Follow us
Search
Close this search box.

ডেব্রিগড় সাতকোশিয়া মংলাজোড়িঃ একটি ভ্রমণ আলেখ্য

ডেব্রিগড় সাতকোশিয়া মংলাজোড়িঃ একটি ভ্রমণ আলেখ্য

ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের এক বুধবার রাতে জগদলপুর এক্সপ্রেসের এ সি-থ্রি কোচে উঠে বসলাম আমরা। একটা চাপা আনন্দ খেলছে সকলের চোখেমুখে। ট্রেন ছাড়ল সময়মতোই, ৯ঃ৩০-এ। আলাপ-পরিচয়, হাসি-ঠাট্টা, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া, চাপা আনন্দটি ক্রমশ প্রাণময় উচ্ছ্বাসের নানা চিত্র আঁকতে থাকল।

যে-কোনও ভ্রমণের আগে সলতে পাকানোর কাজটি অর্থাৎ প্রস্তুতির পর্বটি গুরুত্বপূর্ণ। মানসভ্রমণ শুরু হয়ে যায় তখন থেকেই। তাই প্রস্তুতির পর্বের অবতারণা। ২০১৮ সাল। দুর্গাপুজো শেষ। যখন থেকে এ কথার শুরু, তার আগের দিন লক্ষীপুজো হয়ে গেছে। আমার স্ত্রী মণিকে বলে রেখেছিলাম, পরপর টুর করে ক্লান্ত, তাই পরের দিনটিতে একটু বেলায় ঘুম থেকে উঠবো। হায় হতোস্মি, সকাল আটটাও বাজেনি, মোবাইল ফোনটি বেজে উঠলো।

ঘুম জড়ানো কণ্ঠে হ্যালো বলতেই অপরপ্রান্ত থেকে অশোকদা বলে উঠলেন, কি ব্যাপার, এখনো ঘুম ভাঙেনি? পরে ফোন করব? ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। বললাম, না না বলুন, শুনছি।

অশোকদা কোনও সংকোচ না করেই বললেন, সামনের মাসের গোড়ায় কোন শর্ট টুর করলে আমরা ক’দিন বেড়িয়ে আসতাম।

আসলে অশোকদা আর বৌদি, মানে অশোকদার স্ত্রী বিগত ১৩-১৪ বছর যাবৎ আমার সঙ্গে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় বেড়িয়েছেন এবং আমার ওপর ওঁদের বেশ আস্থা। ওঁরা এটা জানেন যে, আমার ভ্রমণ পরিকল্পনাগুলো সাধারণত ঋতু নির্ভর ও সময়োপযোগী হয়ে থাকে। যখন তখন যে-কোনও জায়গায় টুরের আয়োজন করি না।

বললাম, যদি ৫/৬ দিনের টুর হয় তাহলে নভেম্বরে না করে ডিসেম্বরে করলে ভালো হয়। সেক্ষেত্রে আপনাদের না-যাওয়া অথচ খুব আকর্ষণীয় একটা সার্কিটে বেড়িয়ে আসা যেতে পারে। যাওয়া-আসা নিয়ে দিন সাতেকের সময় দরকার হবে।

জায়গাটা কোথায় এবং দক্ষিণা কীরকম হতে পারে, জানতে চাইলেন অশোকদা।

বললাম, রাজ্যটি উড়িষ্যা, এখন ওড়িশা। পাহাড়, জঙ্গল, নদী ইত্যাদি নিয়ে সে প্রকৃতির এক আপন ভূমি। এখানে এশিয়ার বৃহত্তম বাঁধ হীরাকুদ, ডেব্রিগড়ের গহন অরণ্য, সাতকোশিয়া ও টিকরপাড়ার গর্জ ও ব্যাঘ্র প্রকল্প, মহানদীর তীর বা ঘন জঙ্গল-পরিবেষ্টিত পাহাড়চূড়ার কটেজ থেকে পূর্বঘাট পর্বতমালার অসাধারণ নৈসর্গিক দৃশ্য, খানিক এগিয়ে চিল্কার ধারে মংলাজোড়ির অসংখ্য পরিযায়ী পাখির মেলা, সবমিলিয়ে একটা মনকাড়া ভ্রমণ ক্ষেত্র, একই যাত্রায় অনেকটা, আমার নিজের এমনটাই মনে হয়। জনপ্রতি খরচ ধরা যেতে পারে ১৫,০০০ টাকা।

অশোকদা মন দিয়ে সব শুনলেন এবং যাওয়ার ব্যাপারে রাজিও হলেন। তবে দুটো শর্ত দিলেন। তাঁদের সঙ্গে এক তরুণী যাবেন এবং কোনও মহিলার সঙ্গে তাঁকে ঘর শেয়ার করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহটা বাদ দিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হলে ভালো হয়।

হিসেব করে দেখলাম, অশোকদাকে জনপ্রতি যে টুর-খরচ জানালাম সেটা বজায় রাখতে হলে দলে অশোকদা, ওনার স্ত্রী এবং ওই তরুণী-সহ আরও তিনজন ভ্রমণার্থীর দরকার রয়েছে দলে। অনেক ভ্রমণের সঙ্গী সুমিত্রাদি আগেই বলে রেখেছিলেন, ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে কোনও টুরের ব্যবস্থা হলে তাঁকে জানাতে। সুমিত্রাদি অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ছেলে দিল্লিতে চাকরি করেন। ভ্রমণে ওঁনার স্বামীর বিশেষ কোনও আগ্রহ নেই। সুমিত্রাদি একাই বেড়ান দেশে-বিদেশে। এবারে আমাদের বেড়ানোর পরিকল্পনার কথা জানাতেই উনি এক কথায় রাজি।

আর দু’জন সদস্যের দরকার। ভেবে দেখলাম, বিমলদাকে বলা যায়। বিদ্যুৎ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। বেড়ানোর সময়ে অন্যদের সঙ্গে মেলামেশায় একটু অসুবিধা হয় ভদ্রলোকের। আমার আয়োজনায় কয়েকটি টুরে উনি বেড়িয়েছেন। চোখে চোখে রাখি। যাইহোক, উনি রাজি হয়ে গেলেন এবং ওনাকেই ওনার পছন্দমতো আরেকজন সদস্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া গেল। দিন দুয়েক পরে বিমলদা জানালেন, বছর পয়ত্রিশের এক যুবক ওনার সঙ্গী হবেন। অর্থাৎ, আমি ও মণি-সহ আমাদের মোট ৮ সদস্যের দল তৈরি হল।

জগদলপুর এক্সপ্রেস পরের দিন সকাল ৮:৪৫ নাগাদ আমাদের সম্বলপুর জংশন স্টেশনে পৌঁছে দিল। ব্যবস্থা অনুযায়ী স্টেশন চত্বরে গাড়ি উপস্থিত ছিল। আমরা ওড়িশা সরকারের পর্যটন বিভাগের হোটেল পান্থনিবাসের উদ্দেশে রওনা হলাম। কলকাতা থেকেই সব আয়োজন করে রাখা হয়েছিল। কয়েকবার আসার সুবাদে ওটিডিসির কর্তাব্যক্তি-সহ বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থার মালিক, ড্রাইভার, পান্থনিবাসের কর্মীরাও আমার পরিচিত। ঠোক্কর খাওয়ার আশঙ্কা নেই।

হোটেলে পৌঁছে খানিক বিশ্রাম সেরে ফ্রেশ হয়ে নেওয়া গেল। জলখাবারের পর্ব সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম গন্তব্য ডেব্রিগড়ের জঙ্গল। রাস্তা গিয়েছে হিরাকুদ বাঁধের জওহর মিনারের পাশ দিয়ে। জওহর মিনার অতিক্রম করে আরও পাঁচ কিলোমিটার এগনোর পর থেকে দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকল। সবাইকে আগে থাকতে বলে দিয়েছিলাম, ডেব্রিগড় ফরেস্টে পৌঁছনোর আগে গাড়ি দাঁড় করানো যাবে না। কারণ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমাদের আগে জঙ্গলে ঢুকে পড়তে হবে।

হীরাকুদ জলাধারের পাশ দিয়ে ডেব্রিগড় যাওয়ার রাস্তাটি।

অসাধারণ সুন্দর এই পথ ফরেস্ট গেট পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার ধরে চলবে। পথের সৌন্দর্য চাক্ষুষ করা সারা জীবনের এক দুর্লভ সঞ্চয়। একদিকে হীরাকুদের বিশাল জলাধার। সীমাহীন সমুদ্রের মতো জলরাশি যেন। অন্যদিকে সারি সারি গাছ, চাষের জমি, খোলা প্রান্তর, ছোট ছোট কুঁড়েঘর। একটু দূরে পূর্বঘাট পর্বতমালার হাতছানি। সবটা মিলিয়ে অপূর্ব এক ছবি।

বিকেলে হীরাকুদ জলাধার।

ওই পূর্বঘাট পর্বতমালারই একাংশে ডেব্রিগড়ের গহন অরণ্য। গাড়ির মধ্যে তখন সবাই উত্তেজিত, আহা, এ কী দৃশ্য দেখছি আমরা। কলকাতা থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে আমরা ঢুকে পড়েছি প্রকৃতির রূপকথার জগতে।

ডেব্রিগড়ের জঙ্গলে।

আমরা ফরেস্টের গেটে এসে পৌঁছালাম। সেখানে নামধাম নথিভুক্ত করে সকলে মিলে জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। হীরাকুদ জলাধারের পারে ৭৪৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ডেব্রিগড় বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য। বলে রাখা ভাল, হাতির দল বেরলে জঙ্গল প্রবেশ নিষেধ। হাতি ছাড়াও এই জঙ্গলে রয়েছে ভারতীয় গাউর, বড় সিংওয়ালা হরিণ, চিতল হরিণ, বাঁদর, ময়ূর, পেঁচা, ভাল্লুক, হায়না, শিয়াল, বিষাক্ত সাপ এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। জঙ্গলে সাফারির ব্যবস্থা আছে। প্রায় দু’ঘন্টার জঙ্গল সাফারিতে আমরা প্রচুর ময়ূর, বাঁদর, হনুমান, হরিণ, সম্বর ও গাউর দেখতে পেয়েছিলাম সেবার।

ডেব্রিগড়ের আবাসিক।

একটু দেরি হয়ে গেলেও ফেরার পথে সেই অপূর্ব সুন্দর পথে সকলের ইচ্ছেয় দুটো জায়গায় গাড়ি দাঁড় করানো হল। প্রচুর ছবি তোলা হল। পথে লাঞ্চ।

এরপর আমরা ঘন্টেশ্বরী মন্দিরের দিকে রওনা হলাম। সম্বলপুর শহর থেকে ঘন্টেশ্বরী মন্দির ৩০ কিলোমিটার। মন্দিরে যাওয়ার পথটি ভারী সুন্দর এবং মহানদীর তীরে মন্দির প্রাঙ্গনের অবস্থানটি আরও সুন্দর। মন্দির চত্বরের যত্রতত্র ঘন্টা চোখে পড়বে। ভক্তরা ঘন্টা বেঁধে মানত করেন এ মন্দিরে। ঘন্টেশ্বরী দেবীকে খুব জাগ্ৰত দেবী বলে মনে করেন ভক্তরা। এই গোধূলিবেলায় সোনালী সূর্যাস্তের সময়টায় কেমন মায়াময় হয়ে উঠল চারিদিকটা।

সাতকোশিয়ায় মহানদীর চলন।

আমাদের আজকের শেষ গন্তব্য সম্বলেশ্বরী মন্দির। আমাদের হোটেলের কাছেই মন্দিরটি। সন্ধ্যায় সম্বলেশ্বরী মন্দিরের আলো ঝলমলে প্রাঙ্গন ও আরতি দেখে হোটেলে ফিরে এলাম। এবার একটু বিশ্রামের খুব প্রয়োজন।

পরের দিন ভোরে প্যাকড ব্রেকফাস্ট সঙ্গে নিয়ে আমরা সম্বলপুর সিটি স্টেশনে এসে অঙ্গুল যাওয়ার ট্রেন ধরলাম। এখানে একটা তথ্য উল্লেখ করা দরকার। সম্বলপুরে মোট তিনটি রেল স্টেশন আছে। সম্বলপুর জংশন স্টেশন, সম্বলপুর সিটি স্টেশন এবং সম্বলপুর রোড স্টেশন। সম্বলপুর সিটি স্টেশন থেকে ট্রেনপথে অঙ্গুল পৌঁছাতে মোটামুটি আড়াই ঘন্টা সময় লাগে।

কত রূপ কত বাঁক সে নদীর।

অঙ্গুলে পৌঁছে দেখি আমার স্নেহের এবং বরাবরের ড্রাইভার কপিল দেহুরির গাড়ি অপেক্ষায়। আকাশ যেন ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে। সাধারণত ডিসেম্বরের এই সময়টায় ঝড়-জলের পরিস্থিতি থাকে না। অঙ্গুল স্টেশন থেকে টিকরপাড়া নেচার ক্যাম্প প্রায় ৮০-৮৫ কিলোমিটার। পথে চেকপোস্টে প্রয়োজনীয় নথিপত্র দেখিয়ে ক্রমশ জঙ্গলের গভীরে ঢুকে পড়তে লাগলাম আমরা। একটার পর একটা হাতি চলাচলের করিডোর পেরতে হচ্ছে সাবধানে। যখন নেচার ক্যাম্প থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দূরে, প্রচন্ড ঝড় উঠল। জঙ্গলের মধ্যে এই ধরনের ঝড়ের তাণ্ডব আর তার বুক কাঁপানো দৃশ্য জীবনে এই প্রথম চাক্ষুষ করলাম। রাশি রাশি শুকনো পাতা গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। প্রবল বাতাসের দাপটে গাছগুলো হেলে প্রায় মাটি স্পর্শ করে আবার উঠে দাঁড়িয়ে পড়ছে। জঙ্গলের এমন রূপ সকলের কাছেই প্রথম অভিজ্ঞতা। অবশেষে নেচার ক্যাম্পের গেটে এসে পৌঁছলাম।

টিকরপাড়ার এই নেচার ক্যাম্পটি ওড়িশা সরকারের তত্বাবধানে ২১টি উপজাতি পরিবার পরিচালনা করে থাকে। এদের আন্তরিকতা আতিথেয়তা মন কেড়ে নেয়। এখানকার প্রায় সব কর্মীই আমাকে চেনে। ওরা আমাদের লাগেজ গাড়ি থেকে নামিয়ে নির্দিষ্ট চারটে টেন্টে পৌঁছে দিল। আমার সঙ্গীরা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার কথা, এমনকী নিজেদের জিনিসপত্রের কথাও ভুলে গিয়ে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের মধ্যে অবগাহন করেছেন। একটা বিহ্বল ভাব সকলের মধ্যে। হালকা বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টির জল গায়ে লাগতে সবাই যেন সম্বিত ফিরে পেল। এখানে আমরা দুটো রাত থাকবো।

ছবিঃ লেখক

(পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *