ্গলে ঘেরা চিড়িয়া টাপু সত্যিই সুন্দর। সৈকতটিও চমৎকার। প্রকৃতির নানা রংয়ের মিশেল ঘটেছে চিড়িয়া টাপু এলাকাটিতে।
বর্ণময় সব প্রজাপতি ওড়ে এখানে। আর আছে পাখি। প্রচুর পাখি। তাই এটা পাখিরও দ্বীপ। পাখি পর্যবেক্ষণে আগ্রহীরা এখানে এলে নিরাশ হবেন না বলেই আশা করি। সাদা পেটের সামুদ্রিক ঈগল-সহ নানা পাখি চোখে পড়েছে এই পাখির দ্বীপে। অনেক পাখিই চিনে উঠতে পারিনি। খুব যে পাখি চিনি এমন দাবি করতে পারি না। তবে পাখির ওড়াউড়ি, পাখির চেনা-অচেনা ডাক মন ভালো করে দিয়েছিল।
পরের দিন, অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ হোটেল থেকে বেরিয়ে প্রথমে গেলাম রাজীব গান্ধি ওয়াটার স্পোর্টস কমপ্লেক্সে। পোর্টব্লেয়ারের মেরিন পার্ক রোডে অবস্থিত এই কমপ্লেক্সের মাধ্যমে জেট স্কি, স্কুবা ডাইভিং, সি ওয়াকিং প্রভৃতির মতো ওয়াটার স্পোর্টসে অংশগ্রহণ করা যায়, ফিয়ের বিনিময়ে অবশ্যই। এখানকার ওয়াটার স্পোর্টস সম্পর্কে জানার জন্য আগ্রহীরা দেখতে পারেন এই ওয়েবসাইটটি: https://andamantourism.org.in/rajiv-gandhi-water-sports-complex-andaman
এরপর পরিকল্পনা মতো রস আইল্যান্ড ও নর্থ বে আইল্যান্ড যাব আমরা। এই রস আইল্যান্ড স্মিথ ও রস আইল্যান্ডের রস দ্বীপ নয়। বর্তমানে দ্বীপটির সরকারি নাম নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস আইল্যান্ড। পোর্ট ব্লেয়ারের আবেরদীন জেটি থেকে স্পিডবোটে চড়ে এই রস আইল্যান্ডে পৌঁছাতে ৪০-৪৫ মিনিট সময় লাগল। ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা রস আইল্যান্ডে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ব্রিটিশদের প্রশাসনিক কাজকর্মের সদরদপ্তর ছিল এই রস আইল্যান্ড। ওরা আদর করে রস আইল্যান্ডকে ‘প্যারিস অফ দি ইস্ট’ বলত। ঔপনিবেশিক আমলের গির্জা, হাসপাতাল, সেনাবাস, সুইমিং পুল, এক সময়ের জমজমাট বসতবাড়িগুলি এখন ভগ্ন, পরিত্যক্ত।
রস আইল্যান্ড সৈকতটি খুব পরিচ্ছন্ন। কোথাও কোথাও প্রবালের প্রাচীর রয়েছে তীর বরাবর। দূরে গভীর নীল সমুদ্র। জল নয় তো, স্বপ্নের ঢেউ ভাঙ্গছে যেন সৈকতে। অনেকেই এসেছেন রস দ্বীপ দেখতে।
এমনিতেই বড়দিনের উৎসবের আবহ আন্দামানের টুরিস্ট স্পটগুলিতে। রস আইল্যান্ড বেশ প্রাণবন্ত সেই আবহে। দ্বীপ বেড়ানোর জন্য ব্যাটারি চালিত যান পাওয়া যায়। একটা লাইটহাউস আছে রস আইল্যান্ডে। ১৮০টি সিঁড়ি বেয়ে সমুদ্রের তীরে লাইটহাউসের কাছাকাছি নেমে এলাম। একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়ছে পারে। একটা স্যাংচুয়ারি আছে। দ্বীপের বনাঞ্চলে কয়েকটা হরিণকে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল।
ফের স্পিডবোটে। যাচ্ছি বে আইল্যান্ডে। ওয়াটার স্পোর্টসের জন্য খ্যাত বে আইল্যান্ড। সি-ওয়াকিং, স্নরকেলিং, স্কুবা ডাইভিং করা যায় এখানে। বিশেষ করে সি-ওয়াকিংয়ের জন্য নাম আছে বে আইল্যান্ডের। এলিফ্যান্ট আইল্যান্ডে কয়েকটি ওয়াটার স্পোর্টে অংশগ্রহণ করেছি। এখানে আর সে ইচ্ছে ছিল না। জানা গেল, জলের নীচে রঙিন মাছের দঙ্গল দেখা যাচ্ছে।
রস ও বে দ্বীপ বেড়িয়ে আমরা পোর্টব্লেয়ারের ডাঙ্গায় উঠে এলাম যখন, তখন বিকেল পাঁচটা। আমাদের এবারের মতো আন্দামান ভ্রমণের সমাপ্তি ঘটল। পোর্টব্লেয়ার জমজমাট। হোটেলে ফিরে এলাম। গোজগাছ আছে। আগামীকাল পোর্টব্লেয়ার বন্দর থেকে কলকাতায় ফেরার বিমান উড়বে বেলা ১১ টায়।
ফটোঃ প্রেরণা ঘোষ
আগের চার পর্বের লেখা পড়তে পারেন নীচের লিঙ্কগুলিতে
প্রথম পর্বঃ https://torsa.in/in-the-land-of-the-king-of-the-green-island-part-1/
দ্বিতীয় পর্বঃ https://torsa.in/in-the-land-of-the-king-of-the-green-island-part-2/
তৃতীয় পর্বঃ: https://torsa.in/in-the-land-of-the-king-of-the-green-island-part-3/
চতুর্থ পর্বঃ https://torsa.in/https-torsa-in-https-torsa-in-in-the-land-of-the-king-of-the-green-island-part-4/