Follow us
Search
Close this search box.

রূপপুরের রূপকথা

রূপপুরের রূপকথা

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ নাচনশার রাস্তায় পড়তেই শুরু হল সবুজের রাজ্যপাট। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে সদ্য। গাছগাছালি থেকে টুপটুপ জল পড়ছে। বোলপুরের ব্যস্ত স্টেশন রোড পেরিয়ে গাড়ি ধরল শ্রীনিকেতনের রাস্তা। শ্রীনিকেতন চত্বরকে ডাইনে রেখে একটু এগিয়ে বাঁয়ে মোড় ফিরতেই নাচনশাহের রাস্তা। মুখে মুখে নাচনশা রোড।

নাচনশার পথ।

আকাশে বৃষ্টির মেঘ উড়ছে। মৃদু বাতাসে ক্রমশ ঘন হচ্ছে মাটির গন্ধ। বিশাল এক বটবৃক্ষের ঝুরি বেয়ে জল ঝরতে দেখলাম। প্রথম প্রথম রাস্তার দু’পাশে বিনুরিয়া গ্রামের বাড়িঘর, পুকুর, তালগাছের জটলা, ধানের খেত। কখনো ডাইনে সোনাঝুরি, ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল; বাঁয়ে অজস্র শালগাছের জমায়েত। তার নীচের দিক দিয়ে দিগন্ত দেখা যায়।

রাস্তার পাশে শালের জঙ্গল।

নাচনশার রাস্তার চলনে নাচের ছন্দ। আঁকাবাঁকা কালো পিচের নিরালা রাস্তাটি এরপর ঢুকে পড়বে আদিগন্ত সবুজের মধ্যে। ভরা বর্ষায় ওই দিগন্তরেখা থেকে ধেয়ে আসে বৃষ্টি। ঘন বর্ষায় গাছের শিকড়বাকড়ের মতো চমকিত বিদ্যুতের রেখা-জাল দেখা যায় আকাশের বহুদূর জুড়ে। বিকেলে মেঘের ফাঁক দিয়ে অস্তগামী সূর্যের আলোয় জল-জঙ্গল, খেত, মনুষ্যবসতির রূপ বদলায়। এখানে চাঁদের আলো উড়ে বেড়ায়।

বিনুরিয়া ছাড়িয়ে ঢুকে পড়া গেল রূপপুরে। সবুজের গভীরে। মেঘলা আকাশ অনেক অনেক দূরে নেমে গেছে সবুজের দিগন্ত-প্রান্তে। ফুসফুস ভরে ওঠে সেই সবুজের ওপর দিয়ে বয়ে আসা বাতাসে। সবুজ কথাটা বার বার আসছে। প্রকৃতই যে জায়গাটার রং আশ্চর্য রকমের সবুজ। নগরবাসীর কাছে সে এক আবিষ্কার।

সেই সোঁদামাটির গন্ধ। বাঁয়ে সরু একটা খাল। তার তীরে কাশফুল ফুটেছে। ঢুকে পড়েছি রূপপুর কারুগ্রাম চত্বরে। গ্রামের মধ্যে গ্রাম। সবুজের মধ্যে সবুজ। এখানে সেখানে আম, লিচু, ডালিম, জামরুল, আমলকী, সবেদা, কামরাঙা গাছ, পুকুর, ঘাসের জমি ঘিরে ফুলগাছের সারি, হেঁটে বেড়ানোর জন্য বাঁধানো রাস্তা আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু কটেজ, ডুপ্লেক্স। পুকুরে মাছের হঠাৎ ডিগবাজির শব্দ, বাতাসে গাছের পাতা আন্দোলনের শব্দ, পাখির ডাক। আর কোনও শব্দ নেই। রূপপুর কারুগ্রাম একটি গ্রামীণ রিসর্ট।

কেন কারুগ্রাম?

আসলে আঞ্চলিক কারুশিল্পের নানা আঙ্গিকে সাজানো হয়েছে রূপপুর কারুগ্রামকে। মাটির কটেজে বা মাড হাউসের অন্দরে ও বহিরাঙ্গে লোক-ঘরানার আলপনা, আঞ্চলিক নানা উপকরণের ব্যবহার বীরভূমের গভীরে বসত করা ভূমিপুত্রদের শিল্পবোধ সম্পর্কে ধারনা দেয়।

গৃহ-অভ্যন্তর।

শুধু ডাইনিং হলটিই দেখবার মতো। কাঁচ, কাঠ, তালগাছের পাতা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি গোলাকার ঘরটি দেখবার মতো। ওখানে ডাইনিং টেবিলের স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে তালগাছের গুড়ি, সুচারু আকারে। হস্তশিল্পের এক বিশিষ্ট নিদর্শন হিসেবে গণ্য হতে পারে জিনিসটি।

ডাইনিং হল।

‘রাই জাগো গো’। রূপপুর কারুগ্রামে ঘুম ভাঙে বাউলের গানে। প্রতিদিন। সেই কোন সকাল থেকে পাখি ডাকে। মর্নিং ওয়াক হতে পারে রিসর্টের মধ্যেই। পাশেই ওই মিশকালো রাস্তাটি। ওই রাস্তা ধরেও খানিকটা বেড়িয়ে আসতে পারেন। রাস্তার দুই ধারে সবুজের বন্যা। কোপাই নদী দেড় কিলোমিটার। এই কোভিডের যুগে ওই মুক্ত পরিবেশ আর শুদ্ধ বাতাস মহৌষধ।

শরতে সুনীল আকাশে পেঁজা-তুলো-মেঘের পরিভ্রমণ। হেথায় সেথায় কাশফুলের জটলা। গ্রামের পুজোর ঢাকের বাদ্যি। শীতে সূর্য উঠলে শিশির ভেজা ঘাসের ডগায় চকচিকে আলো। তখনই হাতে হাতে টাটকা খেজুরের রস। জম্পেশ শীত। গরম চায়ে উষ্ণতাও কম নয়।

একটু হৈ চৈ-এর মধ্যে যেতে চাইলে বোলপুর শহর তো রইলই। রক্তকরবী কারুগ্রাম থেকে বিশ্বভারতী চত্বর ৭ কিলোমিটার। সৃজনী শিল্পগ্রাম, ফসিল পার্ক, আমার কুটির কাছাকাছিই। চাইলে সোনাঝুরির হাটে। বেড়াবার জন্য কারুগ্রাম থেকে চাহিদামতো অটো, প্রাইভেট গাড়ির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।

রক্তকরবী কারুগ্রামের অন্দর।

রক্তকরবী কারুগ্রামের ম্যানেজার রহিমবাবু জানালেন, “আসলে যাঁরা এখানে আসেন তাঁরা বারবার করে আসেন। বিশ্রামের জন্য আসেন। নিরিবিলিতে ছুটে কাটাতে আসেন। ওয়ার্ক ফ্রম হোম যাঁদের, তাঁরা আসেন।” বলে রাখা ভালো, রক্তকরবী কারুগ্রামে জোরে মিউজিক চালানো, ধূমপান, মদ্যপান নিষিদ্ধ।

বাইরেটা।

রক্তকরবী কারুগ্রামের রন্ধনশালাটির, সত্যি কথা বলতে কী জবাব নেই। একেবারেই অতিকথন নয় এটা। রন্ধনশৈলীর গুণে সাধারণ খাবারও অসাধারণ হয়ে ওঠে ওখানে। কয়েকজন মহিলা সদাব্যস্ত ওই রন্ধনশালায়। গ্রামেরই বাসিন্দা ওঁরা। কিন্তু রান্না যেমন তেমন নয় মোটেই। ওঁদের হাতে তৈরি মাশরুম স্যুপ, চিকেন ও মটন কোর্মা, চিকেন ও মটনের কালি মির্চ, নানা কিসিমের ফ্রায়েড রাইস, জিঞ্জার চিকেন, চিকেন সেজওয়ানের আস্বাদ যে মুখে লেগে থাকবে অনেকদিন, এ কথাটি নিশ্চিত করে বলা চলে। ভাত, ডাল, সব্জি, মাছের ঝোলে একেবারে বাড়ির রান্নার স্বাদ। আদিবাসী খাদ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে চাইলে পেয়ে যাবেন চিকেন বা মটনের পাতা পোড়া। পাওয়া যাবে নিরামিষ নানা পদ।

প্রকৃতি আর শিল্পের বুনোট।

বোলপুর স্টেশন থেকে রূপপুর কারুগ্রাম ১০ কিলোমিটার। স্টেশন চত্বর থেকে অটো রিজার্ভ করে চলে আসা যায়। রিসর্টে বলে রাখলে স্টেশন থেকে নিয়ে আসা ও স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। নিজেদের গাড়ি নিয়ে গেলেও অসুবিধার কিছু নেই। রিসর্টের মধ্যে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে।

রূপপুর কারুগ্রামে এথনিক মাড ডুপ্লেক্সের ভাড়া ৪,৮০০ টাকা, মাড কটেজ ৪,০০০ টাকা, বাল্মীকি বাটিতে ঘরের ভাড়া ৪,০০০ টাকা। সবক্ষেত্রেই ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি। এখানকার সব ঘরই বাতানুকূল। রয়েছে কেবল টিভি। লন্ড্রির ব্যবস্থা আছে। ২৪ ঘন্টা রুম সার্ভিস পাওয়া যাবে।

ঠিকানাঃ রূপপুর কারুগ্রাম, রূপপুর, বিনুরিয়া, দক্ষিণ হরিরামপুর, বোলপুর শান্তিনিকেতন-৭৩১২৩৬।

ফোনঃ ৯৬৭৪২ ১৪১০১, ৯৯০৩১ ৮৭৮৭৫।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *