পাখি পর্যবেক্ষণে আগ্রহীদের কাছে সিকিমের আকর্ষণ দুর্নিবার। নানা প্রজাতির আঞ্চলিক পাখির সঙ্গে পরিযায়ী পাখির উপস্থিতিও উল্লেখযোগ্য এই রাজ্যের পার্বত্য অরণ্যে। দক্ষিণ সিকিমের কিতাম পক্ষী অভয়ারণ্য,উত্তর সিকিমের থলুং উপত্যকা, পশ্চিম সিকিমের খেচিপেরি লেক সন্নিহিত বনাঞ্চল, বার্সে রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারি ও ইয়কসাম অঞ্চলগুলি পাখি পর্যবেক্ষণের স্বর্গরাজ্য।
কিতামঃ পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে কিতামের কথা সর্বাগ্রে আসেই। ১২০০ থেকে ৩০০০ ফুট উচ্চতায় ৬ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে শাল, চির, পাইন গাছে ঘেরা কিতামের দক্ষিণ প্রান্ত বরাবর বইছে পান্না সবুজ রঙ্গীত ও মানপুর নদী। জঙ্গল-নদীর এই পরিবেশ পক্ষীকুলের প্রিয় ও নিরাপদ আবাস। পাখিরালয় হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে কিতাম। শুধু দেশের নয়, বিদেশের বহু পাখি পর্যবেক্ষকদের কাছে এখন একটি পরিচিত নাম সিকিমের কিতাম ।
কিতামে প্রায় ২০০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। শীতে আসে পরিযায়ী পাখি। আর আছে প্রজাপতি। কিতাম প্রজাপতিরও আবাস। ১১১ প্রজাতির প্রজাপতি দেখা পাওয়া গেছে এখানে। কিতামে বছরভর যে সব পাখির দেখা মেলে তার মধ্যে রয়েছে রেড জাঙ্গল ফাউল, গ্রিন ম্যগপাই, ইন্ডিয়ান পি-ফাউল, স্কারলেট মিনিভার, গ্রে ক্রাউন্ড প্রিনিয়া, ইয়েলো ভেন্টেড ওয়ার্বলার, রুফাস নেকড হর্নবিল, চেস্টনাট ব্রেস্টেড প্যাট্রিজ, হিমালয়ান ফ্লেম ব্যাক প্রভৃতি। ময়ূরের দেখা মিলবে যত্রতত্র।
বায়নাকুলার আর ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে বেড়ান কিতাম এবং সুম্বুক গ্রামে। এই দুই গ্রাম জুড়েই পাখির অভয়ারণ্য। সুম্বুক গ্রামটি গ্ল্যাডিওলাস ফুলের চাষের জন্য বিখ্যাত। কিতামে রয়েছে কয়েকটি ভিউপয়েন্ট। এইসব ভিউপয়েন্ট থেকে চারপাশের দৃশ্য যেমন চমৎকার তেমন অনেক পাখির দেখাও মেলে। কিতামে ২০০ বছরের পুরনো একটি মাটির বাড়ি দেখে অবাক হতে হয়। চাইলে রঙ্গীত নদীতে মাছ ধরতে পারেন। দিনে দিনে নামচি বেড়িয়ে আসতে পারেন।
যাওয়ার পথ
এন জে পি রেল স্টেশন বা বাগডোগরা বিমানবন্দর থেকে চলে আসুন দক্ষিণ সিকিমের নামচি। দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার। এন জে পি বা শিলিগুড়ি থেকে শেয়ার গাড়ি পাবেন। প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করেও আসতে পারেন। নামচি থেকে কিতাম ১৯ কিলোমিটার।
থাকার ব্যবস্থা
বারবেট হোমস্টেঃ ফোন-৯৭৩৩৩-৫৮৫৪২, গ্রিন ম্যাগপাই হোমস্টেঃ ফোন-৮৩৪৮৫-৫৬৬৯১, গ্রেট হর্নবিল হোমস্টেঃ ফোন- ৯০৮৩০–৯১৯২৯, আয়োরা হোমস্টেঃ ফোন- ৯৫৯৩৭-৭৬৬২৪, মার্গানসার হোমস্টেঃ ফোন- ৯৯৩৩৪-২১৫০০, মালখোয়া হোমস্টেঃ ফোন-৯৮৩২০-৫৪৩১১।
খেচিপেরি লেকঃ পশ্চিম সিকিমের পেলিং বেড়াতে গেলে সাইটসিয়িংয়ের তালিকায় নিশ্চিতভাবেই থাকে খেচিপেরি লেক। ৫,৬০০ ফুট উচ্চতায় আবস্থিত প্রায় ৩,৫০০ বছরের প্রাচীণ খেচিপেরি লেক সিকিমের সকল সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেই অত্যন্ত পবিত্র জলাশয় হিসেবে গণ্য হয়। জলাশয়ের খানিকটা পর্যন্ত রয়েছে একটি কাঠের জেটি। সেখানে সার সার রয়েছে প্রার্থনা চক্র। জলাশয়টিকে ঘিরে রয়েছে ঘন বন। জল-জঙ্গলের সঙ্গতে যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে তা পাখিদের পক্ষে খুবই অনুকূল।

খেচিপেরি লেক
খেচিপেরি লেক-সংলগ্ন বনাঞ্চলে যে-সব পাখির সাক্ষাৎ পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছেঃ বার-হেডেড গুজ, হোয়াইট ব্রেস্টেড ওয়াটার হেন, গোল্ডেন ওরিওল, এমারেল্ড কুক্কু, উডপিজিয়ন, ব্ল্যাক-নেকড গ্রেব, লাফিং থ্রাশ প্রভৃতি।
গ্যাংটক থেকে খেচিপেরি লেক ১৪৭ কিলোমিটার। পেলিং থেকে খেচিপেরি লেক ৩৪ কিলোমিটার। যাঁরা শুধুই পাখি পর্যবেক্ষণের লক্ষ্য নিয়ে খেচিপেরি যাবেন তাঁরা সেখানেই থাকার ব্যবস্থা করে নিতে পারেন।
খেচিপেরি এলাকায় থাকার ব্যবস্থা
খেচেওপালরি স্যাংচুয়ারি হোমস্টে, ফোনঃ ৮১৪৫৭-০২৯৯৪। সোনম হোমস্টে, ফোনঃ ৯৭৩৫৫৮৯৬৭৮। লেক ভিউ নেস্ট ইকো রিট্রিট, ফোনঃ ৯৭৩৫৯-৪৫৫৯৮। আরও হোমস্টে রয়েছে খেচিপেরি লেক এলাকায়।
ইয়কসামঃ পশ্চিম সিকিমের গেজিং সাবডিভিশনের অন্তর্গত ইয়কসাম এক ঐতিহাসিক শহর। চোগিয়াল রাজা ফুন্টসগ নামগিয়ালের আমলে, ১৬৪২ সালে ইয়কসামে সিকেমের প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। জোংরি-গোয়েচালা ট্রেকিংয়ের সূচনা ঘটে এই ইয়কসাম থেকেই। ৫৮০০ ফুট উচ্চতার ইয়কসামের শান্ত প্রকৃতি ও ঘন বন বার্ডিয়ের জন্য আদর্শ।

ইয়কসাম
ইয়কসামে যে-সব পাখি দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে ব্ল্যক-থ্রোটেড সানবার্ড, ফায়ার-টেলড সানবার্ড, রেড-টেলড মিনলা, হিমালয়ান বুলবুল, গ্রিন-ব্যাক টিট, গ্রে বুশচ্যাট, মাউন্টেন হক ঈগল, হোয়াইট-ক্যাপড ওয়াটার রেডস্টার্ট প্রভৃতির মতো হরেক পাখি।
ইয়কসাম শিলিগুড়ি থেকে ১৪৪ কিলোমিটার, গ্যাংটক থেকে ১৪০ কিলোমিটার, পেলিং থেকে ৩৬ কিলোমিটার। খেচিপেরি লেক থেকে ইয়কসাম ২৭ কিলোমিটার। অর্থাৎ খেচিপেরি বা ইয়কসামে আস্তানার ব্যবস্থা হলে স্বল্প দূরত্বের ব্যবধানে দুই অঞ্চলেই বার্ডিংয়ের সুযোগ থাকে।
ইয়কসামে থাকার ব্যবস্থাঃ চুংদা হিডেন হোমস্টে, ফোনঃ ৯৭৩৩১-৯৪৮৪৬। হোটেল লিম্বু হোমস্টে, ফোনঃ ৮৩৪৮১-৬৭৭৬৩। হোটেল রেড প্যালেস, ফোনঃ ৯৭৩৩০-৭৭০১৩। হোটেল পেমাথাং, ফোনঃ ৯৮৩২৩-২১১৫৯
বার্সে রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারিঃ পশ্চিম সিকিমের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে ১০,৮০০ উচ্চতায় সিঙ্গালীলা গিরিশিরার ওপর ১০৪ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলব্যাপী বার্সে রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারির বিস্তার। বিভিন্ন প্রজাতির রডোডেনড্রন, সিলভার ফার, ম্যাগনোলিয়া, হেমলকের ঘন অরণ্য এপ্রিল-মে মাসে রডোডেনড্রন ফুলে ছেয়ে যায়। হিলে, ডেন্টাম এবং সোরেং, এই তিন পথ ধরে বার্সে বনাঞ্চলে প্রবেশ করা যায়। পর্যটকরা সাধারণত হিলে থেকে ৪ কিলোমিটার ট্রেক করে বার্সেতে প্রবেশ করেন। হিলে পর্যন্তই গাড়ি চলাচলের রাস্তা আছে। সকাল সকাল হিলে থেকে ট্রেকিং শুরু করতে চাইলে আগের দিন রাতটা ওখরেতে কাটানো যায়।
বার্সে অভয়ারণ্যে লেপার্ড, হিমালয়ান লাঙ্গুর, হিমালয়ান পাম সিভেট, রেড পাণ্ডার মতো প্রাণী রয়েছে। আর রয়েছে পাখি। ক্রিমসন হর্নড ফেজেন্ট, মোনাল ফেজেন্ট, রেড ব্রেস্টেড ট্রাগোপান, ব্রাউন প্যারটবিল, গোল্ডেন রবিন, লাফিং থ্রাশ, রেড-টেলড মিনলা, সল্টি-ব্যাকড ফ্লাইক্যাচার, ব্রাউন-উড আউল, স্লেন্ডার বিলড স্কিমিটার ব্যাবলারের মতো বিভিন্ন প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যায়। আর এখান-সেখান থেকে দেখা পাওয়া যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা।
এন জে পি বা শিলিগুড়ি থেকে প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে সরাসরি ওখরে বা হিলে চলে আসা যায়। এন জে পি থেকে ওখরে ১৩০ কিলোমিটার, হিলে ১৪০ কিলোমিটার। শিলিগুড়ির তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাসের উল্টোদিক থেকে জোরথাং আসার শেয়ার গাড়ি পাওয়া যায়। দূরত্ব ৮৫ কিলোমিটার। জোরথাং থেকে ওখরে ৪০ কিলোমিটার, হিলে ৫০ কিলোমিটার। দীর্ঘ যাত্রার পরে ওখরেতে আশ্রয় নেওয়াই ভালো। পরের দিন সকালে ১০ কিলোমিটার দূরের হিলে পৌঁছে যাওয়া যাবে। হিলে থেকে ৪ কিলোমিটার ট্রেক করে বার্সেতে প্রবেশ।
থাকার ব্যবস্থা
ওখরেঃ রয়্যাল বার্সে হোমস্টে, ফোনঃ ৮৯৪২৮-৩১৮৭৫। খাম্বা হোমস্টে, ফোনঃ ৯৫৯৩৯-৭১২০৭। সালাখা হোমস্টে, ফোনঃ ৭৪৩১৮-১২০৯২। ম্যাগনোলিয়া ভিলেজ হোমস্টে, ফোনঃ ৯৬০৯৮-৫৬৪১৪।
বার্সেঃ গুরাস কুঞ্জ(বার্সে অভয়ারণ্যের মধ্যে থাকার প্রধান ব্যবস্থা), ফোনঃ ৯৮০০৩-৯৮৩০৯, ৭৪৭৮৫-৪০৫৪১।
থলুং উপত্যকাঃ গ্যংটক থেকে ৫৩ কিলোমিটার উত্তরে মঙ্গন হয়ে থলুংয়ের রাস্তা ধরতে হয়। থলুং উপত্যকা এখনো সর্বতোভাবে জানা-চেনা হয়ে ওঠেনি। যাতায়াত নিয়ন্ত্রিত। থলুংয়ে ঢোকার জন্য স্পেশাল পারমিটের দরকার হবে। সঙ্গে অবশ্যই আঞ্চলিক গাইড নিতে হবে। সিনিয়লচু পর্বতের পাদদেশে উপত্যকার বিস্তার। মঙ্গন থেকে ১৪-১৫ কিলোমিটার গাড়িতে এগোতে হবে। তারপর বার্ডিংয়ের জন্য হাঁটা শুরু হবে। উচ্চ থলুংয়ে রয়েছে হিমবাহ, লেক, নদী, অনেকগুলি জলপ্রপাত। নিম্ন উপত্যকায় রয়েছে রডোডেনড্রন, ফার, পাইন, ওক ও গুল্মের জঙ্গল। পাখির সন্ধান পাওয়া যাবে এই অঞ্চলেই।
নিম্ন থলুং উপত্যকায় এখনো পর্যন্ত যে-সব পাখির দেখা মিলেছে তার মধ্যে রয়েছেঃ কুটিয়া, নানা প্রজাতির থ্রাশ, বে উডপেকার, পিগমি রেন ব্যাবলার, নেপাল মার্টিন, উডপিজিওন, অরেঞ্জ-বেলিড লিফবার্ড, স্নোয়ি ব্রাউন্ড ফ্লাইক্যাচার, হিমালয়ান বুলবুল, ব্ল্যাক বুলবুল, গ্রে বুশচ্যাট, অলিভ-ব্যাকড পিপিট প্রভৃতি।
থলুং উপত্যকার পক্ষীকুল সম্পর্কে আরও তথ্য পাবেন পিটার লোবোর লেখা ‘নর্থ সিকিম, থলুং ভ্যালিঃ নভেম্বর-২০০১’ শীর্ষক রিপোর্ট থেকে। রিপোর্টটি পাবেন এই ওয়েবসাইটেঃ www.birdtours.co.uk
মঙ্গনে থাকার ব্যবস্থাঃ য়োংডং কার্ডামম হোমস্টে, ফোনঃ ২৫৯২২-৩৪৩২০। সাকজার লি হোমস্টে, ফোনঃ ৯৫৯৩২-৬০৭১৩। মুনলোম নেচার রিসর্ট, ফোনঃ ৮৯০৬১-২০৩০০। মালায় লি হোমস্টেঃ ফোনঃ ৮২৪০৩-৭৩৪০৩।