Follow us
Search
Close this search box.

মালয়েশিয়াঃ ল্যাংকাওয়ি দ্বীপ ও মালাক্কায়

মালয়েশিয়াঃ ল্যাংকাওয়ি দ্বীপ ও মালাক্কায়

কলকাতা থেকে কুয়ালালামপুর, সেখান থেকে বিমান বদলে মালয়েশিয়ার ল্যাংকাওয়ি বা ল্যাংকাভি দ্বীপে পৌঁছলাম। কুয়ালালামপুর থেকে ল্যাংকাওয়ি বিমানে ঘন্টাখানেক সময় লাগল। আজ ১২ ডিসেম্বর, ২০২২। আন্দামান সাগরে অবস্থিত ছবির মতো দ্বীপ-শহর ল্যাংকাওয়ি দিয়ে আমাদের মালয়েশিয়া ভ্রমণ শুরু হয়েছিল। এর আগে দুই পর্বের লেখায় মালয়েশিয়ার রাজধানী শহর কুয়ালালামপুর এবং এই শহরের বিনা ভাড়ার বাস সম্পর্কে জানিয়েছি। তবে কুয়ালালামপুর বেড়িয়েছি পরে। দেশের রাজধানী শহর বলে কথা, তাই আগে কুয়ালালামপুর বেড়ানোর প্রসঙ্গের অবতারণা।

যাইহোক, এবারের এই বিদেশ ভ্রমণ আমাদের কাছে বিশেষ ভাবে বিশেষ এই কারণে যে, এবার আর কোনও ট্র্যাভেল এজেন্সির মাধ্যমে নয়, সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে নিজেদের পরিকল্পনা মতো বেড়িয়েছি। টুর আইটেনারি স্থির করা, বিমানের টিকিট কেনা, হোটেল বুকিং, ভিসা, সব নিজেরাই করেছি। ব্যাপারটা বেশ উপভোগও করেছিলাম।

ল্যাংকাওয়ি

পরের দিন অর্থাৎ ১৩ ডিসেম্বর থেকে আমাদের ল্যাংকাওয়ি বেড়ানো শুরু হল। মালয়েশিয়া দ্বীপপুঞ্জের অন্তুর্ভুক্ত ল্যাংকাওয়ির সৈকতগুলি অপরূপ। মালয় ও আঞ্চলিক জনজাতির মানুষের সঙ্গে চিনা অধিবাসীদের চোখে পড়ে। আছেন কিছু ভারতীয়ও। পন্টাই সেনং ও পন্টাই তেংহ দুই পর্যটক-প্রিয় সৈকত। নিরিবিলি বিচও আছে। সেনং বিচটি আমার খুব ভালো লেগেছে। হিল টপ থেকে ল্যাংকাওয়ি দ্বীপ দর্শন এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।

ল্যাংকাওয়ির কেবল কার জগদ্বিখ্যাত। পাহাড়, উপত্যকা, সমুদ্রের উপর দিয়ে সেই কেবল কার চলে যখন, মনে হয় কোনও রূপকথার রাজ্যে এসে পৌঁছেছি। ওই কেবল কার গিয়ে থামবে স্কাই ব্রিজের প্রবেশপথে। ২,৩০০ ফুট উচ্চতায় দীর্ঘ এই পায়ে চলা ব্রিজ থেকে ল্যাংকাওয়ি দ্বীপের প্যানোরামিক ভিউ সহজে ভোলা যায় না।

বিকেল সন্ধ্যা রাতে ল্যাংকাওয়ির ঈগল স্কোয়ার জমজমাট। সুন্দর পার্ক, রং বেরংয়ের আলোয় উদ্ভাসিত হোটেল-রেস্তোরাঁ, সুভ্যেনির শপ ইত্যাদি নিয়ে রাতের ঈগল স্কোয়ার খুব প্রাণবন্ত। বিশালাকৃতির একটি ঈগলের মূর্তি রয়েছে এখানে। এই মূর্তিটি ল্যাংকাওয়ি দ্বীপের প্রতীক। ল্যাংকাওয়ির ‘ল্যাং’ কথাটি এসেছে মালয় শব্দ ‘হেল্যাং’ থেকে। হেল্যাং কথাটির অর্থ ঈগল। ল্যাংকাওয়ি দ্বীপের আকাশে ঈগলের চক্কর চোখে পড়ে। এখানকার ঈগলের পিঠের রং লাল।

আমরা গোটা দ্বীপটিতে চক্কর কেটেছি পায়ে হেঁটে, গাড়িতে। বেড়াবার জন্য বাইক, স্কুটারও পাওয়া যায়। দু’দিনের বেশি সময় হুস করে কেটে গেল সুন্দর দ্বীপটিতে। প্রসঙ্গত, সড়কপথে কুয়ালালামপুর শহর থেকে ল্যাংকাওয়ি কমবেশি ৪১৫ কিলোমিটার। বাস ও ট্রেনেও যাওয়া যায়। ট্রেনে ও বাসে গড়ে ৭-৮ ঘন্টা সময় লাগে।

মালাক্কা

এবার গন্তব্য মালাক্কা বা মেলাকা। ল্যাংকাওয়ি থেকে কুয়ালালামপুর হয়ে মালাক্কায় পৌঁছলাম। কুয়ালালামপুর থেকে মালাক্কা ১৪৫ কিলোমিটার। কুয়ালালামপুর সেন্ট্রাল থেকে ট্রেনে টার্মিনাল বার্সেপাদু সেলাতান (টি বি এস) বাস স্টেশনে, তারপর বাসে মালাক্কা সাশ্রয়ী পথ। সরাসরি যাওয়ার ট্যাক্সিও পাওয়া যাবে।

এবার আমাদের এই মালয়েশিয়া সফরের বিশেষ লক্ষ্য ছিল মালাক্কা ভ্রমণ। মালয়েশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে মালাক্কা রাজ্যের রাজধানী শহর মালাক্কা। প্রাচীন শহর। পর্তুগিজ, ডাচ, জাপানি ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার কারণে মালাক্কায় বিভিন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেছে। এর একটা বড় কারণ মালাক্কা প্রণালী।
ফানেল আকৃতির মালাক্কা স্ট্রেট বা প্রণালী আন্দামান সাগর ও দক্ষিণ চিন সাগরের মধ্যে যোগাযোগ ঘটিয়েছে। এ আসলে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে যোগাযোগ। ফলে বহু যুগ ধরে মালাক্কায় পা ফেলেছে বিদেশী বণিকরা। সঙ্গে এসেছে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা।

৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ মালাক্কা প্রণালী এখনও একটি স্ট্রাটেজিক জল-মানচিত্র। ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ-সংলগ্ন সমুদ্রে ইদানিং চিনা জাহাজের দেখা মিলছে বলে খবরে প্রকাশ। এই অবৈধ প্রবেশ ওই মালাক্কা প্রণালী ধরেই। ভারত আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সমুদ্রে নজরদারি বাড়িয়েছে।

বন্দর শহর মালাক্কার ঐতিহ্য ও বনেদিয়ানা দৃষ্টি কাড়বে প্রতি পদক্ষেপে। ঘুরে বেড়িয়েছি শহরের বিভিন্ন এলাকায়, পায়ে হেঁটে, গাড়িতে ও রিক্সায়। মালয়েশিয়ার এই মালাক্কাতেই রিক্সা দেখেছি। বর্ণবহুল, সাজানো গোছানো রিক্সায় বাজানো হিন্দি গান ভারতীয়দের কাছে বাড়তি পাওনা। নদীপথে মালাক্কা ভ্রমণ আরেক আসাধারণ অভিজ্ঞতা। নদীর দু’পাশে বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে বর্ণময় মুরাল, নদীর ওপর পুরনো সব সেতু, পুরনো ইমারত, গির্জা, বাজার চোখের সামনে ভেসে উঠবে রিভার ক্রুজের সময়। অসাধারণ জলপথে সেই ভ্রমণ।

বেড়িয়ে দেখেছি মালাক্কা শহরের ডাচ স্কোয়ার, চেং হুং টেং টেম্পল, সেন্ট পল চার্চ, সমুদ্র মিউজিয়াম, সুলতানস প্যলেস, ফ্যাহমাসা ফোর্টের ধ্বংসাবশেষ। মালাক্কা শহরের জনকার স্ট্রিটের বাজারটির কথা আলাদা করে উল্লেখের দাবি রাখে।

‘জনকার’ কথাটির সঙ্গে বাংলার ‘ঝংকার’ শব্দটির বেশ মিল রয়েছে। রাতের জনকার বাজার নানা কিছুর সমাহারে একটি ঝংকার বৈ কী। সন্ধ্যা এলে রং-বেরংয়ের আলো জ্ব্লে ওঠে বাজার জুড়ে, দৃষ্টিপথে আসে আরও অনেক মানুষ। পুরনো রেঁস্তোরা। কতদিনের পুরনো ঘরানায় তৈরি ফিশ বল। নারকোলের দুধের আইসক্রিম। জনকার বাজার স্ট্রিট ফুডের স্বর্গরাজ্য। মালয়েশিয়ার পেনাং শহরটির স্ট্রিট ফুডের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। জনকার বাজারও কিন্ত কম যায় না। মালাক্কার প্রায় কেন্দ্রে অবস্থিত এই বাজার এলাকায় চিনাদের বেশ পসার আছে বলে আমার মনে হয়েছে। চাইনিজ খাবারদাবারও নানা কিসিমের। বাজারটিতে আধুনিক গ্যাজেট পাবেন, প্রাচীন অ্যান্টিকও পাওয়া যাবে। একদা ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে থাকা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পুরনো শহরগুলির মেজাজ ও সংস্কৃতির আঁচ পাওয়া যায় জনকারের মতো বাজার ঘুরেফিরে দেখলে।

মালাক্কা থেকে কুয়ালালামপুর হয়ে এবার আমরা যাব বাটু কেভ দেখতে।

ফটোঃ লেখক

ক্রমশ-

তথ্যের প্রয়োজনে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন এই ইমেল অ্যাড্রেসেঃ tushar.kpatra@yahoo.com

 

লেখকের কুয়ালালামপুর শহর ও কুয়ালামপুর শহরের ফ্রি বাস স্ম্পর্কিত লেখা দুটি পড়তে পারেন নীচের দুই লিঙ্কেঃ

মালয়েশিয়া ভ্রমণঃ কুয়ালালামপুর শহর- প্রথম পর্ব

 

মালয়েশিয়া ভ্রমণঃ কুয়ালালামপুর শহরের ফ্রি বাস-দ্বিতীয় পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *