Follow us
Search
Close this search box.

শীতের ঘাটশিলা

শীতের ঘাটশিলা

ঘাটশিলায় ঢুকে পড়লেই একটা আরণ্যক আঘ্রাণ আলতো করে জড়িয়ে ধরে। ছোটনাগপুর মালভূমির নিম্নাংশে ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলায় টিলা-পাহাড়, আমলকী জারুল শিমূল মহুল বনে ঘেরা জায়গাটায় ঘাট আর শিলার অঙ্গাঙ্গী এক ধারা বয়ে চলেছে। সুবর্ণরেখার ধারা। নদীধারায় উঁচিয়ে থাকে অসংখ্য শিলাখণ্ড। পাহাড় জঙ্গল নদীর অমোঘ টানে ‘আরণ্যক’-এর স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাসা বেঁধেছিলেন ওখানেই, সুবর্ণরেখার তীরে। ১৯৫০ সালে ওই গৃহেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রকৃতই প্রকৃতির সন্তান, অপামর বাঙালির চোখে নিসর্গের মায়া-কাজল এঁকে দেওয়া বিভূতিভূষণ।

কিসের টানে ঘাটশিলা? অরণ্য পাহাড় নদী ঝর্ণা হ্রদ; বাংলাভাষী হিন্দিভাষী আদিবাসী; পরব মেলা মাদলের বোল, এ-সব নিয়ে ঘাটশিলা। সময় এগিয়েছে। নগরায়ণের ছোঁয়া লেগেছে ঘাটশিলাতেও। তা বলে হারিয়ে যায়নি সুবর্ণরেখা। হেঁটে হেঁটে কোথায় কোথায় বেড়াতেন বিভূতিভূষণ। ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের সেই ফুলডুংরি পাহাড়, এখনো যেতে পারেন সেই পাহাড়ে। এগিয়ে দেবে ভাড়ার গাড়ি বা অটোরিক্সা। ঘাটশিলা স্টেশন থেকে ফুলডুংরি পাহাড় ৩০-৪০ মিনিটের হাঁটাপথ।

ভালো কথা, ঘাটশিলা বেড়ানোর সেরা সময় এই শীতকাল। শীতের ঘাটশিলার রুখুসুখু পরিবেশ একটা অন্য সৌন্দর্য তৈরি করে। গাছের পাতা শুকোয়, পাতা ঝরে। মাটি রুক্ষ হয়। ঝর্ণার উদ্দাম রূপটি চাক্ষুষ করা যাবে না শীতে। বুরুডি লেকের কাছাকাছি জঙ্গল প্রান্তে বাসাদেরা গ্রাম। সেখান থেকে জঙ্গলের পথ ধরে ধারাগিরি ঝর্ণা। শীতে ঝর্ণা ক্ষীণকায়া। তবে বনপথ ধরে ঝর্ণা পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া ও ঘাটশিলার জঙ্গলকে কাছ থেকে দেখার আনন্দটি কোনও অংশে কম হয়ে যায় না। বর্ষার ধারাগিরির আবার অন্য চেহারা, ভিন্নতর চরিত্র।

দলমা পাহাড়ে ঘেরা বুরুডি ড্যাম ও জলাধারের শান্ত সৌন্দর্যময় পরিবেশ নিশ্চিতভাবে বলা যায় ভালো লাগবে। বোটিংয়ের ব্যবস্থা আছে। জলাধারের মাঝামাঝি অবস্থান থেকে চারপাশটা স্বপ্নের মতো মনে হয়।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িটি এখন একটি সংগ্রহশালা। নাম ‘গৌরীকুঞ্জ’। লেখকের প্রথমা স্ত্রী গৌরীদেবীর নামে সংগ্রহশালার নামকরণ হয়েছে। লেখকের ব্যবহার করা নানা সামগ্রী দেখা যায় এখানে।। গৌরীকুঞ্জের দেওয়ালে ঝাড়খণ্ডের জনজাতির পট শিল্প ‘পটগার’ শৈলীতে লেখকের জীবনের টুকরো টুকরো নানা ছবি অঙ্কিত হয়েছে। ‘অপুর পাঠশালা’ নামে একটি স্কুলও চলে গৌরীকুঞ্জে।

গৌরীকুঞ্জ

গৌরীকুঞ্জ থেকে নদীতীর ধরে খানিকটা নেমে গেলে রাতমোহনা। রাতমোহনা কার্যত একটি ভিউ পয়েন্ট। রাতমোহনা থেকে সুবর্ণরেখায় সূর্যাস্তের জাদুকরী দৃশ্য বহুদিন স্মৃতিতে জাগ্রত হয়ে থাকবে। আর মৌভাণ্ডার সেতু থেকে সকালের সুবর্ণরেখা, আহা, সচরাচর সে দৃশ্য দেখা যায় না। মৌভাণ্ডার এলাকায় গড়ে উঠেছে সুপরিকল্পিত টাউনশিপ।

মৌভাণ্ডার টাউনশিপ বেড়িয়ে কপ্রিঘাট পাহাড়ের মাথায় রঙ্কিণী দেবীর মন্দির। ঘাটশিলা থেকে জাদুগোড়া ২২ কিলোমিটার। জাদুগোড়া বেশ জমজমাট শহর। এই জাদুগোড়ার খনি থেকেই ভারতে প্রথম ইউরেনিয়াম উত্তোলিত হয়। জাদুগোড়ার মার্কেট স্ক্যোয়ার থেকে রঙ্কিণী মন্দির আরও ২ কিলোমিটার। প্রাচীণ কাল থেকে পূজিত হয়ে আসছেন শক্তিরই আরেক রূপ দেবী রঙ্কিণী। অতীতে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাত্রার সময়ে দেবীর কাছে প্রার্থনা করে যেতেন বনপথের যাত্রীরা। এখনো নিয়মিত পুজো হয় রঙ্কিণী দেবীর থানে। দেবীর নির্দিষ্ট কোনও অবয়ব নেই, দেবী-রূপে পূজিত হয় একটি শিলাখণ্ড। তাতে দুটি রুপোর চোখ। ঝাড়খণ্ডের ভীমজি জনজাতির মানুষেরা সুদীর্ঘকাল ধরে রঙ্কিণী দেবীর আরাধনা করে আসছেন। এই জনজাতির প্রতিনিধিই মন্দিরের পুরোহিত হয়ে থাকেন।

রঙ্কিণী মন্দির থেকে আরও ১০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ঢুকে পড়তে পারেন টিলা-পাহাড়ে ঘেরা নারোয়ার জঙ্গলে। বন-পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে নিরালায় বয়ে চলেছে ছোট্ট এক নদী। অপরূপ নিসর্গ শোভা জায়গাটার। হাতে সময় থাকলে বেড়িয়ে আসা যায় মোসাবনীর তামার খনি অঞ্চল থেকে।

ঘাটশিলা থেকে পঞ্চপাণ্ডব ৫ কিলোমিটার। অবস্থান গুলমা জেলায়। পাঁচটি টিলা পাহাড় একত্রে পঞ্চপাণ্ডব পাহাড়। আঞ্চলিক মানুষের বিশ্বাস, দ্রোপদী-সহ মহাভারতের পাণ্ডব ভ্রাতারা এখানে কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। একটি ছোট মন্দির আছে এখানে। পঞ্চপাণ্ডব অঞ্চল থেকেও সুবর্ণরেখায় চমৎকার সূর্যাস্ত দেখা যায়।

ঘাটশিলা শহরের কাছাকাছি চিত্রকূট পাহাড়। খুব উঁচু পাহাড় নয়। টিলা পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় রয়েছে একটি শিবমন্দির। পাহাড় থেকে চারপাশের দৃশ্য খুব সুন্দর। চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য শিলাখণ্ড, যেন অসংখ্য পাথরের ভাস্কর্য।

ঘাটশিলা যাবেন যখন, গালুডি আর কতদূর? ঘাটশিলা থেকে গালুডি ১০ কিলোমিটার। রেললাইন পেরিয়ে চলে আসুন সুবুর্ণরেখার ব্যারেজে। টিলা ও জঙ্গলে ঘেরা সুবিশাল জলাধার দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যাবে। দুই পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে সেই বিপুল জলরাশিতে অস্তগামী সূর্যের মিঠে ছটা সৌন্দর্যের আরেক রূপের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে আপনাকে। মন চাইলে গালুডিতে একটা দিন থেকেও যেতে পারেন।

যাওয়ার পথ

রেলপথে হাওড়া থেকে ঘাটশিলা ২১৬ কিলোমিটার। হাওড়া-বড়বিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেস, ইস্পাত এক্সপ্রেস, শালিমার-লোকমান্য তিলক টার্মিনাস এক্সপ্রেস প্রভৃতি ট্রেন ঘাটশিলা যাচ্ছে। ঘন্টা তিনেকে হাওড়া থেকে ঘাটশিলা পৌঁছে যাওয়া যায়।
সড়কপথে কলকাতা থেকে ঘাটশিলা প্রায় ২৪০ কিলোমিটার। এন এইচ-১৬ ও তারপর এন এইচ-৪৯ ধরে ঘাটশিলা পৌঁছানো যায়। সময় লাগবে ঘন্টা পাঁচেক।

থাকার ব্যবস্থা

ঘাটশিলা স্টেশনের কাছাকাছি রয়েছে নানা মান ও দামের হোটেল। রাতমোহনা ভিউপয়েন্টের কাছে আছে হোটেল রাতমোহনা ইন। ঘাটশিলার দহিগোড়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে থাকার জন্য রয়েছে রামকৃষ্ণ মঠের অতিথিশালা।

 

* গৌরীকুঞ্জ ব্যতীত অন্য সবক’টি ছবি, সৌজন্যে মনোজিৎ মুখোপাধ্যায় ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *