৮৫০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়-ঢালের রিশপ একটি ছবির মতো গ্রাম। ভিড় এড়িয়ে নিরিবিলি প্রাকৃতির পরিবশে ছুটি কাটাতে চাইলে কালিম্পংয়ের রিশপকে অবশ্যই ভ্রমণ ঠিকানা হিসেবে বেছে নেওয়া যেতে পারে। নেওড়া ভ্যালিরই একটি আংশ রিশপ। পাহাড়ের ঢালে রিশপের ফুলে ফুলে ছাওয়া রাস্তায় সোনালী রদ্দুর গায়ে মেখে হেঁটে বেড়াতে ভালো লাগে। পাহাড়ের ধাপে ধাপে চাষবাসের দৃশ্যও খুব সুন্দর। রিশপ জুড়ে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বজায় থাকে দিনেরাতে। সময় চলে ধীরে। আর জেগে থাকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সুদীর্ঘ রেঞ্জ।
প্রকৃতপক্ষে সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশ্রেণীতে অবিশ্বাস্য সূর্যোদয়ের দৃশ্যের জন্যই রিশপের বিশেষ খ্যাতি। নেওড়াভ্যালির জঙ্গল লাগোয়া উপত্যকায় সারারাত ধরে জমা কুয়াশার সমুদ্রে সূর্যোদয়ের রঙিন আলো যে মায়াবী পরিবেশ তৈরি করে তার তুলনা পাওয়া ভার। কুয়াশা না থাকলে দেখা দেবে গভীর উপত্যকা, সেখানকার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মনুষ্য বসতি। পাখি পর্যবেক্ষণে আগ্রহীদের কাছেও রিশপ আকর্ষনীয় হবে। পাইন, ফার, বার্চ আর রডডেনড্রনের জঙ্গলে ঘেরা রিশপে হরেক পাখির দেখা মেলে। নজর রাখলে চোখে পড়তে পারে বড় গাছ থেকে ঝুলন্ত অর্কিড। রাতে নীচের দিকে দেখবেন সিকিমের গ্যাংটক শহরের বিন্দু বিন্দু আলোর পুঞ্জ।
টিপিন দাঁড়া: রিশপ থেকে জঙ্গল পথে ছোট ট্রেক করে উঠে আসা যায় টিপিন দাঁড়ায়। সাক্ষী থাকা যায় সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের মনমাতানো দৃশ্যের। পথের দৈর্ঘ্য দেড় কিলোমিটার। ট্রেকিংয়ে বা হাইকিংয়ে অভ্যস্ত না থাকলে থেমে থেমে পথ চলাই ভালো। সূর্যোদয় দেখার জন্য রিশপ থেকে হাঁটা শুরু করতে হবে অন্ধকার থাকতেই। টিপিন দাঁড়া পৌঁছতে ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। আবহাওয়ার কারণে অনেকসময়ই সূর্যাস্ত ভালো দেখা যায় না। তাই সূর্যোদয় দেখার সিদ্ধান্ত নেওয়াই ভালো। সকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ টিপিন দাঁড়ায় উপস্থিত হতে পারলে গোটা কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জে প্রস্ফুটিত আলোর রোশনাই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যায়।
অসাধারণ ভিউপয়েন্ট এই টিপিন দাঁড়া। পাইনের জঙ্গলে ঘেরা টিপিন দাঁড়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, মাউন্ট কাব্রু,কুম্ভকর্ণ,পান্ডিম,তালুং, রাথুং,সিম্ভো,নরসিং, মাউন্ট সিনিয়ালচু-সহ কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের আরো নানা শৃঙ্গ দেখা যায়। আর পরিষ্কার আবহাওয়ায় এই শৃঙ্গগুলিতে আলোর মালা হতবাক করে দেয়। টিপিন দাঁড়া থেকে পরিষ্কার দিনে নাথুলা ও জেলেপ লা পাস দেখা যায়।
সিঁদুরে লাল, হালকা লাল,কমলা,সোনালী থেকে পর্বত শীর্ষগুলিতে রুপোলী রং ধরবে ক্রমশ,বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। ফেরার পথ ধরতে হবে এবার।। দুপাশে ভিজে ভিজে পাইন, ফার,বার্চ,ফার্নের মধ্যে দিয়ে পথ চলা। শুধু পাখির কলকাকলি। মধুর স্মৃতি নিয়ে ফিরে আসুন রিশপে।
শিব-বুদ্ধ মন্দির : রিশপ থেকে মূল রাস্তা ধরে উৎরাই পথে ২ কিলোমিটার নেমে গেলে সেওল গ্রাম। এই গ্রামে রয়েছে একটি মন্দির। এই মন্দিরে শিব ও বুদ্ধ মূর্তি পাশাপাশি পূজিত হন। পাহাড়ি পথে ঘুরে ঘুরে নামতে হয় মন্দির চত্বরে পৌঁছানোর জন্য। গোটা পথটি সবুজে সবুজ।
রিশপ থেকে কোলাখামঃ নেওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশপথের কাছেই আবস্থান আরেকটি পর্যটন ঠিকানার, কোলাখাম। ছোট্ট, শান্ত জনপদ। পাইন, ওক, রডডেনড্রনের জঙ্গলে ঘেরা কোলাখাম রিশপ থেকে ৪ কিলোমিটার। লাভা থেকে কোলাখাম সাড়ে ৮ কিলোমিটার। কোলাখাম থেকে ভোরের কাঞ্চনজঙ্ঘার রুপ থেকে চোখ সরানো যাবে না। কোলাখাম থেকে ৫ কিলোমিটার ট্রেক করে ছাঙ্গে জলপ্রপাত দেখে আসা যায়। জলপ্রপাত যেখানে আছড়ে পড়ছে সেখানে পৌঁছাতে অনেকটা নীচে নামতে হয়। আ্যডভেঞ্চার প্রেমীদের জন্য কোলাখাম অনুকূল জায়গা। এখান থেকে নেওড়া ভ্যালির বিভিন্ন অংশে ট্রেক করা যায়।
লাভাঃ যাতায়াতের পথে এক চক্কর বেড়িয়ে নিতে পারেন ৭০০০ ফুট উচ্চতার লাভা। পাইন, ফার, বার্চের অরণ্যে ঘেরা লাভা খুব সবুজ। কালে কালে লাভা শহরের কেন্দ্রস্থল খানিকটা ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছে বটে, কিন্ত শহর থেকে একটু এদিক ওদিক গেলেই লাভার সবুজাভ রুপটি চোখে পড়বে। সেই রুপের খানিকটা ঝলক দেখবেন লাভা মনাস্ট্রি থেকে। লাভা মনাস্ট্রি অবশ্য দ্রষ্টব্য। অনেকগুলো প্রার্থনা কক্ষ, শিক্ষার্থী লামাদের জন্য থাকা পড়াশোনার ব্যবস্থা, লন, বসবার ব্যবস্থা, বিরাটাকার বুদ্ধ মূর্তি, সবমিলিয়ে বিশাল ব্যবস্থা। লাভা থেকে বেড়িয়ে নেওয়া যায় কালিম্পং শহর, ঝান্ডিদাড়া, লোলেগাঁও, কোলাখাম, চারখোল, রিশপ।
যাওয়ার পথ :
এন জে পি থেকে কালিম্পং হয়ে রিশপ ১১০ কিলোমিটার, বাগডোগরা থেকে ১২০ কিলোমিটার। কালিম্পং থেকে আলগাড়া হয়ে রিশপ ২৮ কিলোমিটার। এন জে পি, শিলিগুড়ি বা বাগডোগরা থেকে গাড়িভাড়া করে সরাসরি রিশপে পৌঁছানো যায়। কালিম্পং পর্যন্ত শেয়ার গাড়িতে এসে সেখান থেকে পুরো গাড়ি ভাড়া করেও রিশপ পৌঁছানো যেতে পারে। পথের শেষাংশ বোল্ডার বেছানো। গাড়ি খানিকটা দুলবে। লাভা থেকে রিশপের দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। পুরো গাড়ি ভাড়া করে আসতে হবে। লাভা থেকে ৪ কিলোমিটার ট্রেক করেও রিশপে পৌঁছানো যায়। আঞ্চলিক কাউকে সঙ্গী করে ট্রেক করাই ভালো।
থাকার ব্যবস্থা :
রিশপ নেচার কটেজ : ৯৮৩০২৫২৮৪৩, (০৩৩)৩০২৩০৪০০।
হোটেল সুনাখাড়ি, হোটেল গ্রিন ভ্যালি,হোটেল গোল্ডেন কটেজ : ৯৮৩০১০৭৭৮০, ৯৮৩০৬৮৯১৭৭।
হোটেল হিমালয়ান হাট: ৯০০৭১৮১৫৮৪।
প্যারাডাইস ভিলা (হোমস্টে) : ৯০৫১৫০৭৬৫১, ৯৮৩৬৯১৩৯২২।
রোজডেল ইন : ৯৯০৩০০৯৭৩৫,৬২৯১৩৫১০২৯।
রিশপ ইন : ৯৮৩২৩১১৯৭০, ৮৯১৮০১২১৪২।
টিবেট হোমস্টে : ৮৯৬৭২৩৬৯২৫।
লাভলি হোমস্টে : ৯৮৩৬০৮৭৬৫২।