Follow us
Search
Close this search box.

জজহাতুর অন্দরে

জজহাতুর অন্দরে

পাহাড়ের পরে পাহাড়, ড্যাম, জলাধার আর দিগন্ত জুড়ে সবুজ আর সবুজ। অমলিন বাতাস। প্রতিটি প্রশ্বাসে ফুসফুস পরিশুদ্ধ হয় বিশুদ্ধ অক্সিজেনে। এই কোভিডকালে ওই শুদ্ধ বাতাস, প্রাণদায়ী অক্সিজেন খুব জরুরি। জায়গাটা জজাহাতু। তবে জজহাতু নামেই পরিচিতি বেশি। আঞ্চলিক মানুষজনের উচ্চারণে জজাতু। এখানে আমরা জায়গাটিকে জজহাতু নামেই উল্লেখ করব। পুরুলিয়ার অফবিট ভ্রমণ ঠিকানা। রাঢ়বঙ্গের পুরুলিয়াকে আবিষ্কর করতে হলে জজহাতুতে আসতেই হবে। পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডের সীমানা-ঘেঁষা জজহাতু সারা বছরই বনজ গন্ধে ম’ ম’ করে।

ফাল্গুনে, অর্থাৎ মাঝ-ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত পলাশের লাল রঙে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে জজহাতু। বর্ষায় জজহাতু ঘন সবুজ, মাটি আরও লাল। জলাধারগুলো টইটম্বুর। তবে বর্ষায় জল খানিকটা ঘোলা। শীতে আকাশ নীল। সেই সুনীল আকাশের প্রতিফলনে সবুজে ঘেরা জলাধারগুলি এক একটা ছবি।

কুকি, নরহরা, লায়েক, মরুভাসা, লকড়াকুড়ি, এগুলো সব ড্যাম ও জলাধারের নাম। জাজহাতুর যত্রতত্র বাঁধ আর বাঁধভাঙা সৌন্দর্য। জলাধারগুলোকে ঘিরে আছে সবুজ সবুজ টিলা-পাহাড়। তার ছায়া পড়ে জলে। শীতে পাখির দেখা মিলবে জলে-জঙ্গলে। যে-কোনও একটি জলাধারের ধারে গিয়ে বসুন। বিশুদ্ধ প্রকৃতি আর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মধ্যে কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যাবে তার হিসেব রাখা দুষ্কর। শীতে কুকি জলাধারের পারে পিকনিকের আসর জমে।

চামটাবুরু, গজাবুরু, জাইরা, সিদ্রালিয়া, কীর্তনীয়া, রানিগজর, বুরুটুংরি, এগুলো জজহাতুকে ঘিরে থাকা পাহাড়ের নামাবলী। সবুজ-রঙা পাহাড় সব। শীতে নীল আকাশ, নীল জলাশয়, সবুজ পাহাড়ের সারি, সব মিলেমিশে চোখে ও মনে যে ছবি এঁকে দেয় তা শান্তির, তা সুন্দরের। বর্ষায় জজাহাতু যদি হয় বিরাট প্রেক্ষাপটে আঁকা এক আশ্চর্য জলছবি, তবে বসন্তের বনপলাশী জজাহাতু যেন তেলরঙে আঁকা আরেক ছবি। শীতে রৌদ্র-ছায়ার জজহাতু বড় রোমান্টিক।

কালো পিচ রাস্তা ধরে যাবেন এদিক-সেদিক। শীতে হলুদ সর্ষে খেতের পাশ দিয়ে যাবেন। বসন্তে পলাশ বনের মধ্যে দিয়ে হাঁটবেন। বর্ষায় জঙ্গুলে আঘ্রাণ, সোঁদা মাটির গন্ধে সিক্ত হবেন। শাল, পলাশ, মহুল, কেন্দু, নিম, বাঁশবনে ঘেরা সব আদিবাসী গ্রাম বেড়িয়ে দেখবেন বন-পাহাড়ের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের নানা চিত্র। কখনো বা চমকে উঠবেন ময়ূরের কেকাধ্বনিতে।

জজাহাতু বেড়াতে গেলে চামটাবুরু পাহাড়শীর্ষে একবার ওঠার চেষ্টা করবেন। উচ্চতা ২২৯৬ ফুট। পুরুলিয়ার উচ্চতম পাহাড় চামটাবুরু। বয়স্কদের অবশ্য পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা না করাই ভালো। অন্যরা সকাল সকাল যাত্রা শুরু করুন। মরুভাসা ড্যামের পাশ দিয়ে সকালের সেই পথচলা আপনাকে উজ্জিবীত করবে। চারদিক সবুজে সবুজ। যাঁরা পাহাড়ে উঠবেন না তাঁরাও এই যাত্রায় শামিল হতে পারেন। তাঁরা যাত্রাপথটির সৌন্দর্য উপভোগ করবেন। চামটাবুরুর শীর্ষে উঠতে সাধারণত আড়াই থেকে তিন ঘন্টা সময় লাগবে। গাইড় হিসেবে আঞ্চলিক কোনও মানুষকে সঙ্গী করে নেবেন। শীর্ষে ওঠার পর চারপাশের সামগ্রিক দৃশ্যপট আপনাকে বিষ্ময়ে অভিভূত করে ফেলবে।

চামটাবুরুর উপর থেকে দিগন্তবিস্তৃত জঙ্গল, পান্না-সবুজ খয়রাবেরা লেক থেকে চোখ ফেরানো যায় না। দূরে দূরে গজাবুরু, কীর্তনীয়া, সিন্দ্রেলিয়া, ব্লুমবুরু পাহাড়্রের গাঢ় সবুজ রূপ দেখে মনেই হবে না আপনি পুরুলিয়ার রূক্ষ ভূমিতে অবস্থান করছেন। পাহাড়ি জঙ্গলে রয়েছে ময়ূর, বুনো খরগোশ, সজারু। আগে হায়নার দেখা পাওয়া যেত, এখন দেখা যায় না। চামটাবুরুর মাথায় রয়েছে দেবতার থান। দেবতা বলতে জড়ো করে রাখা কিছু প্রস্তরখণ্ড। সেই জায়গাটাই আদিবাসীদের কাছে পবিত্র থান। পাহাড়শীর্ষ থেকে নেমে আসতে ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লে চামটাবুরু থেকে দুপুরে জজহাতু ফিরে মধ্যাহ্নভোজন সারতে পারবেন।

 

দূষণমুক্ত পরিবেশ। ভিড়ভাট্টা, হৈ-হট্টগোলের জায়গা এটা নয়। বাতাসে পেট্রল-ডিজেলের কটূগন্ধী ধোঁয়া নয়, উড়বে টিয়াপাখির ঝাঁক। বনে,পাহাড়ে বেড়ান। গ্রামের পথে হাঁটুন। লায়েকের জলাধারে স্নান করুন, মাছও ধরতে পারেন। খাবেন বিষমুক্ত খাবারদাবার। ভ্রমণ শেষে ঘরে ফিরবেন নতুন প্রাণশক্তিতে উজ্জিবীত হয়ে।

যাওয়ার পথ

ট্রেনে গেলে নামতে হবে পুরুলিয়ার ঝালদা স্টেশন কিংবা ঝাড়খণ্ডের মুরী জংশন স্টেশনে। ঝালদা স্টেশন থেকে জজহাতু ১৩ কিলোমিটার। মুরী স্টেশন থেকে জজহাতু ২৬ কিলোমিটার। পুরুলিয়া থেকে জজহাতু ৫৫ কিলোমিটার। ঝালদা স্টেশন থেকে টোটো রিজার্ভ করে জজহাতু চলে আসা যায়। মুরী স্টেশন থেকে গাড়ি পাবেন।

 

সড়কপথে নিজেদের গাড়িতে যেতে চাইলে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে রানিজঞ্জ, পুরুলিয়া হয়ে ঝালদা চলে আসুন। ঝালদা বাজার পেরিয়ে চলে আসুন ইছাগ মোড়ে। এখান থেকে বাঁয়ে মোড় ফিরে প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার এগলে পৌঁছে যাবেন জজহাতুর অন্দরমহলে। কলকাতা থেকে সড়কপথে জজহাতু ৩৫০ কিলোমিটার।

থাকার ব্যবস্থা

জজহাতু বেড়ানোর জন্য সুবিধাজনক থাকার জায়গা খামার গ্রামে সিদ্রালিয়া পাহাড়ের প্রায় পাদদেশে অবস্থিত বনপাহাড়ি ইকো স্টে। কাছেই লায়েক ও লাকড়াকুড়ি ড্যাম। আগে থেকে বলে রাখলে ঝালদা বা মুরী স্টেশন থেকে ইকো স্টে-তে পৌঁছে দেওয়ার জন্য টোটো, গাড়ির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় নায্য ভাড়ার বিনিময়ে। থাকা-খাওয়া-সহ বনপাহাড়ি ইকো স্টে-তে দিনপ্রতি মাথাপিছু খরচ ১২০০ টাকা। বনপাহাড়ি ইকো স্টে-র সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরঃ ৯৩৩১৮ ৪৫২২০, ৯৮৩০৪ ৪৫৮৩৪।

 

ছবি : দীপঙ্কর মজুমদার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *