ঢেউয়ের পর ঢেউ। সবুজের ঢেউ। আপনি আছেন কার্শিয়াংয়ের বিখ্যাত মকাইবাড়ি টি এস্টেটে। ৪,৬০০-৪,৯০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের স্তরে স্তরে চা-বাগানের বিস্তার। ভারতের অন্যতম প্রাচীন টি এস্টেট মকাইবাড়ি। ১৮৫৯ সালে বাঙালি টি প্ল্যান্টার গিরীশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে মকাইবাড়ি টি এস্টেটের প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। বিশ্বের প্রথম চায়ের ফ্যাক্টরিটি তৈরি হয়েছিল এই মকাইবাড়ি এস্টেটেই। মকাইবাড়ির অর্গানিক টি বা জৈব চায়ের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। হিমালয়ের কোলে মকাইবাড়ির সবুজ চা-বাগানের মধ্যেই অতিথিদের জন্য থাকার ব্যবস্থা আছে।
চা-বাগিচা অরণ্য পাহাড় নদী বণ্যপ্রাণ
পাহাড়ের স্তরে স্তরে ৫৫০ একর জুড়ে চায়ের বাগান। আরও ১,১০০ একর জুড়ে অরণ্য। টি এস্টেটের মধ্যে খুব সচেতন ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে এই বনাঞ্চল। এস্টেটের কোনও প্রান্তে চা-বাগানের ঢেউ মিশেছে দিগন্তে, অন্য কোনও দিকে বাগানের ঢেউ থেমেছে জঙ্গল প্রান্তে। এস্টেটের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে তিনটি নদী, বালাসন নদীতে মিশেছে এই তিনটি নদী। প্রায় ২০ প্রজাতির বাঁশ জন্মায়। বার্চ, ম্যাপেল, ফার্ন, লিচেনের মতো উদ্ভিদ রয়েছে মকাইবাড়ির অরণ্যে। লক্ষ্য করলে অর্কিডের সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে।
মকাইবাড়ি এস্টেটের অরণ্যে রয়েছে লেপার্ড, হরিণ, বুনো শুয়োর, বাঁদর। অন্তত ৩০০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে এস্টেটের বাগিচা ও অরণ্যে। নানা প্রজাতির প্রজাপতিরও দেখা পাওয়া যায় এখানে। দেখা মিলবে নানা কীট-পতঙ্গের।
পরিবেশবান্ধব পর্যটন ভাবনা
‘হেলদি সয়েল হেলদি ম্যানকাইন্ড’ মকাইবাড়ি টি এস্টেটের বিশিষ্ট স্লোগান। মকাইবাড়ি টি এস্টেটের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এস্টেটের মোট জমির ৭০ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে বনাঞ্চলের জন্য। পাখি ও কীট-পতঙ্গকেও বাগান ও অরণ্যের গুরুত্বপূর্ণ রক্ষক বলে মনে করা হয়। পাহাড়, নদী, অরণ্য, চা-বাগিচা, ফুল, পাখি, বন্যপ্রাণী ইত্যাদির একটি সুসমন্বিত পরিবেশ গড়ে উঠেছে মকাইবাড়ি টি এস্টেটে। সেই পরিবেশের মধ্যেই ভ্রমণের ব্যবস্থা। এস্টেটের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে সাতটি গ্রাম। এই গ্রামগুলিতে বসবাসকারি দেড় হাজারের বেশি মানুষ নানা ভাবে মকাইবাড়ি টি এস্টেটের ওপর নির্ভরশীল। এস্টেট-লাগোয়া গ্রামগুলিতে থাকার জন্য রয়েছে হোমস্টে। একেবারে প্রকৃতির মধ্যে থাকার ব্যবস্থা।
থাকার ব্যবস্থা
‘ভলেন্টিয়ার ইন মকাইবাড়ি’ নামের একটি প্রকল্পের আওতায় মকাইবাড়ি টি এস্টেটে অতিথিদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এস্টেটের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে সাতটি গ্রাম। এই গ্রামগুলিতে বসবাসকারি দেড় হাজারের বেশি মানুষ নানা ভাবে মকাইবাড়ি টি এস্টেটের ওপর নির্ভরশীল। এস্টেট-লাগোয়া গ্রামগুলিতে থাকার জন্য রয়েছে হোমস্টে। একেবারে প্রকৃতির মধ্যে থাকার ব্যবস্থা। জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত নানা খাদ্য-উপকরণ ব্যবহৃত হয়ে থাকে খাদ্যের বিভিন্ন পদে।
কী কী করতে পারেন
বিস্তৃত চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে বেড়াতে পারেন। চা-পাতা তোলার পদ্ধতি দেখতে পারেন কাছ থেকে। মকাইবাড়ির চায়ের ফ্যাক্টরিটি পরিদর্শন করতে পারেন। পৃথিবীর প্রথম চায়ের ফ্যাক্টরি এটি। কাঠ, বাঁশ ও কাস্ট আয়রন দিয়ে দেড় শতক আগে তৈরি এই ফ্যাক্টরি এখনও সমান কার্যকর। ফ্যাক্টরিতে চা তৈরির প্রক্রিয়া দেখতে পারেন। টি মাস্টারের সঙ্গে টি টেস্টিংয়ে অংশ নিতে পারেন। চায়ের বাগানে পাখি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। জঙ্গলে ট্রেক করতে পারেন। চাইলে সঙ্গে গাইড পাবেন। গ্রামের উৎসব-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারেন।
বেড়িয়ে নিন কার্শিয়াং
মকাইবাড়ি টি এস্টেটে থেকেই বেড়িয়ে নিতে পারেন কার্শিয়াং শহরটি। মকাইবাড়ি টি এস্টেটের কাছেই রয়েছে সুন্দর ভিউপয়েন্ট ঈগলস ক্রেগ। হেঁটে উঠতে হবে ভিউপয়েন্ট। উপরে রয়েছে সুন্দর একটি পার্ক।
কার্শিয়াংয়ে বেড়াতে গেলে ডাউ হিলে তো যেতেই হবে। যে-সব পাহাড়ের ওপর কার্শিয়াং শহরটির বিস্তার, তার একটি ডাউ হিল। এখানে দেখবেন ফরেস্ট মিউজিয়াম, ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীর স্কুল, পার্ক। ডাউ হিলের রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়াতেও ভালো লাগবে।
যাবেন গিদ্দাপাহাড় ভিউপয়েন্টে। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং নীচের উপত্যকার দৃশ্য মন কেড়ে নেবে। গিদ্দাপাহাড়েই রয়েছে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ও তাঁর অগ্রজ শরৎ চন্দ্র বসুর স্মৃতিধন্য মিউজিয়াম। বাড়িটি কিনেছিলেন শরৎ চন্দ্র বসু। পরে শরৎ চন্দ্র বসু এবং সুভাষ চন্দ্র বসুকে গৃহবন্দি করে রেখেছিল ব্রিটিশ সরকার। পরবর্তীকালে বাড়িটিকে সংগ্রহশালায় রুপান্তরিত করা হয়।
কার্শিয়াংয়ের টয়ট্রেন স্টেশন চত্বরে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে মিউজিয়ামটি ঘুরে দেখতে পারেন। কার্শিয়াং স্টেশন থেকে টয়ট্রেনে চেপে খানিকটা বেড়িয়ে আসতে পারেন।
কার্শিয়াং থেকে দার্জিলিংয়ের দিকে খানিকটা এগিয়ে যেতে পারেন সেন্ট মারিস হিলে। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই অসাধারণ। পাহাড়ের উপরে রয়েছে সেন্ট জনস চার্চ।
সারাদিন দার্জিলিং বেড়িয়ে রাতে ফিরে আসতে পারেন মকাইবাড়ির শান্ত পরিবেশে। মকাইবাড়ি টি এস্টেট থেকে দার্জিলিংয়ের দূরত্ব ৩৭ কিলোমিটার।
যাওয়ার পথ
এন জে পি স্টেশন থেকে কার্শিয়াং ৩৮ কিলোমিটার। পুরো গাড়ি ভাড়া করে বা শেয়ার গাড়িতে কার্শিয়াং চলে আসতে পারেন। কার্শিয়াং বাজার অঞ্চল থেকে মকাইবাড়ি টি এস্টেট আড়াই কিলোমিটার।
হোমস্টে বুকিংয়ের জন্য
মকাইবাড়ি টি এস্টেট-সংলগ্ন হোমস্টে বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন আতিথেয়তা বিভাগের প্রধান নয়ন লামার সঙ্গে। যোগাযোগের নম্বরঃ ৯৮৩২৪-৪৭৭৭৪, ৮৯০৬৫-১৫৮৮৮।