বৃষ্টিটা থাকবে হয়তো সঙ্গে সঙ্গে। সেটা সামলানো গেলে এই বর্ষার মরসুমেই ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স-এ যাওরার সেরা সময়। বর্ষার মরসুমেই ফুলে ফুলে ছয়লাপ হয়ে যায় উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার ৮৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স। পশ্চাৎপটে জাঁসকর পর্বতমালা। শীতে এই উপত্যকা ঢাকা পড়ে বরফে। গ্রীষ্মের শুরুতে বরফ গলতে শুরু করে। তৈরি হয় জলপ্রবাহের অনেকগুলো ধারা। উপত্যকার রং তখন ধূসর। বর্ষায় অজস্র ফুলে বর্ণময় হয়ে ওঠে নন্দাদেবী বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের ১১,৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত জাতীয় উদ্যান এবং ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স।
সেরা সময়
জুন থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স খোলা থাকে। তবে বেড়ানোর সেরা সময় জুলাই-অগস্ট মাস। পার্কে প্রবেশ করা যায় সকাল ৭টা থেকে। বিকেল ৫টার পরে আর পার্কের মধ্যে থাকা যায় না। ভারতীয়দের ক্ষেত্রে পার্কে প্রবেশের ফি মাথাপিছু ১৫০ টাকা।
ভ্রমণের নানা দিক
এক ভ্রমণে অনেকগুলো উদ্দেশ্য সাধিত হয়। প্রথমত, ট্রেকিং। হরিদ্বার থেকে বদ্রীনাথের পথে গোবিন্দঘাট পর্যন্ত চলে আসা যায় গাড়িতে। তারপর গোবিন্দঘাট থেকে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স পৌঁছাতে হবে ট্রেক করে। প্রথমে গোবিন্দঘাট থেকে ১৬ কিলোমিটার হেঁটে চলে আসতে হবে ঘাংঘারিয়া। এই ঘাংঘারিয়া ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স এবং শিখ তীর্থ হেমকুন্ড সাহিব যাওয়ার বেসক্যাম্প। ঘাংঘারিয়া থেকে ৬ কিলোমিটার ট্রেক করে পৌঁছাতে হবে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স। আবার দিনে দিনেই নেমে আসতে হবে ঘাংঘারিয়ায়। থাকার ব্যবস্থা আছে। ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স যাওয়ার পথে এবং সেখান থেকে ফিরে ঘাংঘারিয়ায় থাকার ব্যবস্থা করে নেওয়া যায়। উপত্যকায় যাওয়ার পথে পেরতে হবে লক্ষ্মণগঙ্গা। বর্ষায় তার ভয়ঙ্কর সুন্দর রুপ দেখা যাবে। ট্রেকিংয়ের এখানেই শেষ নয়। ঘাংঘারিয়া থেকেই ৬ কিলোমিটার ট্রেক করে যাওয়া যায় শিখদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র হেমকুণ্ড সাহিব। চড়াই পথ। ঘোড়া, ডান্ডির ব্যবস্থাও আছে। পথের শোভা কষ্ট লাঘব করবে।
দ্বিতীয়ত, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স যাওয়ার পথে এবং হেমকুণ্ড সাহিব থেকে হিমালয়ের পর্বতশৃঙ্গগুলির দৃশ্য আপনাকে সম্মোহিত করবে।
তৃতীয়ত, বিভিন্ন বন্য প্রাণীর আবাস এই ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স। উপত্যকায় রয়েছে কস্তুরী হরিণ, হিমালয়ের কালো ও বাদামী ভাল্লুক, লালরঙা শিয়াল, ভারাল, থর, স্নো লেপার্ড। আর আছে হিমালয়ান মোনাল-সহ নানা প্রজাতির পাখি।
চতুর্থত, ফুলের উপত্যকায় ভ্রমণের সঙ্গে তীর্থক্ষেত্র দর্শন। ১৪,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত হেমকুণ্ড সাহিব থেকে হিমালয়ের বিভিন্ন নামী শৃঙ্গের দর্শন পাওয়া যাবে। গোবিন্দঘাট থেকে আরেক শৈব তীর্থক্ষেত্র বদ্রীনাথ ২৫ কিলোমিটার। হাতে সময় থাকলে একই যাত্রায় বদ্রীনাথ দর্শনও সেরে ফেলা যায়।
পঞ্চমত, ফটোগ্রাফিতে যাঁদের বিশেষ আগ্রহ, তাঁদের কাছে এই ফুলের উপত্যকা এক অসাধারণ লোকেশন।
ফুলের জলসা
প্রায় ৬০০ প্রজাতির ফুলের দেখা মেলে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স-এ। সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ফুলগুলি ফোটে। তবে জুলাই-অগস্ট মাসে প্রকৃতপক্ষে ফুলের জলসা জমে ওঠে ফুলের উপত্যকায়। তখন ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে ওঠে সমগ্র উপত্যকা।
ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সের কিছু ফুলঃ বিভিন্ন প্রজাতির মকশুদ, হিমালয়ান কলম্বাইন, বিভিন্ন প্রজাতির অ্যানেমন, মার্শ মেরিগোল্ড, বিভিন্ন প্রজাতির জেরানিয়াম, হার্ব রোবার্ট, ব্লু পপি, ইয়েলো পপি, ইয়েলো উড ভায়োলেট, হিমালয়ান বেবিস ব্রিদ, ডোয়ার্ফ গ্লোব ফ্লাওয়ার, বিভিন্ন প্রজাতির বালসম, মিল্ক ভেচ, হিমালয়ান রোজ, সিল্কি রোজ, হিমালয়ান বারগেনিয়া, গোল্ডেন রড, হোয়াইট-লিফ হগউইড, অ্যস্টার, আ্যঞ্জেলিকা, কোবরা লিলি, মিনি সানফ্লাওয়ার। কোথাও খুঁজে পাবেন ব্রহ্মকমল। এটি ছোট একটি তালিকা। ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সে দেখা যাবে আরও নানা ফুল।
আরও জানার জন্য
ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স এবং তার ফুল, লতাপাতা, বৃক্ষ সম্পর্কে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘দি ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সঃ অ্যান আ্যডভেঞ্চার ইন দি আপার হিমালয়া’। লেখক ফ্রাঙ্ক এস স্মাইথ। বইটি পাওয়া যায়।
প্রসঙ্গত, ১৯৩১ সালে পর্বতারোহী ফ্রাঙ্ক এস স্মাইথ কয়েকজন সদস্য-সহ সফল কামেট অভিযান শেষ করে ফেরার পথে বর্তমান উত্তরাখণ্ডের ভ্যুন্দার উপত্যকায় এসে পৌঁছান। ভ্যুন্দারে ফুলের মেলা দেখেছিলেন তিনি। ক্যেক বছর পরে বর্ষার মরশুমে আবার ভ্যুন্দারে এসেছিলেন স্মাইথ। উপত্যকার গাছপালা, ফুল ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা করেছিলেন তিনি। এই ভ্যুন্দার উপত্যকাই ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স। স্মাইথের সমীক্ষালব্ধ মূল্যবান সব তথ্য রয়েছে উপরোক্ত বইটিতে।
যাওয়ার পথ
ট্রেনে চলে আসতে হবে হরিদ্বার বা দেরাদুনে, অথবা বিমানে দেরাদুনের জলি গ্রান্ট এয়ারপোর্টে। হরিদ্বার থেকে যোশীমঠ হয়ে চলে আসতে হবে গোবিন্দঘাট। এই গোবিন্দঘাট থেকেই ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স উদ্দেশে যাত্রা শুরু হবে। সড়কপথে হরিদ্বার থেকে গোবিন্দঘাট ২৯৫ কিলোমিটার। দেরাদুনের জলি গ্রান্ট এয়ারপোর্ট থেকে গোবিন্দঘাট ২৮৬ কিলোমিটার।
হরিদ্বার, হৃষিকেশ বা দেরাদুন থেকে গোবিন্দঘাট যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে প্রাইভেট গাড়িও।
গোবিন্দঘাট থেকে ১৭ কিলোমিটার ট্রেক করে চলে আসতে হবে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স এবং হেমকুণ্ড সাহিব যাওয়ার বেসক্যাম্প ঘাংঘারিয়ায়। ঘাংঘারিয়া থেকে ট্রেক করে একপথে যেতে হবে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স, অন্যপথে হেমকুণ্ড সাহিব। হরিদ্বার, হৃষিকেশ বা দেরাদুন থেকে গোবিন্দঘাট যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে। প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করেও যাওয়া যাবে।
থাকার ব্যবস্থা
গোবিন্দঘাটেঃ
গঙ্গা রিসর্ট হোমলি স্টে, ফোনঃ ৯৪১১১-৮৩৯৯১। হোটেল ভগৎ, ফোনঃ ৯৪১১১-৮৩৯৯১। গুরুদ্বার, গোবিন্দঘাট, ফোনঃ ১৩৮৯২-১২২৯৩ (www.hemkunt.in/gurudwaras).
গোবিন্দঘাটের তুলনায় যোশীমঠে হোটেলের সংখ্যা অনেক বেশি। যোশীমঠ থেকে গোবিন্দঘাট ২০ কিলোমিটার। একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাওয়া যায়।
যোশীমঠের কিছু হোটেলঃ
জি এম ভি এন টুরিস্ট রেস্টহাউস, হেল্পলাইন নম্বরঃ ০১৩৫-২৭৪৬৮১৭, ৯৫৬৮০-০৬৬৩৯। উত্তরাখণ্ড পর্যটনের কলকাতা অফিসের ঠিকানাঃ ৭/২সি, চক্রবেড়িয়া রোড (দক্ষিণ), ভবানীপুর, কলকাতা-৭০০০২৫। ফোনঃ ৯৮৩১১১০৯৯, ০৩৩-২৪৭৬-৫৫৫৫। হোটেল কামেট, ফোনঃ ৯৪১২০-৩২২০২। হিমালয়ান অ্যবড, ফোনঃ ০১৩৮৯-২২২৬৮৭, ৯৯১৭৯-৭৬১৩২। হোটেল দ্রোনাগিরি, ফোনঃ ০১৩৮৯-২২২৬২২, ৮১২৬৯-৮৮৩৮৮। হোটেল পঞ্চবটী ইন, ফোনঃ ৯০৬৮০-১৭১৪১, ৯০৬৮০-১৭১৪২।
ঘাংঘারিয়ায়ঃ
হোটেল কুবের, ফোনঃ ৯৬২৭০-০৬০১০। হোটেল কুবের অ্যনেক্স, ফোনঃ ৮৯৫৮৩-৯৭৯৪৯। চার মঞ্চ রিসর্ট, ফোনঃ ৯৭৬১২-১৩০৪৮। হোটেল ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স, ৯৭৫৬৮-১৩২৩৬, ৭০৮৮৮-৪৪৯৩৯। ব্লু পপি সুইস কটেজ, ফোনঃ ৯৯৯১২-৪২৭৫৯। হোটেল হিমালয়ান হলিডেজ, ফোনঃ ৯৪৫৮১-৪৪১৪৬, ৯৪১০৫-০৯৭৬৯।