গতকাল পহলগাম থেকে গিয়েছিলাম কাশ্মীরের অফবিট ভ্রমণ ঠিকানা দকসুমে। সেখান থেকে বরফে বরফে ছয়লাপ সিন্থন টপে। পহলগাম থেকে যাওয়ার পথে মার্তণ্ড মন্দির দর্শন হয়েছে। দেখলাম মুঘল সম্রাজ্ঞী নুর জাহানের প্রিয় বাগিচা আছাবল। দকসুম, সিন্থন টপ দেখে পহলগামে ফেরার পথে কোকেরনাগের ঝরনাটিও দেখা হয়েছে।
আজ ৮ এপ্রিল, ২০২৩। সকাল ১০টা নাগাদ পহলগাম থেকে শ্রীনগরের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। ৪ এপ্রিল কলকাতা থেকে বিমানে চণ্ডীগড় হয়ে শ্রীনগর পৌঁছেছিলাম শেষ বিকেলে। রাতটা ছিলাম শ্রীনগরের হোটেলে।
ওই প্রথম দিন সন্ধ্যায় বেরিয়েছিলাম একটু। গিয়েছিলাম জিরো ব্রিজে। কাঠের আর্চ ব্রিজ। নীচ দিরে বয়ে চলেছে কাশ্মীরের বহু ইতিহাসের সাক্ষী ঝিলম নদী। পঞ্চাশের দশকে তৈরি হয়েছিল এই সেতুটি। আশির দশকে ব্রিজটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পরে চালু হয় আবার। জায়গাটা শ্রীনগরের একটি হেরিটেজ ল্যান্ডমার্ক। এখন হেঁটে সেতুটি পারাপার করা যায়। এদিন সন্ধ্যায় শ্রীনগরের তাপমাত্রা ছিল ৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। ভালোই ঠান্ডা লাগছিল। পহলগামে থাকার সময়ে মনে হয়েছিল, শ্রীনগরের ঠান্ডা তো কিছুই নয়। রাতে পহলগামের তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছিল মাইনাসের ঘরে।
যাইহোক, পথে খানিক কেনাকাটার জন্য একটু যাত্রাবিরতি ঘটেছিল। শ্রীনগরে পৌঁছালাম বেলা ১টা নাগাদ। শ্রীনগরে এখন টিউলিপ ফেস্টিভ্যাল চলছে। এপ্রিলের শ্রীনগরের বড় আকর্ষণ। প্রচুর ভ্রমণার্থীর সমাগম ঘটেছে।
মধ্যাহ্নভোজন সেরে গেলাম জবরওয়ান পর্বতশ্রেণির পাদদেশে টিউলিপের বাগিচায়। এবার সরকারি ভাবে টিউলিপ গার্ডেন খোলা থাকার কথা ২ থেকে ২০ এপ্রিল। কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট তারিখের কয়েকদিন আগেই দর্শকদের জন্য টিউলিপ গার্ডেন খুলে দিয়েছেন। শ্রীনগর শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে টিউলিপ গার্ডেনের দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। কাছেই ডাললেক।
আগে এই বাগিচার নাম ছিল সিরাজ বাগ। ২০০৭-এ ‘ইন্দিরা গান্ধি মেমোরিয়াল টিউলিপ গার্ডেন’ নামে সরকারি ভাবে দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়া হয় বাগিচাটি। বসন্তে কাশ্মীরের প্রকৃতি এমনিতেই অপরূপ। ৭৪ একরের প্রস্ফূটিত টিউলিপ বাগিচা সেই সৌন্দর্যে বৃহৎ শিল্পীর তুলির আরেকটি আশ্চর্য পোঁচ।
নেদারল্যান্ডসের কেউকেনহফকে ইউরোপের বাগান বলা হয়। এখানকার টিউলিপ জগদ্বিখ্যাত। কাশ্মীরের সিরাজ বাগ এশিয়ার বৃহত্তম টিউলিপ বাগিচা।
ছবি, সিনেমা, ভিডিওর মাধ্যমে শ্রীনগরের টিউলিপ বাগিচার সঙ্গে অপ্রত্যক্ষ একটা পরিচয় তো ছিলই। সমস্ত কল্পনাকে নস্যাৎ করে এদিন আমার চোখের সামনে ফুটে উঠল রূপকথার এক আবাক জগৎ। যেন লক্ষ লক্ষ প্রজাপতির রংবাজি চলছে এখানে। টিউলিপের সঙ্গে ডাফোডিল, হায়াসিন্থ, নার্সিসাস, মুসকারিয়া, আইরিস। পশ্চিমে ডাললেক থেকে উড়ে আসা বাতাসে লাল, গোলাপি, হলুদ, বেগুনি রংয়ের আসংখ্য ফুল হেলছিল, দুলছিল, তিরতির করে কাঁপছিল।
সন্ধ্যায় বেরিয়ে এলাম টিউলিপ গার্ডেন থেকে। ডাললেকের পারে বুলেভার্ড রোড জমজমাট। প্রচুর পর্যটক। বাতাসে তুজির (কাবাব) গন্ধ। ডাললেক থেকে দূরের পাহাড়ে স্বপ্নবৎ আলোকিত পরীমহল, ব্যস্ত হাউসবোট, গমগমে হোটেল-রেস্তোরাঁ, শ্রীনগরে এখন বসন্তোৎসব।
মার্চ থেকে মে-র প্রথমার্ধ পর্যন্ত উপত্যকায় জাগ্রত থাকে বসন্তের মরসুম। পাহাড় ঢালের ঘাসে ঘাসে ছোট ছোট নাম না জানা কত যে রঙিন ফুল। কোথাও কোথাও ছোট আকারের হলুদ বর্ণের সর্ষের খেত চোখে পড়েছে। রঙিন চিনার, উপত্যকার গ্রামে গ্রামে অ্যামন্ড, পিচ ও চেরি ফুল, রাস্তায় চলতে চলতে স্নোড্রপ, ফরসিথিয়া, ডাফোডিল। এ যেন রংয়ের হোলি। দুর্দান্ত শীতের মরসুম শেষে এই বসন্তে আঞ্চলিক মানুষজন পিকনিকের আসরে সামিল হন।
মার্চ-এপ্রিলে শ্রীনগরের বাজারে নানা আকার ও নকশার বাস্কেট চোখে পড়েছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওগুলো পিকনিকের বাস্কেট। এ সময়ে প্রধাণত উইলো কাঠের তৈরি এই বাস্কেটের চাহিদা বাড়ে। ঘর সাজানো বা অন্য কাজে ব্যবহারের জন্য ভ্রমণার্থীরা সুদৃশ্য এই বাস্কেট কিনতে পারেন। লোকাল বাজারে ঢুঁ মারতে হতে পারে জিনিসটি হস্তগত করার জন্য। দামেও খানিক সস্তা হবে এখানে। সুভেনির বা গিফট হিসেবে চমৎকার।
আগে দু’বার কাশ্মীর ভ্রমণে এসেছি। বসন্তের কাশ্মীরে এই প্রথম। এলাম দেখলাম এবং বর্ণময় আরেক কাশ্মীর উন্মোচিত হল আমার চোখে, মনে।
“অগর ফিরদৌস বর রু-এ-জমিন অস্ত্
হমিন অস্ত্-ও হমিন অস্ত্-ও হমিন অস্ত্।”
“পৃথিবীতে স্বর্গ যদি কোথাও থেকে থাকে
তা এখানে তা এখানে তা এখানে।”
সেই কোনকালে, ভারতের মধ্যযুগীয় সুলতানি যুগে, সুফি কবি ও গীতিকার আমির খসরুর (জন্ম ১২৫৩-মৃত্যু ১৩২৫) হৃদয়-নিঃসৃত এই উপলব্ধি এখনো সুন্দর ও সত্য।
ফটোঃ উপর থেকে নীচে যথাক্রমে –
কাশ্মীর লাইফ
এক্স ডট কম
লেখক
ইন্ডিয়াফিল্ডস
ভিলেজ স্কোয়ার
গ্রেটার কাশ্মীর
লেখকের কাশ্মীর সিরিজের আরও দুটি লেখা
‘কাশ্মীর: পহলগাম থেকে আরু হয়ে বেতাব ভ্যালি’
https://torsa.in/aru-and-betab-valley-from-pahalgam/
‘কাশ্মীর: পহলগাম থেকে দকসুম ও সিন্থন টপ’
https://torsa.in/daksum-and-sinthon-top-from-pahalgam/