Follow us
Search
Close this search box.

দু’দিনের ছুটিতে গোপগড় পাথরা কর্ণগড় পরিমল কানন গনগনি

দু’দিনের ছুটিতে গোপগড় পাথরা কর্ণগড় পরিমল কানন গনগনি

মেদিনীপুর শহরটিকে কেন্দ্র করে স্বল্প সময় ও খরচে বেড়িয়ে নেওয়া যায় চমৎকার কয়েকটি জায়গা। কীভাবে বেড়াবেন, কোথায় থাকবেন, সে-সব খুঁটিনাটি তথ্য-সহ ভ্রমণ পরিকল্পনাটি তৈরি করেছেন তুষার পাত্র।

রবিবার ছুটির দিন হয়ে থাকলে শনিবার দিনটিকে যুক্ত করে নিলেই চলবে। শনি, রবি দু-দিনই ছুটি যাঁদের, তাঁদের তো আরও সুবিধা। আলাদা করে ছুটি নেওয়ার দরকার হচ্ছে না। অনায়াসে এক রাত দু-দিনের একটা সফরে বেড়িয়ে পড়া যায়। কাছেপিঠেই। তা বলে ভ্রমণের আনন্দে খামতি হবে না। বেশ উপভোগ করবেন। নিজেদের গাড়িতে বা গাড়ি ভাড়া করে বেড়িয়ে আসা যায়। ট্রেন তো আছেই। সাঁতরাগাছি থেকে রূপসীবাংলা এক্সপ্রেসে রওনা দিন মেদিনীপুরের উদ্দেশে। সকাল ন’টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন মেদিনীপুর স্টেশনে। অন্যথায় হাওড়া থেকে লোকাল ট্রেনে মেদিনীপুর। কলকাতা থেকে মেদিনীপুরের দূরত্ব ১২৮ কিলোমিটার।

এক রাত্রি দু’দিনে মেদিনীপুরকে কেন্দ্র করে অনায়াসে বেড়িয়ে নেওয়া যায় যায় গোপগড়, পাথরা, কর্ণগড়, পরিমল কানন ও বাংলার ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’ নামে খ্যাত গনগনি। সফরসূচিটি কেমন হতে পারে দেখা যাক। খরচ পকেট ফ্রেন্ডলি।

গন্তব্যঃ গোপগড়,পাথরা, কর্ণগড়, আড়াবাড়ি, পরিমল কানন ও গণগনি।

কীভাবে বেড়াবেন

মেদিনীপুর শহরে থাকতে চাইলে বিভিন্ন মান ও মূল্যের হোটেল ও লজ পাবেন। শহর থেকে দূরে নিরিবিলি পরিবেশে থাকতে চাইলে পশ্চিমবঙ্গ বনোন্নয়ন এজেন্সির (ডব্লিউ বি এস এফ ডি এ) গোপগড় ইকো পার্কের কটেজ বুক করে নিতে পারেন।

মেদিনীপুর শহর পেরিয়ে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় ও গোপ কলেজকে ডানদিকে রেখে গাড়ি থামবে গোপগড় ইকো পার্কের সামনে (ধরে নেওয়া গেল গোপগড় ইকো পার্কের কটেজে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয়েছে)। থাকার ব্যবস্থা ও চারপাশের পরিবেশ চমৎকার।

পথে প্রাতরাশ না হয়ে থাকলে গোপগড় ইকো পার্কের রেস্তোরাঁয় প্রাতরাশের পরে বেরিয়ে পড়ুন। গন্তব্য পাথরা। মেদিনীপুর শহর থেকে ১২ কিলোমিটার রাস্তা। যদি ট্রেনে মেদিনীপুর আসেন, তাহলে স্টেশন চত্বর থেকেই গাড়িভাড়া করুন এবং ওইদিনই পাথরা যাবেন, সেকথা গাড়িচালককে জানিয়ে রাখুন। পরের দিন কর্ণগড়, আড়াবাড়ি, পরিমল কানন হয়ে গণগনি যাওয়া এবং গড়বেতা বা মেদিনীপুর স্টেশনে ড্রপ পর্যন্ত ভাড়া ঠিক করে নিন।

পাথরা

মেদিনীপুর শহর ছাড়িয়ে আমতলা, হাতিহলকা গ্রাম পেরিয়ে আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন পাথরা। চলার পথে রাস্তার দু’পাশে সবুজের আয়োজন দেখে মন ভালো হয়ে যাবে। কাঁসাই নদীর তীরে মন্দিরময় পাথরা গ্রাম। ঘুরে দেখুন নবাব আলিবর্দী খাঁর আমলে বিদ্যানন্দ ঘোষাল ও তাঁর উত্তরসূরিদের উদ্যোগে নির্মিত মন্দিরগুলি। কিছু মন্দির এখন প্রকৃতপক্ষে ধ্বংসাবশেষ। পাথরায় শিবমন্দির, নবরত্ন মন্দির, রাসমঞ্চ, শীতলামন্দির-সহ প্রায় ৩৯টি মন্দির আছে। পুরনো কাছারিবাড়িটিও দেখা যায়। শীতলা মন্দিরে দেবী শীতলা পূজিত হন এখনও।

তবে বেশিরভাগ মন্দিরই বিগ্রহহীন। সব মন্দিরের গায়েই কিছু না কিছু টেরাকোটার কাজ লক্ষ্য করা যায়। কিছু মন্দিরে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সাইনবোর্ড চোখে পড়বে বটে, তবে বলতেই হয়, পাথরার বেশিরভাগ মন্দিরের অবস্থা ভালো নয়। এই মন্দিরগুলো বাংলার মন্দির নির্মাণশৈলীর অমূল্য ঐতিহ্য বহন করছে। একজন অঞ্চলিক অবসরপ্রাপ্ত স্কুল পিওন, ইয়াসিন পাঠান সত্তরের দশকে পাথরার মন্দিরগুলিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য একটা অভিযান শুরু করেছিলেন। তাঁর নিরলস প্রয়াসে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া পাথরার ১৮টি মন্দির সংস্কার করে।

গোপগড়

পাথরা বেড়িয়ে গোপগড়ে কংসাবতীর নদীর তীরে গোপগড়ে ফিরে আসুন। মধ্যাহ্নভোজনের পরে খানিকক্ষণের বিশ্রাম। তারপর বেড়িয়ে দেখুন গোপগড় ইকো পার্ক। মেদিনীপুর শহরের উপকণ্ঠে ৬৪ হেক্টর জমিতে রাজ্যের বনবিভাগের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে গোপগড় ইকো পার্ক। প্রকৃতির মধ্যে বনভোজন, বিনোদন, বেড়ানোর আদর্শ ঠিকানা এটি। কটেজের সামনেই রয়েছে একটি ওয়াচটাওয়ার। নজরমিনার থেকে ওই কাঁসাই নদীর দৃশ্য অপরূপ। পার্কের মধ্যে রয়েছে নানা প্রজাতির গোলাপের বাগান।আকর্ষণ। পার্কের এক প্রান্তে একটি হেরিটেজ ভবনের ধ্বংসাবশেষ গোপগড়ের প্রাচীন ইতিহাসের স্মারক।

কর্ণগড়

পরদিন সকালে গোপগড়কে বিদায় জানিয়ে রওনা দেওয়া যাক ১২ কিলোমিটার দূরের কর্ণগড়ের উদ্দেশে। ৬০ নং জাতীয় সড়ক ধরে গাড়ি পৌঁছাবে ভাদুতলায়। বাঁদিকের রাস্তা গেছে লালগড়, ডানদিকের রাস্তা কর্ণগড়ে। চুয়ার বিদ্রোহের স্মৃতি বিজড়িত রানী শিরোমণির কর্ণগড়। এখানকার বিশেষ আকর্ষণ মহামায়ার মন্দির আর রানী শিরোমনির গড়ের ধ্বংসাবশেষ। মন্দিরে প্রবেশ করে দেবী দর্শন করুন। মন্দির চত্বর ঘুরে দেখুন। গাছের ছায়ায় বসে কিছুটা সময় কাটান। অনুভব করবেন অদ্ভুত এক প্রশান্তি। দুপুরে মন্দিরে অন্নভোগ খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আগেই নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে কুপন সংগ্রহ করে রাখবেন। দুপুরের খাওয়ার পরে কর্ণগড়কে বিদায় জানিয়ে চলুন আড়াবাড়ির পথে।

আড়াবাড়ি

কর্ণগড় থেকে ভাদুতলা, গোদাপিয়াশাল, শালবনী হয়ে ৬০ নং জাতীয় সড়ক ধরে গাড়ি ছুটবে সবুজের বুক চিরে। শালবনী থেকে কিছুটা এগোলেই শুরু হবে আড়াবাড়ির জঙ্গল। জাতীয় সড়কের ওপরেই মূল প্রবেশপথ। আড়াবাড়ির জঙ্গল প্রধানত শালের জঙ্গল। একটু এগোলেই চোখে পড়বে বনবিভাগের কর্মকান্ড। রয়েছে বিশাল এক নার্সারি। সরকার ও আঞ্চলিক মানুষের যৌথ পরিকল্পনায় আড়াবাড়ির বনোন্নয়নের মডেল সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে। ‘ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী পুরস্কার’ ও আন্তর্জাতিক ‘পলগেটি পুরস্কার’ রয়েছে আড়াবাড়ির ঝুলিতে। ঝটিকা সফরে আড়াবাড়িকে বিদায় জানিয়ে এবার চলুন পরিমল কাননের উদ্দেশে।

পরিমল কানন

দক্ষিণ-পূর্ব রেলের চন্দ্রকোনা রোড রেলস্টেশন আর চন্দ্রকোনা বাসস্ট্যান্ড থেকে দশ মিনিটের হাঁটাপথ। আড়াবাড়ি থেকে ৬ কিলোমিটার। ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের ওপরেই পরিমল কানন। ত্রিশ হেক্টর এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে দারুন এক বিনোদন পার্ক। জনপ্রতি ১৫ টাকার টিকিট কেটে ঢুকে পড়ুন পার্কে। পিকনিকের স্থায়ী শেড থেকে শুরু করে সব সুবিধাই মজুদ এখানে। শীতে জায়গা পাওয়া মুশকিল। পিকনিক ও বেড়ানোর জন্য চমৎকার পার্কটি। সঙ্গে ছোটরা থাকলে তো কথাই নেই। কীভাবে সময় কেটে যাবে বুঝতেই পারবেন না। সামনেই গোটা তিনেক ফুলের বাগান। পার্কের মধ্যে রয়েছে বনলতা রেস্টুরেন্ট। চাইলে দুপুরে খাবার অর্ডার দিয়ে রাখতে পারেন। বাচ্চাদের পাখির খাঁচার সামনে ছেড়ে দিয়ে আপনারা বরং একটু জিরিয়ে নিন শালবনে। বসার জন্য বেঞ্চ আছে। পার্কে বসে শাল-জঙ্গলের এমন মনোরম দৃশ্য সহজে চোখে পড়বে না।

এবার জঙ্গলের রাস্তা ধরে চলে আসুন লেকের ধারে।। সামনেই রঙিন মাছের অ্যাকোয়ারিয়াম। পাঁচ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে একবার ঘুরে আসুন। হাঁটতে হাঁটতে চলে যান ভেষজ উদ্যানে। উপকারী সব গাছগাছড়া রয়েছে এই উদ্যানে। এরপর ফুলের বাগানগুলো দেখুন। থরে থরে সাজানো মরশুমী সব ফুলের মেলা সেখানে। জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে একটি পুষ্প প্রদর্শনী হয় এখানে। দেখবার মতো। বিশাল এলাকা জুড়ে বৃত্তাকার গোলাপের বাগানটি দেখে তাক লেগে যাবে। রংবেরঙের গোলাপের এই বাগানটি পার্কের বিশেষ আকর্ষণ। ওখান থেকে ফেরার পথে চোখে পড়বে একটি নিশ্চল টয় ট্রেন। তা বলে লোক ওঠে না, এমনটি নয়। ভিতরে সারি সারি ফাস্ট ফুডের ষ্টল রয়েছে যে। খাবারদাবার সঙ্গে থাকলে বসে পড়ুন কোনো একটা বাগানে। নইলে সোজা রেস্তোরাঁয়। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে গুটি গুটি পায়ে বেড়িয়ে পড়ুন পার্ক থেকে। জানিয়ে রাখি, দক্ষিণবঙ্গের সেরা উদ্যানের তকমাটি রয়েছে এই পরিমল কাননের ঝুলিতেই ।

গনগনি

শেষ লপ্তে গনগনি। শিলাবতী নদীর খাতে বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। পরিমল কানন থেকে বেরিয়ে আমরা রওনা দেব গড়বেতার উদ্দেশে। চন্দ্রকোনা রোড স্টেশন থেকে গড়বেতা ১৬ কিলোমিটার। দু’পাশে নয়নাভিরাম সবুজের মধ্যে দিয়ে গাড়ি ছুটবে ৬০ নং জাতীয় সড়ক ধরে। গড়বেতায় পৌঁছে সর্বমঙ্গলা মন্দির দর্শন করে নিতে পারেন প্রথমে। তারপর সোজা চলে আসুন গনগনি। শিলাবতী নদীর পাড়ের ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা ক্ষয়ের ফলে তৈরি হয়েছে নানা আকৃতি। সূর্যের আলো পড়লে লালমাটি যেন জ্বলতে থাকে। প্রকৃতির এক অদ্ভুত সৃষ্টি এই গনগনি। নীচে কুল কুল শব্দে শিলাবতী বয়ে চলেছে। চাইলে পা ডুবিয়ে আসতে পারেন। হাতে সময় থাকলে সূর্যাস্তের গনগনি দেখুন। মনে ধরা থাকবে সে দৃশ্য।

আর দেরি নয়, এবার বাড়ি ফেরার পালা। নিজেদের গাড়ি সঙ্গে থাকলে সোজা বাড়ির পথে রওনা দিন। ট্রেনে যেতে চাইলে গড়বেতা স্টেশনে থেকে ৫:৫১ মিনিটের পুরুলিয়া-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ধরুন। আরো তাড়াতাড়ি করতে চাইলে ৩:৪০ মিনিটের ভজুডি-শালিমার আরণ্যক সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ধরতে পারেন। এই দুটো ট্রেন না পাওয়া গেলে মেদিনীপুর স্টেশান থেকে হাওড়া লোকাল ধরুন। নিজেদের গাড়ি থাকলে সরাসরি যাত্রা। রাতে আপনারা নিজগৃহে।

গোপগড় ইকো-ট্যুরিজম সেন্টারের এসি কটেজের ভাড়া ১০০০ টাকার মধ্যে। অনলাইনে বুক করা যাবে এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে : www.wbsfda.org . সেন্টার ইনচার্জের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর- 9732677182। চাইলে পরিমল কাননের কটেজে থাকা যায়। সেন্টার ইনচার্জের ফোন নম্বরঃ 9732677182।

বনোন্নয়নের কটেজে থাকার ব্যাপারে তথ্যের জন্য ফোন করতে পারেন এই নম্বরেওঃ 8337066882

ফটোঃ লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *