এই পর্বে খান্ডালা লোনাভালা ভীমাশঙ্কর মন্দির লাভাসা পুণে বেড়ানোর কথা।
দু’দিন মাথেরনের অপূর্ব হিলস্টেশনে কাটিয়ে আজ আমরা খান্ডালা হয়ে লোনাভালার পথে। ঠিক করেছিলাম, লোনাভালার হোটেলে ওঠার আগেই কয়েকটি দর্শনীয় স্থান দেখে নেব। মাথেরন থেকে লোনাভালা প্রায় ৬০ কিলোমিটার। বৃষ্টিসিক্ত সবুজের মধ্যে দিয়ে সেই যাত্রাও মনে রাখার মতো।
আগের দুটি পর্ব পড়তে পারেন নীচের দুই লিঙ্কে
প্রথম পর্বঃ https://torsa.in/maharashtra-in-monsoon-first-part/
দ্বিতীয় পর্বঃ https://torsa.in/maharashtra-in-monsoon-second-part/
অপূর্ব সব উপত্যকায় ঘেরা হিলস্টেশন লোনাভালায় পৌঁছালাম আমরা। সহ্যাদ্রি পর্বতশ্রেণির মধ্যে লোনাভালা ও খান্ডালার দিগন্ত জুড়ে সবুজ পাহাড়ের ঢেউ উঠেছে যেন এই বর্ষার মরসুমে। একটা ঝরনার সামনে উপস্থিত হলাম আমরা। অনেকটা উপর থেকে দুটো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে নেমে এসেছে প্রপাতধারা। ‘টাইগারস লিপ’ বা ‘বাঘের ঠোঁট’ নামে পরিচিত এই জলপ্রপাতটি। বর্ষার ঝরনা বেগবতী।
এরপর ‘ডিউকের নাক’ দেখা হল। ‘ডিউকস নোজ’ লম্বা আকৃতির একটি পাহাড় চূড়া। ইংল্যান্ডের ডিউক ওয়েলিংটনের চোখে পড়ার মতো টিকলো নাকের সঙ্গে মনে হয় মিল পাওয়া গিয়েছিল এই পাহাড় চূড়াটির। শৃঙ্গের আরেক নাম ‘নাগফণী’। উপরের দিকটা খানিকটা সাপের ফনার মতো দেখতে বলে। চমৎকার একটি ভিউপয়েন্ট জায়গাটা। লোনাভালা রেল স্টেশন থেকে দূরত্ব যথাক্রমে ৬ ও ১০ কিলোমিটার। ওখান থেকে গিয়েছিলাম টিকোনা ফোর্ট দেখতে। পাহাড়ের উপর দুর্গ। ট্রেক করে ফোর্ট চত্বরে যাওয়া যেতে পারে। ফোর্টের গোড়া পর্যন্ত যাওয়ার জন্য গাড়ি চলাচলের রাস্তা আছে। ফোর্ট দেখে আসার পরে একটু ক্লান্ত তো বটেই। হোটেলে পৌছে এবার বিশ্রাম।
পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে প্রথমে লোনাভালার নারায়ণী মন্দিরে গেলাম। অনেকটা জায়গা নিয়ে খুব সুন্দর মন্দির। শীর্ষে তিনটি শিখর। ২০০২ সালে দেবী নারায়ণীর মূর্তির স্থাপনা হয়। দেবী মূর্তি এসেছিলেন রাজস্থানের এক মন্দির থেকে। পুণে শহর থেকে লোনাভালার নারায়ণী মন্দির সড়কপথে কমবেশি ৬৫ কিলোমিটার। লোনাভালা রেল স্টেশন থেকে ২ থেকে আড়াই কিলোমিটার। মন্দির কমপ্লেক্সের মধ্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
নারায়ণী মন্দির থেকে বেরিয়ে আমরা কারলা এবং ভাজা গুহা দেখতে গিয়েছিলাম। দুটিই বৌদ্ধ গুহা। লোনাভালা শহর থেকে কারলা গুহা এলাকা ১১ কিলোমিটার। দুই-আড়াই কিলোমিটার দূরে ভাজা গুহা। কারলা গুহার অবস্থান অনেকটা উঁচুতে। সিঁড়ি পথে উঠতে হয়। পাথর খোদাই করে তৈরি গুহা-অভ্যন্তরের স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের সুষমা সময় নিয়ে দেখতে হয়। ৮ নম্বর গুহাটি অবশ্য দ্রষ্টব্য। এটি চৈত্যগৃহ তথা গর্ভগৃহ। বিশেষজ্ঞদের মতে, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে পঞ্চম খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে ক্রমশ নির্মিত হয়েছিল সামগ্রিক গুহা চত্বরটি। ভাজা কেভস ২২টি গুহার সমষ্টি। মূল চৈত্যগৃহটি অক্ষত রয়েছে। এই গুহা কমপ্লেক্সটি যিশু খ্রিস্টের জন্মের ২০০ বছর আগে তৈরি হয়।
দক্ষিণ মহারাষ্টের পুণে জেলার অন্তুর্গত কারলি আঞ্চলটিতে কারলা, ভাজা ছাড়াও আরও গুহা আছে। সবই বৌদ্ধ গুহা। আরব সাগর থেকে মহারাষ্ট্র হয়ে দক্ষিণ ভারতে প্রবেশের পথে পড়ে কারলি। প্রাচীনকালে বাণিজ্য-পথ হিসেবে ব্যবহৃত হত এই রুটটি। যাইহোক, এবার আমরা পুণের পথে। পুণে শহরে প্রবেশের আগে শনিওয়ারা ফোর্ট ও কেলকর মিউজিয়াম দেখে নেওয়া গেল। তারপর হোটেলে।
পরের দিন প্রাতরাশ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য, দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম ভীমাশঙ্কর দর্শন। পুণে থেকে ভীমাশঙ্কর মন্দির প্রায় ১১০ কিলোমিটার। সহ্যাদ্রি পর্বতমালার মধ্য দিয়ে পথ। পথে একটা ড্যাম এলাকা পেরলাম। খুব সুন্দর জায়গাটা। ভীমাশঙ্কর পৌঁছানোর খানিক আগে ঝেঁপে বৃষ্টি এল। প্রকৃতির রূপ, লাবণ্য আরও অপরূপ হয়ে উঠল। মন্দির দর্শন হল। চারপাশের পরিবেশ ও দৃশ্যপট অপূর্ব। খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আমরা ফের পুণের পথে।
পরের দিন সকালে আমরা বেরিয়ে পড়লাম লাভাসার উদ্দেশে। সহ্যাদ্রি পর্বতশ্রেণির মাঝে একটা বিশাল লেককে ঘিরে গড়ে উঠেছে আধুনিক লাভাসা শহর। বাড়িঘরের গঠনশৈলীতে পাশ্চাত্য আর্কিটেকচারের ছোঁয়া। ঝকঝকে পরিকল্পিত শহর। টয়ট্রেনে শহরের একটা আংশ পরিদর্শনের ব্যবস্থা আছে। লেকে আছে ওয়াটার স্পোর্টসের ব্যবস্থা। বর্ষায়, শীতে লাভাসা অনবদ্য।
পুণে ফিরে এলাম। আজ সন্ধ্যায় আমাদের কলকাতায় ফেরার ট্রেন। হাতে সময় আছে খানিকটা। সেই অবসরে পুণের আরও কয়েকটি জায়গা দেখে নেওয়া গেল। প্রথমে গেলাম আগা খান প্যালেস। অনেকটা জায়গা নিয়ে প্রাসাদ। এখানে গান্ধীজি দুই বৎসর কাল কারাবাসে ছিলেন। এখানেই তাঁর সহধর্মিনী কস্তুরবাকে সমাধিস্থ করা হয়। এরপএ দেখলাম ওসো আশ্রম ও দাগদুশেঠ হালওয়াই গণপতি মন্দির।
ফিরে এলাম হোটেলে। খানিক বিশ্রাম। তারপর পুণে স্টেশনে। আজাদ হিন্দ এক্সপ্রেসে (১২১২৯) উঠে বসলাম। বেশ কয়েকটা দিন ধরে বর্ষার সবুজ মহারাষ্ট্রে বেড়িয়ে সকলেই বেশ তরতাজা। মনে খুশির রেশ। কলকাতামুখী ট্রেন ছাড়ল নির্ধারিত সময়েই।
হেডার ফটোঃ ট্র্যাভেল ট্রায়াঙ্গেল।
লেখকের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরঃ 9433456266.