Follow us
Search
Close this search box.

জলপাইগুড়ি থেকে ডুয়ার্স হয়ে নেওড়া ভ্যালি

জলপাইগুড়ি থেকে ডুয়ার্স হয়ে নেওড়া ভ্যালি

প্রথম পর্ব

১৪ অক্টোবর, ২০২২। জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে পা রাখলাম বেলা সাড়ে ১০টায়। পদাতিক এক্সপ্রেস শিয়ালদা থেকে আগের রাতে ছেড়েছিল ১১টা ২০-তে। বাতাসে ঠান্ডার একটা শিরশিরানি। ভালো আবহাওয়া। আপাতত গন্তব্য পশ্চিমবঙ্গ পর্যটক উন্নয়ন নিগমের তিস্তা পর্যটক আবাস।

তিস্তা পর্যটক আবাস।

বর্তমান নাম ‘তিস্তা সুন্দরী টুরিজম প্রপার্টি’। অবস্থান জলপাইগুড়ি শহরের প্রান্তে ডেঙ্গুয়াঝড় এলাকায়। স্টেশন থেকে দূরত্ব প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার। একটা টোটোতে ওঠা গেল। ছিমছাম টুরিস্ট লজ। কাছেই জলপাইগুড়ির রাজবাড়ি।

তিস্তা ব্যারেজ করলা নদী

তিস্তা ব্যারেজ

স্নান-খাওয়ারে পর খানিক বিশ্রামান্তে বিকেলের দিকে একটা গাড়ি ভাড়া করে গেলাম তিস্তা ব্যারেজে। ব্যারেজ-সংলগ্ন গাজলডোবার জলাশয় নানা পাখির আবাস। নৌকা করে জলাশয়ে পাখি দেখতে যাওয়া যায়। শীতে এখানে পরিযায়ী পাখি আসে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে। পক্ষী-পর্যটকদেরও সমাবেশ ঘটে তখন। ফেরার পথে দেখে এলাম একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম ভ্রামরী মন্দির।

ভ্রামরী মন্দিরের বাইরে শিবের মূর্তি

তিস্তা ব্যারেজের কাছাকাছি ভালো থাকার জায়গা পশ্চিমবঙ্গ পর্যটক উন্নয়ন নিগমের ভোরের আলো (ভোরের আলো টুরিজম প্রপার্টি)। জঙ্গলে ঘেরা পরিবেশ। শীতে জায়গাটি চমৎকার। বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের রাস্তা ধরে যেতে হয়। শালের জঙ্গল। কলকাতা শহরের বাসিন্দা। বনের পথে যেতে যেতে মনে হল অন্য জগতে এসে পড়েছি।

তিস্তা ব্যারেজের একাংশ।

পরের দিন সকালে গেলাম দেবী চৌধুরানীর কালী মন্দিরে। পর্যটক আবাস থেকে ২ কিলোমিটার। ২৭ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশেই মন্দির। তারপর জুবিলি পার্ক বেড়িয়ে গেলাম করলা নদীর সঙ্গে দেখা করতে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠের সূত্রে জলপাইগুড়ি সঙ্গে পরিচয় কোন কালে। বহুকাল পরে আসা। পাল্টেছে শহরটা, তবে সেই সবজে আঘ্রাণটা টের পাওয়া যাচ্ছিল। নৌকায় ভেসে তিস্তা ও করলার সঙ্গমে যাওয়া যায়। সুন্দর জলযাত্রা।

দেবী চৌধুরানীর কালী মন্দির যাওয়ার পথ।

গরুমারার এলিফ্যান্ট ক্যাম্পে

আজ ১৬ অক্টোবর। পর্যটক আবাস ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। সকাল সাড়ে ন’টা তখন। যাব গরুমারার জঙ্গলে। তিস্তা পর্যটক আবাস থেকে ৪০ কিলোমিটার। ঘন্টা দেড়েক সময় লাগল। ধূপঝোরায় গরুমারা এলিফ্যান্ট ক্যাম্পে এসে উঠলাম। বুক করাই ছিল। হিমালয়ের পাদদেশে গরুমারা অরণ্যের দক্ষিণাংশে এই সরকারি ফরেস্ট লজটির অবস্থান। জঙ্গলের অভ্যন্তরে সুন্দর থাকার ব্যবস্থা। মূর্তি নদীর উভয় তীর জুড়ে জঙ্গল। নদীতে সুন্দর সূর্যাস্ত দেখা যায়। সবুজ জঙ্গলের মধ্যে জলপ্রবাহে রঙিন আলো। বড় মায়াময় সেই দৃশ্য।

গরুমারা এলিফ্যান্ট ক্যাম্প।

ক্যাম্পের নিজস্ব ওয়াচটাওয়ার আছে। কাছেই সল্ট লিক তথা নোনা জলের ডোবা। জন্তুজানোয়াররা সেখানে নুন চাটতে, জল খেতে আসে। ওয়াচটাওয়ার থেকে সে দৃশ্য দেখা যায়, তবে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়। দেখা মিলবে নানা পাখির।

শিলিগুড়ি থেকে গরুমারা ন্যাশনাল পার্ক ৮০ কিলোমিটার। বাগডোগরা বিমানবন্দর ৭৯ কিলোমিটার। এন জে পি থেকে গরিমারা বা ধূপঝোরা এলিফ্যান্ট ক্যাম্প ৬১ কিলোমিটার।

এলিফ্যান্ট ক্যাম্প সংলগ্ন জঙ্গল।

এলিফ্যান্ট ক্যাম্পে লাঞ্চ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সান্তালে খোলা বা সুনতালে খোলার দিকটায়। ‘সান্তালে’ মানে কমলালেবু, আর ‘খোলা’ মানে নদী। সামসিং, সান্তালে খোলা অঞ্চলটায় ভালো কমলালেবু ফলে। ফলের নামে জলের নাম। সান্তালে নদী। সান্তালে খোলার ২ কিলোমিটার আগে ভাড়া করা গাড়ি ছেড়ে দিতে হল। ওখান থেকে লোকাল গাড়ি ভাড়া নিয়ে বেড়াতে হবে। এটাই নিয়ম। একটা ঝুলন্ত কেবল ব্রিজ আছে সান্তালে খোলায়। একসঙ্গে পাঁচজনের বেশি ব্রিজে ওঠার নিয়ম নেই। তবে সেই নিয়ম যে খুব মানা হচ্ছে এমনটা দাবি করা যায় না। জঙ্গলে ঘেরা জায়গাটা প্রকৃতির একেবারে অন্তস্থল যেন। পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের সুন্দর একটা লজ আছে এখানে। ওই ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে লজে যেতে হয়।

সান্তালে খোলার কাছাকাছি সামসিং ও মৌচুকি বেড়িয়ে আসা যায়। কমলালেবু ও চায়ের বাগান আর জঙ্গলবেষ্টিত সামসিংয়ের অবস্থান নেওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের পূর্ব প্রান্ত ঘেঁষে, মূর্তি নদীর পারে। সামসিং ভিউ পয়েন্ট থেকে সবুজ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে মূর্তি নদীর প্রবাহ একটি দুর্দান্ত দৃশ্য। সামসিং থেকে লালি গুরাস উপত্যকা বেড়িয়ে আসা যায়। সামসিং থেকেই ৬ কিলোমিটারের চড়াই পথ ধরে পৌঁছানো যায় মৌচুকি। জঙ্গল-পাহাড়ে ঘেরা মৌচুকি ও সামসিংয়েও বন বিভাগের লজ আছে।

সান্তালে খোলার কেবল ব্রিজ।

আমরা সান্তালে খোলা থেকে গিয়েছিলাম রকি আইল্যান্ডে। মূর্তি নদীর দুই ধারে, নদীর মধ্যে ছোট-বড় বোল্ডার। পাথুরে নদী। সেই নদীর শিতল জলে পা ডুবিয়ে খুব আরাম লাগল। সন্ধ্যায় ফিরে এলাম এলিফ্যান্ট ক্যাম্পে। সেখানে আঞ্চলিক আদিবাসী মহিলা-পুরুষের একটি দল খুব সুন্দর নাচের একটা অনুষ্ঠান পরিবেশন করল। বেশ ভালো লাগল অনুষ্ঠানটি। এখানে ভাওয়াইয়া গান শিক্ষার একটি কেন্দ্র আছে। জঙ্গলের মধ্যে সঙ্গিতের আসর বসে। বন-সংলগ্ন গ্রামের মহিলাদের দ্বারা গঠিত স্বনির্ভর গোষ্ঠী পাটের নানা হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরি করেন। তারও একটা কেন্দ্র রয়েছে।

তারপর জঙ্গলের রাত, সেই বাঙ্ময় রাত কান পেতে অনুভবের। জ্যোৎস্নায় মৃদু আলো আর আঁধারের ইন্দ্রজাল রচিত হয়। এখন, চুপচাপ জঙ্গলে আচম্বিতে কোনও রাতচরা পাখির ডাক, অরণ্যের গভীর থেকে ভেসে আসা অদ্ভুদ কোনও শব্দ, পোকামাকড় সৃষ্ট বিচিত্র সব ধ্বনি কানে আসছে। বাইরে বেরনো মানা। লেপার্ড আছে সামনের জঙ্গলে। গন্ডার, হাতি, গাউর, লেপার্ড, ভাল্লুক, হরিণ, পাখি, প্রজাপতি গরুমারা অরণ্যের নাম করা সব বাসিন্দা।

গরুমারার জঙ্গল-অভ্যন্তর।

সাফারিতে গিয়েছিলাম পরের দিন সকালে। টিকিট কাউন্টার থেকে পারমিশন সংগ্রহ করে ভোর ভোর জঙ্গলে ঢুকেছিলাম জিপে করে। চার কিলোমিটারের সাফারি। ‘তেমন কিছু’র দেখা মেলেনি বলে কোনও কোনও সঙ্গী ভ্রমণার্থীকে একটু আপশোষ করতে দেখা গেল। হতেই পারে। ওই ‘তেমন কিছু’ হল জন্তু-জানোয়ার। তাদের দেখা পাওয়ার একটা বাসনা তো থাকেই। তবে দিনের আলো ফোটার সময়ে জঙ্গলের ছবিটা বড় প্রশান্তির। মনে থাকবে।

পরবর্তী অংশ আগামী পর্বে

2 Comments

  1. A.Pramanik says:

    Asadharon presentation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *