Follow us
Search
Close this search box.

দার্জিলিংয়ের কুঙ্গায় তিব্বতের আস্বাদ

দার্জিলিংয়ের কুঙ্গায় তিব্বতের আস্বাদ

মে মাসে হঠাৎ করেই দার্জিলিংয়ে যেতে হয়েছিল দিন দু’য়েকের জন্য। কাজ ছিল কিছু। এদিক-ওদিক বেড়ানোর অবকাশ ছিল না। তবে পাহাড়ি ওই পরিবেশটাই একটা বড় পাওনা। বৈশাখের শেষ। দক্ষিণবঙ্গে উত্তাপ চড়ছে। বাঙালি পাহাড়মুখী। থেকে থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। পাহাড়ি রাস্তায় ঘন কুয়াশা। গাছের মাথায়, পাহাড়ের খাঁজে কুণ্ডলী পাঁকানো মেঘ। দার্জিলিং শহর, মল চত্বরে পুজোর মরসুমের মতো ভিড়। একদিন চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম। সে কথা বলেছি আগের একটি লেখায়।

তোর্সা ডট ইনঃ দেবযানী সরকারের ‘দার্জিলিংয়ের চিড়িয়াখানায় খানিকটা সময়, এই গ্রীষ্মে’ শীর্ষক লেখাটি পড়তে পারেন এই লিঙ্কেঃ https://torsa.in/some-time-at-darjeeling-zoo-this-summer/

চিড়িয়াখানা থেকে চৌরাস্তা তথা মলে ফিরলাম হেঁটে। একটু রোদ্দুর উঠছে তো আবার চারিদিকে মেঘলা বর্ণ। মল চত্বরে এসে রেস্তোরাঁ ইত্যাদি দেখে দুপুরের খিদেটা চাগাড় দিয়ে উঠল। চমকের মতো কুঙ্গার কথা মনে পড়ল। দার্জিলিংয়ের জনপ্রিয় তিব্বতি রেস্তোরাঁ। তিব্বতি ঘরানার নানা কিসিমের খাবারদাবারের সঙ্গে চাইনিজ নানা পদও পাওয়া যায় ছোট্ট রেস্তোরাঁটিতে। বাইরে থেকে দেখেছি আগে। ভিতরে ঢোকা হয়নি। এই মেঘ-বৃষ্টির আবহাওয়ায় এক বোল স্যুপ ভালোই লাগবে। কুঙ্গার স্যুপের সুখ্যাতি শুনেছি।

হাঁটা লাগালাম গান্ধি রোড ধরে। তিব্বতি এক পরিবারের হাতে কুঙ্গা রেস্তোরাঁর পত্তন। বিশ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। সেই তিব্বতি পরিবারের সদস্যরাই রেস্তোরাঁটি চালান। দার্জিলিং মলে পূর্ব দিকে মুখ করে দাঁড়ালে ডানহাতি রাস্তাটি গান্ধি রোড। দার্জিলিংয়ের আরেকটি পুরনো রেস্তোরাঁ কেভেন্টার্স ছাড়িয়ে একটু এগলেই বাঁ দিকে কুঙ্গা। ৫১, গান্ধি রোড, চকবাজার, দার্জিলিং।

প্রিয়াঙ্কা চোপড়া ও রণবীর কাপুর জুটির ‘বরফি’ সিনেমাটি রিলিজ করেছিল ২০১২ সালে। সিনেমাটির বহুলাংশের শ্যুটিং হয়েছিল দার্জিলিংয়ে, মলের আশেপাশে নানা লোকেশনে। দার্জিলিংয়ে থাকাকালীন রণবীর কাপুরের প্রিয় রেস্তোরাঁ হয়ে উঠেছিল কুঙ্গা। প্রায়ই খেতে আসতেন এখানে। খবরের কাগজে সে কথা প্রকাশিত হল। ব্যাস, কুঙ্গার নাম ছড়িয়ে পড়ল। বাঙালি কুঙ্গামুখী হল।

রেস্তোরাঁর সামনে গিয়ে আমি হতভম্ব, ভিতরে ঢোকার লাইন পড়েছে। লাইনে সমবেত বেশকিছু মানুষ। পুজোয় নামী রেস্তোরাঁর লাইনের মতো। সম্ভবত দিনটি ছিল ১৪ মে। লাইনে অপেক্ষারত বাঙালির পরিচয়, আড্ডা, একটু মনোমালিন্য হবে না, তা হয় না। হঠাৎ এক গুরুগম্ভীর নির্দেশ প্রায়, এই যে মেয়ে, তুমি লাস্ট। আর রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে আছো, চেপে এস। ওখানে দেখ মেনু কার্ড আছে, ওরা স্লিপ দেবে। সেখানে তোমার খাবারের অর্ডার লিখে দিতে হবে। কথার উৎসের দিকে চোখ গেল। প্রৌঢ় এক মহিলা। বেশ একটা ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠছে চেহারায়, কথায়। কোথা থেকে আসছেন? সরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করি আমি। বেলেঘাটা, ওনার উত্তর। স্বামী, পুত্র, পুত্রবধূ, স্কুল পড়ুয়া নাতি ও মধ্যবয়সী ননদ-সহ দার্জিলিং বেড়াতে এসেছেন। সদ্য বিবাহিত এক দম্পতি হিন্দিতে কথা বলছিলেন। এছাড়া লাইনের সকলে বাঙালি বলেই মনে হল।

খেয়েদেয়ে কেঊ রেস্তোরাঁ থেকে বেরলে শূণ্য আসন অনুসারে পরের খদ্দেরকে ডেকে নিচ্ছেন এক মহিলা। তার আগে অর্ডারের স্লিপ নিয়ে নিচ্ছেন উনি। এত ভিড় কিসের, আর কি রেস্টুরেন্ট নেই এ চত্বরে? লোক তো আসছেও। সেই প্রৌঢ়া যেন কথাক’টি হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলেন। ফাঁদে পড়লাম আমিই। বলতে গেলাম, ওই যে বরফি সিনেমার সময়ে রণবীর কাপুর এখানে খেত না…, কথা শেষ হল না আমার, প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন উনি, সেই কোন কালে খেয়েছিল, সেই গন্ধ এখন শোঁকালে চলবে? ওঁদের ডাক এসেছে, ভিতরে ঢুকে গেল গোটা দলটা।

মেনু কার্ড হাতে নিয়ে আমি একটু বিব্রত। অনেক খাবারেরই চরিত্র জানি না। চিকেন থেনথুক স্যুপ, আর স্টিমড ডাম্পলিং লিখলাম অর্ডার স্লিপে। এখানকার এই দুই পদের নাম আগে শুনেছি। কুঙ্গার ওনটন স্যুপটাও রসিকজনের মন কেড়েছে। আছে মাশরুমের নানা পদ। তিব্বতি থুকপা পাওয়া যায়। আমার পিছনের স্মার্ট চেহারার দুই মহিলা ফ্রায়েড রাইস আর চিলি পর্ক খাবেন বলে ঠিক করলেন।

অতঃপর রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করা গেল। গোটা সাতেক টেবিল। সাকুল্যে ২০-২২ জনের বসার ব্যবস্থা। পিছনে ক্যাশ কাউন্টার। তার পিছনে কাঁচের আবডাল দেওয়া কিচেন। দেখা যাচ্ছে রান্নাবান্নার তৎপরতা। চার-পাঁচজন কর্মী। মহিলাদের সংখ্যাধিক্য। কী সুচারু ভাবে সামলাচ্ছে সব কিছু। বাইরে লোক অপেক্ষা করছে। ভিতরে তাড়া নেই। নানা খাবার পরিবেশিত হচ্ছে। ওই জ্যেঠিমাদের টেবিলে চাউমিন, ফ্রায়েড রাইস আর চিলিচিকেন পড়েছে।

এতক্ষণে নানা আইটেমের নামে ঠাসা মেনু কার্ডে ভালো করে মন দেওয়ার অবকাশ পাওয়া গেল। নানা প্রকারের জুস, কোল্ড ড্রিনকস পাওয়া যাচ্ছে। তালিকায় রয়েছে নিরামিষ, আমিষ, উভয় প্রকার পদ। আমিষ বিভাগে চিকেনের সঙ্গে পর্ক ও বিফের পদ রয়েছে। টেবিলগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত মানুষজন। সেই হিন্দিভাষী দম্পতি ছাড়া আর সকলেই বাঙালি বলেই তো মনে হল। রেস্তোরাঁয় শূকর ও গোমাংসের পদ বিক্রি হয়, কিন্তু তা নিয়ে কারুর কোনও মাথাব্যথা নেই। পরিবেশটাই অন্যরকম। শান্ত। আয়েশ করে খাচ্ছেন সকলে।

দার্জিলিংয়ে অনেক তিব্বতি বসবাস করেন। চিনা আগ্রাসনের সময় তিব্বত ছেড়ে চলে এসেছিলেন এখানে অনেকেই। তাঁদের সংখ্যা বেড়েছে। তিব্বতি-সহ দার্জিলিংয়ের আঞ্চলিক মানুষজন নিয়মিত কুঙ্গায় খেতে আসেন। কুঙ্গার যে কোনও পদ পরিমাণে বেশ ভালোই। পরিমাণের তুলনায় দাম কম বলতে হবে। খাবার প্যাক করে বাড়িতে নিয়ে যান অনেকে। এটা রণবীর কাপুর-সংযোগের আগে থেকেই হয়ে আসছে। বিদেশিরাও আসেন এখানে কম মশলার হালকা খাবার খেতে। খোলা থাকে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮-৯টা পর্যন্ত।

আমার থেনথুক স্যুপ এল। ধোঁয়া উড়ছে। স্যুপে নুডল, চিকেন, সব্জির মিশেল আছে। পরিমাণে আনেকটা। একটা স্যুপ দু’জনেও খাওয়া যেতে পারে। মন্দ নয়, গরম, সহজপাচ্য এবং টাটকা। নানা মশলা-যোগে খাদ্যটিকে অতিরিক্ত মুখরোচক করে ফেলার চেষ্টা হয়নি। ডাম্পলিং তো এদের হাতে ভালো হবেই। কোনও কোনও টেবিলে স্প্রিং রোল উঁকি দিচ্ছে। কুঙ্গার এই পদটিরও সুনাম আছে। খাদ্য নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেন যাঁরা, তাঁরা এখানে নানা সূত্রের সন্ধান পেতে পারেন।

খেতে খেতে মনে হচ্ছিল, পরিবেশ এই রেস্তোঁরার এক অদৃশ্য চরিত্র। পাহাড়ে বসে নানান খাদ্যের রসাস্বদন। তিব্বতি ও চিনা ঘরানার নানা পদ এখানে আবিষ্কৃত হতে পারে। খাদ্য নিয়ে ভেদবুদ্ধির কোনও জায়গা নেই। যার যেমন ইচ্ছা খান। খাওয়াটাকে উপভোগ করুন। বাইরে ঠান্ডা আবহাওয়া। কুঙ্গার এই পরিবেশটা খাবারের চেয়েও ভালো লেগেছে আমার।

হেডার ফটো সৌজন্যঃ এল বি বি।
অন্যান্য ফটোঃ লেখক।
ভিডিওঃ তোর্সা ডট ইন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *