Follow us
Search
Close this search box.

মাটির গন্ধমাখা মনচাষা

মাটির গন্ধমাখা মনচাষা

এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলে বাতাসে সোঁদা মাটির গন্ধ। গ্রীষ্মের বিকেলে দখিনা বাতাসে প্রাণ জুড়োয়। শীতের সকালে মিঠে রদ্দুরে দাঁড়িয়ে খাঁটি খেজুরের রসের আস্বাদনের মধ্যে দিয়ে দিন শুরু। কোনও গাছের ডাল থেকে ডেকে উঠবে ব্ল্যাক ড্রঙ্গো বা গ্রিন বি-ইটার। একটু বেলায় ফুলের বাগানে উড়বে নীলরঙা প্রজাপতি, ব্লু ওয়ান্ডারার। জলাশয়ের ধারে ওৎ পেতে বসে থাকবে বক। হঠাৎ গাছের ডালে চোখে পড়তে পারে রং বদলানো গিরগিটি। বর্ষায় এখানে সেখানে দেখা যাবে ব্যাঙের ছাতা। সামনেই বাগদা নদী। চারপাশে গ্রামীণ পরিবেশ। চাষের খেত। প্রচুর গাছগাছালি। এমনই মনচাষার ভিতর-বাইরের পরিবেশ।

কোথায় জায়গাটা?

জায়গাটা পাউসি। পূর্ব মেদিনীপুরে বাগদা নদীর তীরের পাউসি। কাঁথীর কাছাকাছি। বাংলায় এমন পরিবেশ আরও আছে। কিন্তু পাউসিতে আছে মনচাষার আন্তরিক মনন। ট্রেনে গেলে কাঁথী স্টেশনে নামতে হবে। চত্বর, বাসে গেলে নাম্বেন কাঁথী বাসস্ট্যান্ডে। স্টেশন চত্বর বা বাসস্ট্যান্ডে থেকে অটোরিক্সায় পাউসির মনচাষায় চলে আসা যাবে অল্প সময়েই।

মৃত্তিকাগন্ধী মনচাষা

শহুরে ব্যস্ত জীবনের ঘূর্ণাবর্তে ক্লান্তি উপশমের ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন মনচাষা কর্তৃপক্ষ। সে-ব্যবস্থা গড়া হয়েছে আঞ্চলিক গ্রামীণ পরিবেশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণতই সাযুজ্য রেখে। মনচাষা নিজেকে একটা বিচ্ছিন্ন ঘেরাটোপের মধ্যে আবদ্ধ নয়। দামি দামি সব আধুনিক গ্যাজেটের ছড়াছড়ি নেই এখানে। যত্রতত্র পাওয়া যাবে মাটির স্পর্শ, গন্ধ, বর্ণ। বড় যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে শহুরে জীবন। সেই কৃত্রিমতা মনে, শরীরে যে ক্লান্তিকর প্রভাব ফেলে তা নিয়ে আজ তো আর বিতর্কের অবকাশ নেই। সে কারণেই সময়-সুযোগ মতো প্রকৃতির কাছে আশ্রয় নেওয়া। নিষ্কলুষ বাতাসে শ্বাস নেওয়া। মাতিতে পা রেখে হাঁটা। পাখির ডাক শোনা। জলাশয়ে সাঁতার কাটা। বাংলার নিজস্ব খাবারদাবারের স্বাদ আবিষ্কার করে অবাক হওয়া।

মনচাষা কোনও রিসর্ট নয়। বাঁশ, কাঠ, খড়, হোগলা ব্যবহার করে তৈরি চারটি বড় বড় হাট-এ থাকার ব্যবস্থা। আঞ্চলিক ঘরামিদের হাতে গ্রামীণ ঘরানায় তৈরি কুটির ধাঁচের হাটগুলি। হাটের বারান্দায় দাঁড়ালে বাগদা নদীর প্রবাহ দেখা যায়। সেখান থেকে বয়ে আসে প্রাণ জুড়ানো বাতাস। দুটি বড় বড় জলাশয় রয়েছে মনচাষা চত্বরের মধ্যে। সেখানে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবোস, কার্প, পুঁটি মৌরলা প্রভৃতি মাছের চাষ হয়। জেলেরা জাল ফেলে মাছ ধরে মাঝে মাঝে। দেখতে পারেন সেই কার্যক্রম। আপনার পাতেও পৌঁছাবে রান্না করা সেই সব মাছের নানা পদ। চাইলে ছিপ দিয়ে মাছ শিকার করতে পারেন আপনিও। ফল ফুল সবজির বাগান আছে। বাগানে জৈব সার ব্যবহার করা হয়। ভার্মিকম্পোস্ট তথা কেঁচোসার তৈরি করা হয় মনচাষায়। রেন ওয়াটার হার্ভেস্টিং পদ্ধতিতে বৃষ্টির জল সংগ্রহ করে এবং ব্যবহৃত জল পরিশ্রুত করে বাগানে, পুকুরে ব্যবহার করা হয়। ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা রয়েছে এখানে। নানা কাজে ব্যবহৃত হয় সৌরশক্তি ও বায়োগ্যাস। আর এই সমস্ত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকেন গ্রামের মানুষজন। অনেকে মিলে লক্ষসাধনের প্রয়াস।

কচিকাঁচাদের ব্যাপার

কচিকাঁচারা সঙ্গে থাকলে এবং দুটো দিন মনচাষায় থাকার ব্যবস্থা হলে তাঁরা গ্রামের প্রকৃতি, পরিবেশ এবং গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে জানবে শিখবে অনেক কিছুই। কীভাবে মাছ তাদের খাওয়ার টেবিলে এসে পৌঁছায়, বাগান তৈরি, সার তৈরি, গাছপালা, পাখি, প্রজাপতি, পোকামাকড় চেনা, এগুলো কিন্তু জরুরি হয়ে উঠেছে আজকের বিপদগ্রস্ত পৃথিবীতে। যে লাঙল দিয়ে চাষ হয়, যে ঢেঁকি দিয়ে ধান ভানা হয়, কুমোরের যে চাকাটি দিয়ে চা খাওয়ার মাটির খুরিটি তৈরি হয় তা সবই রয়েছে মনচাষার সংসারে। ছোটদের সঙ্গে পরিচয় ঘটতে পারে এইসব দেশীয় যন্ত্রগুলির। সরল পদ্ধতিটা জানলে আধুনিক পাওয়ার টিলার, হাস্কিং মেশিন প্রভৃতি আধুনিক যন্ত্র সম্পর্কে ধারণা হবে। হাতে ধরে দেখা যাবে মাছ ধরার জাল ও ছিপ। হাতে চালানো তাঁত কীভাবে কাজ করে জানা যায়। ছোটদের পুরনো যে খেলাগুলো, যেমন গুলি-ডান্ডা, বাঘবন্দি, পিট্টু, আইশ-বাইশ, কুমির ডাঙ্গা প্রভৃতির মতো খেলাধূলার পরিচয় পাওয়া যাবে এখানে। ক্যারম, ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট খেলার বন্দোবস্তও আছে।

বিশ্রাম নিন,আড্ডা দিন

মনচাষায় থাকলে সাইটসিয়িংয়ের জন্য ছোটাছুটির বালাই নেই। মনের মতো একটা বই নিয়ে হ্যামকে উঠে বসুন। জলাশয়ে মাছ ধরুন,সাঁতার কাটুন। মনচাষা চত্বরের মধ্যেই রয়েছে ‘সহজিয়া’ কেন্দ্র। এখানে ছৌ-নাচ, বাউল গান, রায়বেশে নৃত্য প্রভৃতি আয়োজিত হয় সময়ে সময়ে। হারমোনিয়াম, খোল, তবলা নিয়ে বসে পড়ুন এখানে দলবেঁধে। জমে উঠবে সংগীতের আসর। রয়েছে একটি হস্তশিল্প কেন্দ্র। এখানে গ্রামীণ হস্তশিল্পীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যাবে। গ্রামের পথে হাটতে পারেন। কাছ থেকে দেখবেন গ্রামের জীবন। মন চাইলে নৌকা করে কিছক্ষণের জন্য ভেসে পড়তে পারেন বাগদা নদীতে।

গ্রামীণ খাদ্য-সংস্কৃতি

খাবারদাবারেও পাবেন গ্রাম বাংলার খাদ্য-সংস্কৃতির পরিচয়। টাটকা মাছের ঝোল, হাঁসের ডিমের ডালনা,ভিন্ন স্বাদের মুরগির মাংস, ঘি ভাত, মুড়িঘন্ট, মোচার ঘন্ট, ছক্কা, চচ্চড়ি, খিচুড়ি, লাবড়া, অম্বল, পাঁপড়, নতুন গুড়ের পায়েসের মতো বাঙালির খাদ্য-ঐতিহ্যের পরিচয় পাওয়া যাবে খাওয়ার পাতে। বয়স্করা ফিরে পাবেন পুরনো স্বাদ। ছোটদের পরিচয় ঘটবে নতুনের সঙ্গে।

থাকার ব্যবস্থা

নন-এসি ব্যাম্বু কটেজ ( চারজনের থাকার উপযোগী), ভাড়া দিনপ্রতি ৩,৫০০ টাকা। অতিরিক্ত একজন অতিথির জন্য লাগবে ৫০০ টাকা। মাথাপিছু সারাদিনের খাওয়ার খরচ ১২৬০ টাকা। ১০ বছরের কম বয়সের বাচ্চাদের থাকার জন্য কোনও খরচ নেই। ৫ বছরের নীচের বয়সের বাচ্চাদের খাওয়ার খরচ ধার্য হবে তাঁদের খাদ্য অনুসারে। খাদ্য-সহ গাড়িচালকদে থাকা-খাওয়া বাবদ খরচ ৯০০ টাকা (অথিদিদের মতোই সারাদিনের খাবারদাবার-সহ থাকার ব্যবস্থা দিনপ্রতি ১৩৫০ টাকা)।

মনচাষার সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরঃ ৯৪৭৭৪-৮৪১৩৬, ৯৮৩১০-৯৫২৩৪।

ছবি সৌজন্যে: https://monchasha.in/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *