Follow us
Search
Close this search box.

তুজি, গোস্তবা, রোগান জোশঃ কাশ্মীরের খানা বাহার

তুজি, গোস্তবা, রোগান জোশঃ কাশ্মীরের খানা বাহার

অনেকগুলি রন্ধনশৈলীর মিলমিশের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠেছে বর্তমান কাশ্মীরের খাদ্য সংস্কৃতি। রন্ধনপ্রণালী ও খাদ্যাভ্যাসে রয়েছে মুঘল ও আরবী খাদ্যরীতির যথেষ্ট প্রভাব। রয়েছে মধ্য এশিয়ার রন্ধনশৈলীর প্রভাবও। প্রায় সমগ্র মধ্য-এশিয়া দখল করে ১৩৯৮ সালে ভারত আক্রমণ করল তিমুর তথা তৈমুর লং। দিল্লি বিজয়ের পরে তৈমুর লং কাশ্মীর গিয়েছিল। তৈমুরের সঙ্গে নানা ক্ষেত্রের পেশাদারদের সঙ্গে এসেছিল বেশকিছু দক্ষ রাঁধুনী (ওয়াজা)। এঁরা কাশ্মীরের রান্নার প্রকরণ-পদ্ধতিতে নতুন মাত্রা যোগ করল। কাশ্মীরী খাদ্যে মধ্য- এশিয়ার প্রভাব পড়ল। সঙ্গে থাকল কাশ্মীরের হিন্দু পণ্ডিতদের রন্ধনশৈলীর প্রভাবও। সব মিলিয়ে, নানা খাদ্যাভ্যাস, বিভিন্ন রন্ধন প্রকৌশলের মিলমিশের মধ্যে দিয়ে আজকের কাশ্মীরের খাদ্য সংস্কৃতি বিশিষ্টতা অর্জন করেছে।

কাশ্মীরের বিভিন্ন অঞ্চলেই পাওয়া যাবে সেখানকার নিজস্ব ঘরানার নানা পদ। তবে শ্রীনগর কাশ্মীরী খানার প্রধান রসুইঘর। কাশ্মীরী ঘরানার প্রায় সমস্ত খাবারই পাওয়া যাবে শ্রীনগরে।

খায়াম চকের আঘ্রাণ

ডাল লেকে গোলাপী আলো ছড়িয়ে সূর্য গেল পাটে, আর খায়াম চকের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল কাবাবের গন্ধ। সে যেন এক নীরব সুর। আমিষ-রসিক হন যদি, তবে সেই মনমাতানো সুরের টানে আপনাকে ঢুকে পড়তেই হবে খায়াম চকের কাবাব গলিতে। শ্রীনগরের স্ট্রিট ফুডের মহিমা চোখে দেখতে চেখে দেখতে সন্ধ্যায় খায়াম চক উপচে পড়ে দেশী-বিদেশী পর্যটকে। আসেন প্রচুর আঞ্চলিক মানুষও। সূর্যাস্তের পরে খোলে খায়াম চকের খাদ্য-বাজার।

লালচক থেকে খায়াম চক আড়াই কিলোমিটার। শঙ্করাচার্য মন্দিরের কাছেই জায়গাটির অবস্থান। খায়াম চকের কাবাব গলিতে পা রাখতে না রাখতেই আপনার রসনা সিক্ত হয়ে উঠবে। ধোঁয়া ধোঁয়া কাবাবগন্ধী বাতাস আপনাকে জড়িয়ে ধরবে অষ্টেপৃষ্টে। আপনি পায়ে পায়ে ঢুকে পড়বেন খায়াম চকের কাবাব গলিতে। খুব কিছু জৌলুষ নেই কাবাব গলির। সাদামাঠা একটা রাস্তা। তার দুই দিকে গনগনে সব উনুনে তৈরি হাতে গরম বারবিকিউ, কাবাবের, পসরা। চিকেন, মটন, ভেড়ার মাংসের কাবাব পাবেন। স্বাদে, সুঘ্রানে অতুলনীয়। সঙ্গে পাওয়া যাবে রকমারি চাটনি, আচার। সঙ্গে নিতে পারেন লাভাসা। আঞ্চলিক রুটি লাভাসা। পাবেন গ্রেভি-সহ চিকেন কালি মির্চ। রুমালি রুটির সঙ্গে জমে যায় এই পদটি। খায়াম চকের ফুড স্ট্রিটে গোমাংসের কোনও পদ বিক্রি হয় না।

মাকাই পার্কের তুজি

কাশ্মীরের স্ট্রিট ফুড নিয়ে যখন কথা তখন তুজির কথা তো আসবেই। তুজি হল শিক কাবাব। চেনা নাম। কিন্তু হলপ করে বলতে পারি মাকাই পার্কের তুজি খেলে পরিচিত শিক কাবাবকে নতুন করে আবিষ্কার করবেন।

নিশাত বাগের দুই কিলোমিটার আগে ডাল লেকের উল্টোদিকে মাকাই পার্ক। কার পার্ক এরিয়ায় গাড়ি থেকে নেমেই বেশ কয়েকটা তুজি কাউন্টার চোখে পড়বে। কাউন্টারগুলো ঘিরে যেমন পর্যটক, তেমন স্থানীয় মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। আমি নিজে অবশ্য মামাজির (আমরা কাকা বলি) কাউন্টারে যাই, আমার গেস্টদেরও ওখানে পাঠাই। আরাম করে বসে খাওয়া যায়। চিকেন তুজি, ল্যাম্ব তুজি; আর আহা কী অপূর্ব ফিশ তুজি। ঝিলম নদীর সুস্বাদু মাছ। সেই মাছ দিয়ে তৈরি কাবাব। আর তুজির সঙ্গে পাবেন সম্পূর্ণতই হোম মেড সস তথা চাটনি। সেই চাটনি সহযোগে কাবাবের যে স্বাদ সৃষ্টি হয় তার কোনও তুলনা চলে না। বলতে পারেন কাশ্মিরী খাদ্য ঘরানার এক মিটিমিটি হাসি এই তুজি। সেই আত্মবিশ্বাসী হাসির পিছনে আছে সুদীর্ঘ ইতিহাস, চর্চা।

তুজির সঙ্গে নিতে পারেন ঘরে তৈরি তন্দুরি রুটি। একটা শিকে ৬ পিস কাবাব থাকে। দুটো বা তিনটে শিকের কাবাব আর বড়ো সাইজের দু-তিনটে রুটি দিয়ে অল্প খরচে আপনার লাঞ্চ বা ডিনার হয়ে যাবে ভালোমতোই। খাবার প্যাক করে নিয়ে ডাল লেকে শিকারা ভ্রমণ করতে পারেন। নিশাত বাগ সংলগ্ন সূর্যাস্তের দৃশ্যও খুব সুন্দর। শ্রীনগরে থাকলে বিকেলের দিকে ড্রাইভারকে একদিন মাকাই পার্কে নিয়ে যেতে বলবেন।

লেখকঃ তপন মুখোপাধ্যায়, পর্যটন ব্যবসায়ী, শ্রীনগর, কাশ্মীর

কয়েকটি বহুল প্রচলিত পদ

গোস্তবাঃ মটন বল দই ও বিভিন্ন মশলা সহযোগে রান্না করা হয়।

মটন রোগান জোশঃ পদটি এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তেই তৈরি হয়। উদ্ভব কাশ্মীরে। শ্রীনগরের কোনও ভালো রেস্তোরাঁয় পদটির আস্বাদ নেবেন। কাশ্মীরী রন্ধনশিল্পের পরিচয় পাওয়া যাবে।

চিকেন পোলাওঃ কাশ্মীরের বাইরেও পদটি তৈরি হয়। কিন্তু কাশ্মীরী চিকেন পোলাওয়ের তুলনা হয় না। স্বাদে-সুঘ্রাণে একেবারেই ভিন্নতর।

ইয়াখনি ল্যাম্ব কারিঃ কাশ্মীরের আরেকটি সিগনেচার ডিশ। ঘন দই সহযোগে রান্না করা হয় ভেড়ার মাংস। এই পদটিতে শুকনো মওয়াল তথা মোরগঝুটি ফুলের (অ্যামারান্থ ফ্লাওয়ার) গুঁড়ো ব্যবহার করা হয় রং ও স্বাদের জন্য। ধোঁয়া ওঠা ভাতের সঙ্গে পরিবেশিত হয় পদটি।

শাব ডইগঃ এটি শালগম ও বিভিন্ন মশলা-সহযোগে রান্না একটি ভেড়ার মাংস বা অন্য কোনও মাংসের পদ। দীর্ঘ সময় ধরে, অনেক সময় সারা রাত ধরে রান্না করা হয় পদটি।

তবক মাজঃ ফ্রায়েড মটনের ডিশ এটি।

মুজি গাড়ঃ এটি মাছের পদ। রান্না করা হয় পদ্মফুলের ডাঁটি ও বিভিন্ন মশলা সহকারে।

দম ওলাভঃ দম আলু। আমাদের চেনা আলুর দম। তবে কাশ্মীরী দম আলুর নিজস্ব বৈশিষ্ট আছে। সুগন্ধি নানা মশলায় জারিত ছোট ছোট আলুর দম কাশ্মীরের নিত্যদিনের খাদ্য।

মদুর পুলাভঃ অ্যামন্ড, কাজু, এলাচ, জাফরান, চিনি ও সুগন্ধী চাল ব্যবহার করে তৈরি মিষ্টি স্বাদের পোলাও।

নাড্রু ইয়াখনিঃ দই ও বিভিন্ন মশলা সহযোগে পদ্মের ডাঁটির একটি জনপ্রিয় পদ।

ওয়াজওয়ানঃ ওয়াজওয়ান ছাড়া কাশ্মীরী খানার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার নয়। ওয়াজওয়ান আসলে নানা পদের সমাহার। প্ল্যাটারে থাকতে পারে কাবাব, তবক মাজ, রিস্তা, রোগান জোশ, গোস্তবা, আব গোশ প্রভৃতি। বেশিরভাগই মাংসের পদ। সঙ্গে শাহী পনির, পালক পনিরের মতো নিরামিষ পদ থাকতে পারে। কাশ্মীরে বিবাহের মতো বড় অনুষ্ঠানে ওয়াজওয়ান পরিবেশনের চল রয়েছে। শ্রীনগরের কিছু রেস্তোরাঁয় ওয়াজওয়ান প্ল্যাটার পেয়ে যাবেন।

রুটির রকমফেরঃ নানা প্রকারের রুটি পাবেন কাশ্মীরে। কাবাব দিয়ে খাওয়ার জন্য পাবেন লাভাসা। কাশ্মীরের আঞ্চলিক বেকারিগুলিতে তৈরি হয় গির্দা। কাশ্মীরীদের প্রাতরাশের টেবিলে গির্দা থাকবেই। তিলভর একটু শক্ত স্বর্ণাভ রুটি। ওপরে ছড়ানো থাকে তিল। সাধারণত বিকেলে চায়ের সঙ্গে খাওয়া হয় বেকারিতে তৈরি এই রুটি। পাবেন পোস্ত ছড়ানো কুলচা। উৎসব, অনুষ্ঠাণে পরিবেশিত হয় বাখরখনি। হালুয়া-বাখরখনি কাশ্মীরের এক জনপ্রিয় কম্বিনেশন।

নুন চাঃ গোলাপী-রঙা নুন চাই বা শির চাই কাশ্মীরীদের প্রায় সর্বক্ষণের পানীয়। বেকিং সোডা ব্যবহার করা হয় এই চায়ে।

লালচক

সিটি স্কোয়ার লালচক শ্রীনগরের প্রাণকেন্দ্র। অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এই লালচক। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ১৯৪৮ সালে এই লালচকে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছিলেন। জম্মু-কাশ্মীরের প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লা এই লালচকেই তাঁর বক্তৃতায় ভারত ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে জম্মু-কাশ্মীরের বন্ধুত্বপূর্ণ সমঝোতার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। ১৯৯৩ সালে ভয়াবহ আগুনে মারত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় লালচক। ক্রমশ ফের প্রাণস্ফূর্তিতে ফেরে লালচক।

বাজার, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ইত্যাদি নিয়ে লালচক এক মহাব্যস্ত এলাকা। লালচককে ঘিরে রয়েছে রিগ্যাল চক, পোলোভিউ, বাদশা চক, মহারাজা মার্কেট, গণি খান মার্কেট, রেসিডেন্সি রোডের মতো অনেকগুলো বাজার এলাকা। শ্রীনগরের যে-প্রান্তেই থাকুন, শপিং, খাওয়াদাওয়ার জন্য লালচকে আপনাকে আসতেই হবে। অনেক রেস্তোরাঁ আছে লালচকে। কাশ্মীরী আমিষ খানা তো বটেই, সম্পূর্ণ নিরামিষ আহারের রেস্তোরাঁও পাবেন লালচকে।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *