পাহাড়ের পরে পাহাড়, ড্যাম, জলাধার আর চারিদিকটায় সবুজ আর সবুজ। অমলিন বাতাস। প্রতিটি প্রশ্বাসে ফুসফুস পরিশুদ্ধ হয় বিশুদ্ধ বাতাসে। জায়গাটা জজাহাতু। তবে জজহাতু নামেই পরিচিতি বেশি। আঞ্চলিক মানুষজনের উচ্চারণে জজাতু। এখানে আমরা জায়গাটিকে জজহাতু নামেই উল্লেখ করব। পুরুলিয়ার অফবিট ভ্রমণ ঠিকানা। পুরুলিয়াকে চিনতে চাইলে একবার জজহাতু আসতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডের সীমানা-ঘেঁষা জজহাতু সারা বছরই বনজ গন্ধে ম’ ম’ করে।
ফাল্গুনে, অর্থাৎ মাঝ-ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত পলাশের লাল রঙে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে জজহাতু। বর্ষার জজহাতু ঘন সবুজ। মাটি আরও লাল। জলাধারগুলো টইটম্বুর। শীতে আকাশ নীল। তখন জজহাতুর আরেকটা রং।
কুকি, নরহরা, লায়েক, মরুভাসা, লকড়াকুড়ি– এগুলো সব ড্যাম ও জলাধারের নাম। জাজহাতুর যত্রতত্র বাঁধ আর বাঁধভাঙা সৌন্দর্য। জলাধারগুলোকে ঘিরে আছে সবুজ টিলাশ্রেণি। তার ছায়া পড়ে জলে। শীতে পাখির দেখা মিলবে জলে-জঙ্গলে।
চামটাবুরু, গজাবুরু, জাইরা, সিদ্রালিয়া, কীর্তনীয়া, রানিগজর, বুরুটুংরি, এগুলো জজহাতুকে ঘিরে থাকা পাহাড়ের নামাবলী। তারই মধ্যে মধ্যে গ্রাম। আদিবাসী সমাজ-সংসার।
কালো পিচ রাস্তা। পাশে খেত। বসন্তে পলাশ বনের মধ্যে দিয়ে হাঁটবেন। জঙ্গুলে আঘ্রাণ, সোঁদা মাটির গন্ধ আচ্ছন্ন করে। শাল, পলাশ, মহুল, কেন্দু, নিম, বাঁশবনে ঘেরা সব আদিবাসী সব গ্রাম। কখনো বা চমকে উঠতে হতে পারে ময়ূরের অকস্মাৎ কেকাধ্বনিতে।
জজাহাতু বেড়াতে গেলে চামটাবুরু পাহাড়শীর্ষে একবার ওঠার চেষ্টা করবেন। উচ্চতা ২২৯৬ ফুট। পুরুলিয়ার উচ্চতম পাহাড় চামটাবুরু। বয়স্কদের অবশ্য পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা না করাই ভালো। অন্যরা সকাল সকাল যাত্রা শুরু করুন। মরুভাসা ড্যামের পাশ দিয়ে সকালের সেই পথচলা আপনাকে উজ্জিবীত করবে। যাঁরা পাহাড়ে উঠবেন না তাঁরাও যাত্রায় শামিল হতে পারেন পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত। চামটাবুরুর শীর্ষে উঠতে সাধারণত আড়াই থেকে তিন ঘন্টা সময় লাগবে। গাইড় হিসেবে আঞ্চলিক কোনও অধিবাসীকে সঙ্গী করে নেবেন। শীর্ষে ওঠার পর চারপাশের সামগ্রিক দৃশ্যপট আপনাকে বিষ্ময়ে অভিভূত করে ফেলবে।
পাহাড়ের শীর্ষ থেকে দিগন্ত-বিস্তারিত জঙ্গল, পান্না-সবুজ খয়রাবেরা লেক থেকে চোখ ফেরানো যায় না। দূরে দূরে গজাবুরু, কীর্তনীয়া, সিন্দ্রেলিয়া পাহাড়্রের গাঢ় সবুজ রূপ দেখে মনেই হবে না আপনি পুরুলিয়ার রূক্ষ ভূমিতে অবস্থান করছেন। পাহাড়ি জঙ্গলে রয়েছে ময়ূর, বুনো খরগোশ, সজারু। আগে হায়নার দেখা পাওয়া যেত, এখন দেখা যায় না। চামটাবুরুর মাথায় রয়েছে দেবতার থান। দেবতা বলতে জড়ো করে রাখা কিছু প্রস্তরখণ্ড। সেই জায়গাটাই আদিবাসীদের কাছে পবিত্র থান। পাহাড়শীর্ষ থেকে নেমে আসতে ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লে চামটাবুরু থেকে দুপুরে জজহাতু ফিরে মধ্যাহ্নভোজন সারা যায়।
দূষণমুক্ত পরিবেশ। হৈ-হট্টগোলের জায়গা এটা নয়। এখানে আকাশে ওড়ে টিয়াপাখির ঝাঁক। বনে,পাহাড়ে বেড়ান। গ্রামের পথে হাঁটুন। লায়েকের জলাধারে স্নান করুন। মাছ ধরতে পারেন। খাবেন বিষমুক্ত খাবারদাবার। ভ্রমণ শেষে ঘরে ফিরবেন শরীর-মনে উজ্জীবিত হয়ে।
যাওয়ার পথ
ট্রেনে গেলে নামতে হবে পুরুলিয়ার ঝালদা স্টেশন কিংবা ঝাড়খণ্ডের মুরি জংশন স্টেশনে। ঝালদা স্টেশন থেকে জজহাতু ১৩ কিলোমিটার। মুরি স্টেশন থেকে ২৬ কিলোমিটার। পুরুলিয়া শহর থেকে জজহাতু ৫৫ কিলোমিটার। ঝালদা স্টেশন থেকে টোটো রিজার্ভ করে জজহাতু চলে আসা যায়। মুরী স্টেশন থেকে গাড়ি পাবেন।
সড়কপথে নিজেদের গাড়িতে যেতে চাইলে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে রানিজঞ্জ, পুরুলিয়া হয়ে ঝালদা চলে আসুন। ঝালদা বাজার পেরিয়ে চলে আসুন ইছাগ মোড়ে। এখান থেকে বাঁয়ে মোড় ফিরে প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার এগিয়ে জজহাতুর। কলকাতা থেকে সড়কপথে জজহাতু ৩৫০ কিলোমিটার।
থাকার ব্যবস্থা
জজহাতু বেড়ানোর জন্য সুবিধাজনক থাকার জায়গা খামার গ্রামে সিদ্রালিয়া পাহাড়ের প্রায় পাদদেশে অবস্থিত বনপাহাড়ি ইকো স্টে। কাছেই লায়েক ও লাকড়াকুড়ি ড্যাম। আগে থেকে বলে রাখলে ঝালদা বা মুরি স্টেশন থেকে ইকো স্টে-তে পৌঁছে দেওয়ার জন্য টোটো, গাড়ির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় নায্য ভাড়ার বিনিময়ে। থাকা-খাওয়া-সহ বনপাহাড়ি ইকো স্টে-তে দিনপ্রতি মাথাপিছু খরচ ১,৩৫০ টাকা। বনপাহাড়ি ইকো স্টে-র সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরঃ ৯৩৩১৮ ৪৫২২০, ৯৮৩০৪ ৪৫৮৩৪।
ফটো: দীপঙ্কর মজুমদার