দিনের প্রথম আলোয় ভি আই পি রোডের রাস্তাটি এই মুহূর্তে বেশ মায়াবী। আমরা বিমানবন্দরের পথে। যাত্রার সূচনা ঘটে গেছে সাতসকালে। সকাল ৯-১০ এর বিমানের টিকিট। যাচ্ছি ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’র দেশে। তপন সিংহ পরিচালিত ছবি ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৯ সালে। তারও আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কাকাবাবু সমগ্র’র অন্তুর্ভুক্ত একই নামের রোমাঞ্চকর কাহিনিটি বাঙালির চোখে আন্দামানের মায়াকাজল এঁকে দিয়েছিল। সে ছবিতে সুদূরের ডাক। রোমাঞ্চের সুর। এখন অবশ্য প্রবল বৃষ্টি-বাদল ছাড়া বছরভরই আন্দামান ভ্রমণ চলে। আমাদের প্রথম যাত্রা। আজ ২০২২-এর ১৭ ডিসেম্বর।
কলকাতার বন্দর থেকে পোর্টব্লেয়ারের বিমান উডল সময়মতোই। খানিক পরে বিমান বঙ্গোপসাগরের আকাশে। ক্রমে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ স্পষ্ট হয়ে উঠল। কী আয়াসে ‘সেই’ কালাপানি পার হওয়া যায় এখন। জাহাজেও যাওয়া যায়। কলকাতা, চেন্নাই, বিশাখাপত্ত্নম থেকে পোর্টব্লেয়ারের জাহাজ ছাড়ে। আবার পোর্টব্লেয়ার থেকে মূল ভূখণ্ডের এই তিন বন্দরে ফেরা যায় জাহাজে। তবে সময়সাপেক্ষ ও খানিকটা ধকলের যাত্রা বলে আজকাল সাধারণত বিমানযোগেই আন্দামানে যান ভ্রমণার্থীরা।
পোর্টব্লেয়ারের বীর সাভারকর বন্দরে বিমান নামল বেলা সাড়ে ১১ টায়। বাইরে এসে হোটেলের পাঠানো গাড়িতে উঠে বসা গেল। আস্তানা বুক করা ছিল পোর্টব্লেয়ারের হেউইজ নামের একটি হোটেলে। হোটেলের অবস্থানটি সুবিধাজনক। অ্যান্থ্রোপলিজাক্যাল মিউজিয়াম, মেরিন মিউজিয়াম, আবেদীন বাজার, এগুলো হোটেলটির কাছাকাছি।
আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী এই পোর্টব্লেয়ার শহরটির নামের সঙ্গে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট আর্চিবল ব্লেয়ারের নাম যুক্ত হয়ে আছে। আঠেরশ শতকের শেষের দিকে আন্দামানে জরিপের কাজে গিয়েছিলেন আর্চিবল ব্লেয়ার। ছিলেনও বেশ কিছুদিন সেখানে। আর্চিবল দক্ষিণ আন্দামানে খুঁজে পেলেন সমুদ্রবন্দর গড়ার উপযুক্ত প্রাকৃতিক একটি অবস্থান। আর্চিবল জায়গাটির নাম দিয়েছিলেন পোর্ট কর্নওয়ালিস। পরে আর্চিবল ব্লেয়ারের সম্মানে সেই জায়গার নামকরণ করা হয় পোর্ট ব্লেয়ার (পোর্টব্লেয়ার)। প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গের ডায়মন্ড হারবার ও সংলগ্ন হুগলি নদী নিয়েও এই আর্চিবল ব্লেয়ার জরিপের কাজ করেছিলেন।
সেলুলার জেলের অন্ধকার কুঠুরি
বিকেলে গেলাম সেলুলার জেল দেখতে। এখন আর জেল নয়। দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষণশালা। ভারতের ঔপনিবেশিক আঁধার বন্দি হয়ে আছে যেন এখানে, এখনো। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভয়ংকর সব স্মৃতি উস্কে দেওয়া কমপ্লেক্সটির সঙ্গে এখনো জেলের তকমাটিই সেঁটে আছে।সাতটি উইং, মাঝে একটি টাওয়ার। এই টাওয়ার থেকে গোটা কমপ্লেক্সের ওপর নজরদারি করা হত। ছোট ছোট খুপরি ঘর। একট সেলের দরজা আরেকটির উল্টোদিকে। বন্দিদের মধ্যে যোগাযোগ রদের ব্যবস্থা।
দেশের স্বাধিনতা দেখতে চাওয়া কী অসীম সাহসী সব মানুষ বছরের পর বছর এমনকী আমৃত্যু ওই কুঠুরিগুলির মধ্যে নির্মম অত্যাচার সহ্য করেছেন। আত্মহ্ত্যা করেছেন, পাগল হয়ে গিয়েছিলেন কতজন। বিদ্রোহীদের জন্য ছিল ফাঁসিকাঠ। সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে কত মৃতদেহ। একসঙ্গে তিন জনকেও ফাঁসি দেওয়া হত। অপরাধীদের দ্বীপান্তরের নামে সেলুলার জেল নির্মাণের কাজ শেষ হয় ১৯০৬ সালে। আসলে তো ছিল ইংরেজ শাসকদের কাছে বিপজ্জনক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের লোকচক্ষুর অন্তরালে পাঠিয়ে দেওয়ার কৌশল। সেন্ট্রাল টাওয়ারের নীচে রক্ষিত তালিকায় ৫৮৫ জন বন্দি স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম পাওয়া যায়। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এঁদের মধ্য চারশতাধিকই বাঙালি।
কুঠুরিগুলো কী নির্মম, দেখলে এখনো যেন একটা সন্ত্রাস তৈরি হয়। কী এক অন্ধকার জমাট বেঁধে রয়েছে ওই কুঠুরিগুলির মধ্যে।। স্থির ও চলমান ছবিতে কতবার দেখেছি এই কারাগারটি। কিন্তু আজ এই গোধূলীর আগে আগে সেলের মধ্যেকার অন্ধকার যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। চাবুকের শব্দ, পায়ের শিকলের শব্দ…
আদিগন্ত নীল সমুদ্র, সোনালী সৈকত, সমুদ্রের তীর ঘেঁসে সবুজের জোয়ার। এক আনাবিল প্রকৃতি আন্দামানের। সমুদ্রের তল থেকে উঠে আসা পর্বতমালা। সারা আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জটাই তো তাই। আমরা জলের উপরিভাগটা দেখি। সে বড় সুন্দর। প্রকৃতি-সৃষ্ট অবাক করা সব দ্বীপ, তার বালুবেলা, নারকোল গাছের সারি, প্রবাল প্রাচীর। আন্দামান ভ্রমণে শরীর-মন বিশুদ্ধ হয়। তবু ফিরে ফিরে মনের মধ্যে উঁকি দেয় সেলুলার জেলের কুঠুরি।
সন্ধ্যায় কম্পাউন্ডের মধ্যে আলো ও ধ্বনিতে সেলুলার জেলের ইতিহাস ও বর্তমান প্রদর্শিত ও বিবৃত হয়। ৬ টায় হিন্দিতে, সোয়া ৭ টায় ইংরেজিতে। তথ্য সংগ্রহের জন্য মিউজিয়াম আছে, ছবির গ্যালারি আছে। পোর্টব্লেয়ারের এস টি এস বাস টার্মিনাস বা আবেদীন বাজার অঞ্চল থেকে সেলুলার জেল আড়াই কিলোমিটার। আবেদীন বাজার থেকে অটোরিক্সা, ট্যাক্সি পাওয়া যায় যাওয়ার জন্য।
তিরঙ্গা পয়েন্টের পতাকা
আমাদের সঙ্গে গাড়ি ছিল। সেলুলার জেল থেকে বেরিয়ে গেলাম ‘ফ্ল্যাগ পয়েন্ট’ বা ‘তিরঙ্গা পয়েন্টে’। সমুদ্রের তীরে আলোয় ঝলমল করছে জায়গাটা। সেলুলার জেল থেকে মেরিন পার্ক ও রাজীব গান্ধি ওয়াটার স্পোর্টস কমপ্লেক্স হয়ে ‘তিরঙ্গা পয়েন্ট’ আসতে হয়। বড় বড় ইমারত চোখে পড়ছিল সৈকতের উল্টোদিকে। অফিস-কাছারি বলে মনে হল।
ব্রিটিশদের ওই দুর্গসম সেলুলার জেলের নাকের ডগায় ১৯৪৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর তারিখে ভারতের মাটিতে প্রথম দেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, ১৯৪২ সালে ইংরেজদের তাড়িয়ে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দখল নেয় জাপান। সেই অবসরে নেতাজির পোর্টব্লেয়েরে ভারতের পতাকার উত্তোলন। ১৯৪৫ সালে জাপান-সহ অক্ষশক্তির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটার পরে ব্রিটিশরা ফের দ্বীপপুঞ্জে গেড়ে বসে। পোর্টব্লেয়েরের এই জায়গাটিতেই, মানে এই তিরঙ্গা পয়েন্ট বা ফ্ল্যাগ পয়েন্টে পতাকা উড়িয়েছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু। এখন সমুদ্রের বাতাসে পতপত করে উড়ছে জাতীয় পতাকা।
জমজমাট করবিনস কোভ বিচ
সন্ধ্যার পরে গেলাম করবিনস কোভ বিচে। যাওয়ার রাস্তাটা খুব সুন্দর। রাস্তার দু’দিকে সবুজের সমারোহ। পোর্টব্লেয়ার শহর থেকে করবিনস বিচ ৬-৭ কিলোমিটার। দীর্ঘ সৈকত। হোটেল, রেস্তোরাঁ, বার, রঙিন আলো, সবমিলিয়ে সন্ধ্যার করবিনস সৈকত জমজমাট। সোনালী সৈকত বরাবর নারকোল গাছের সারি। বিচে আরামকেদারায় বসে বিশ্রাম নেওয়া যায়। চেয়ারের জন্য ভাড়া লাগে। দিনে রৌদ্রস্নান চলতে পারে। সমুদ্রস্নানের জন্যো সৈকতটি বেশ জনপ্রিয়। হেনরি ফিশার করবিন সাহেবের নামানুসারে সৈকতের নাম। জেট স্কি, স্পিড় বোট রাইডের মতো ওয়াটার স্পোর্টসের ব্যবস্থা আছে। বিকেল সাড়ে ৪টে পর্যন্ত জলক্রীড়া চালু থাকে।
সকালে কলকাতা থেকে যাত্রা করেছি। এবার একটু বিশ্রামের দরকার। করবিন কোভের সৈকত থেকে হোটেলে ফিরলাম। কাল যাব হ্যাভলক।
হেডার ফটো সৌজন্যঃ দি টাইমস অফ ইন্ডিয়া
উপর থেকে দ্বিতীয় ফটোঃ পিক্সহাইভ ডট কম
অন্যান্য সবক’টি ফটোঃ লেখক
অন্যান্য সবক’টি ফটোঃ লেখক
3 Comments
অনবদ্য
[…] পারেন নীচের লিঙ্কগুলিতে প্রথম পর্বঃ https://torsa.in/in-the-land-of-the-king-of-the-green-island-part-1/ দ্বিতীয় পর্বঃ […]
[…] পারেন নীচের লিঙ্কগুলিতে প্রথম পর্বঃ https://torsa.in/in-the-land-of-the-king-of-the-green-island-part-1/ দ্বিতীয় পর্বঃ […]