Follow us
Search
Close this search box.

বনপাহাড়িয়া কাঁকড়াঝোর

বনপাহাড়িয়া কাঁকড়াঝোর

প্রাচীন সব শাল গাছ। সকালে গাছের ফাক-ফোঁকর দিয়ে জাফরি কাটা রোদ পড়ে মাটিতে, শুকনো পাতার ওপর। শাল, সেগুন, কুসুম, মহুয়া, কেন্দু, আকাশমণির জঙ্গল আর টিলা পাহাড়ে ঘেরা জায়গাটা। ইতিউতি পাখি ডাকে। প্রকৃতি এখানে প্রকৃতই বন্য। দলমা পাহাড় থেকে নেমে আসে হাতির পাল। হাতি তাড়াতে মহল্লায় মহল্লায় চলে রাত-পাহারা। চন্দ্রালোকে বড় মায়াবী অরণ্য, পাহাড়। ঝিম ধরা পরিবেশ। আদিবাসী পাড়া থেকে ভেসে আসে মাদলের বোল।

কাঁকড়াঝোর। ছবি সৌজন্যে : চারমূর্তি হোমস্টে

বন-পাহাড়ের কাঁকড়াঝোর। অরণ্য, পাহাড়, ঝর্ণা, লেক, গ্রামীণ হাট, আদিবাসী জীবন ও সংস্কৃতি, সবমিলিয়ে কাঁকড়াঝোর যেন এক জাদু-বাস্তবতা। ঝাড়খণ্ডের সীমানা ঘেঁষে ঝাড়গ্রামের উত্তর-পশ্চিমে কাঁকড়াঝোরের নিভৃত অবস্থান। ঊষর ভূমিতে ঘণ সবুজের বাড়বাড়ন্ত অবাক করে বৈ কী। সেই বন্য প্রকৃতির মধ্যে দুটো দিন প্রাণভরে প্রশ্বাস নেওয়ার জন্য এই শীতের মরশুম সেরা সময়। গরমের কষ্টটা থাকে না। তবে শীতে ঠাণ্ডা বেশ। কাঁকড়াঝোরের এটা সেটা, এদিক সেদিক রসিকজনের আবিষ্কারের অপেক্ষায়।

কাঁকড়াঝোর এলাকাটির পিছন দিকটাতেই ময়ূরঝর্ণা পাহাড়। ঝর্ণা নেই কিন্তু। তবে ময়ূরঝর্ণা পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য আপনাকে সিক্ত করবে। ময়ূরঝর্ণা থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য অসাধারণ। সবুজে মোড়ানো পাহাড়ে ময়ূর, খরগোশ, ভাল্লুক আছে। একটা ওয়াচটাওয়ার আছে কাঁকড়াঝোরে। সেখান থেকে পাখির চোখে কাঁকড়াঝোরের বন্য প্রকৃতি চাক্ষুষ করা যায়।

কাঁকড়াঝোর। ছবি সৌজন্যে : চারমূর্তি হোমস্টে

কাঁকড়াঝোরের কাছেই আমলাশোল। ক্ষুধা, ক্ষুধায় মৃত্যুর খবর নিয়ে এক সময় শিরোনামে এসেছিল আমলাশোল। বেড়িয়ে আসুন আমলাশোল থেকে। আমলাশোলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে অভিভূত করবে। আমলাশোল, ময়ূরঝর্ণা, আমঝর্ণা, এ সব কাঁকড়াঝোরের পাশাপাশি গ্রাম।

আর দেখবেন আদিবাসী জীবনের নানা ছবি। বন-জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা পিঁপড়ের ডিমের ঝোলা নিয়ে কোনও আদিবাসী মানুষকে ফিরতে দেখলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। জঙ্গলমহলের আদিবাসীদের কাছে একটি তৃপ্তিকর খাদ্য প্রোটিন-সমৃদ্ধ পিঁপড়ের ডিম। শুধু এখানকার জঙ্গলমহল কেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পিঁপড়ের ডিমের নানা পদ তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া হয়। জঙ্গলমহলের আদিবাসীদের মধ্যে লাল পিঁপড়ের চাটনিও একটি জনপ্রিয় খাদ্য। লঙ্কা, আদা, নুন সহযোগে লাল পিঁপড়ে থেঁতো করে চাটনি হিসেবে খাওয়া হয়। আপনিও চেখে দেখতে পারেন।

বেড়িয়ে আসুন লালজল গ্রাম থেকে। লোহা ও তামার উপস্থিতির কারণে এখানকার একটি ঝর্ণার জলের রং লালচে। তাই লালজল। লালজল গ্রামের পশ্চিমে দেওপাহাড়ে আদিম মানবের গুহা আবিস্কৃত হয়েছে। গুহার মধ্যেকার দেওয়ালে সেই আদিম মানুষের খোদাই করা ছবি দেখা যায়। গুহায় ঢুকতে হয় হামাগুড়ি দিয়ে।

লালজল থেকে যেতে পারেন শিমুলপাল। পাথরশিল্পীদের গ্রাম এটি। জঙ্গলে ঘেরা খান্দারানি জলাধার ও তার চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন ভালো করে দেবে। শীতে নানা প্রজাতির পাখির দেখা মিলবে খান্দারানি জলাধার ও সংলগ্ন জঙ্গলে। জঙ্গলাকীর্ণ টিলায় ঘেরা আমঝর্না লেকটিও খুব সুন্দর। ঢাঙিকুসুম গ্রামেও তো একবার যেতে হয়। আগে এই গ্রাম পাথরের বাসন তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকত, এখনো হয়, তবে অল্পসল্প। ঢাঙিকুসুমে একটি ঝর্না আছে। ঢাঙিকুসুম থেকে ট্রেক করে হুদহুদির ঝর্নাটিও দেখে আসতে পারেন। ঝাড়খণ্ড সীমানার কাছে কেটকি লেকটি দেখতে ভুলবেন না। সারাদিন কেটে যেতে পারে হ্রদের ধারে। শীতের মরশুমে বিভিন্ন পাখির মিলবে এখানে।

যেতে পারেন গদরাসিনি পাহাড়ে। পাখি পর্যবেক্ষণের আরেকটি আদর্শ জায়গা গদরাসিনি পাহাড় অঞ্চল। পাহাড়ের পাদদেশে শান্ত পরিবেশে একটি সুন্দর আশ্রম আছে। এখানে খানিকক্ষণ সময় কাটাতে ভালো লাগবে। বেড়িয়ে আসতে পারেন কানাইসোর পাহাড় থেকে। জুলাই মাসে মেলা বসে পাহাড়ের মাথায়। বেড়িয়ে আসতে পারেন তারাফেনি ড্যাম থেকেও। তারাফেনি নদীতে সূর্যাস্তের রং দেখে আশ্চর্য হতে হবে। ঘাঘরা জলপ্রপাতটিও দেখতে হয়। তবে ঝর্ণা ও জলপ্রপাতগুলি প্রাণবন্ত হয়ে থাকে বর্ষায়। চাইলে কাঁকড়াঝোর থেকে চকাডোবা ট্রেক করতে পারেন। কাঁকড়াঝোর থেকে ট্রেক করে যাওয়া যায় বাঁকুড়ার ঝিলিমিলিতেও।

কাঁকড়াঝোর। ছবি সৌজন্যে : চারমূর্তি হোমস্টে

প্রসঙ্গত, বেলপাহাড়ি বা ঝাড়গ্রামে থেকেও জায়গাগুলো বেড়ানো যায়। প্রকৃতপক্ষে বেলপাহাড়ি থেকে উল্লেখিত অনেকগুলো দর্শনীয় জায়গা কাছাকাছি। ঝাড়গ্রাম থেকে বেলপাহাড়ি ৩৫ কিলোমিটার। এখানে বিশেষ করে
কাঁকড়াঝোরের কথা জানানো হল এই কারণে যে, উজাড় করা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে রোমাঞ্চের মিশেলে জঙ্গলমহলের এক অবাক করা ভ্রমণ ঠিকানা হয়ে উঠতে চলেছে কাঁকড়াঝোর।

আরেকটি বিষয়ও উল্লেখযোগ্য, সেটি হল, ঘাটশিলা ভ্রমণের সঙ্গে কাঁকড়াঝোরকে কিংবা কাঁকড়াঝোর ভ্রমণের সঙ্গে ঘাটশিলাকে যুক্ত করে নেওয়া যায়। ঘাটশিলা স্টেশন থেকে সড়কপথে কাঁকড়াঝোর মাত্র ২২ কিলোমিটার। আসা যায় গাড়ি ভাড়া করে বা ম্যাজিক ভ্যানে সওয়ারী হয়ে।

যাওয়ার পথ

ঝাড়গ্রাম থেকে কাঁকড়াঝোর ৬১ কিলোমিটার। বেলপাহাড়ি থেকে কাঁকড়াঝোর ২২ কিলোমিটার। ঝাড়গ্রাম থেকে বেলপাহাড়ি ৩৫ কিলোমিটার। ঝাড়গ্রাম বেড়িয়ে গাড়িতে কাঁকড়াঝোর আসা যায়। তবে অন্তত একটা দিন কাঁকড়াঝোরে থাকা উচিৎ। সরাসরি কাঁকড়াঝোর আসতে চাইলে ঘাটশিলা স্টেশনে নেমে সড়কপথে আসাই শ্রেয়। ঘাটশিলা বেড়িয়েও কাঁকড়াঝোর চলে আসতে পারেন। হাওড়া-বড়বিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেস, ইস্পাত এক্সপ্রেস, শালিমার-লোকমান্য তিলক টার্মিনাস এক্সপ্রেস প্রভৃতি ট্রেন ঘাটশিলা যাচ্ছে।

খড়গপুর, ঝাড়গ্রাম, শিলদা, বেলপাহাড়ি হয়ে সড়কপথে কাঁকড়াঝোর ২৪০ কিলোমিটার।

থাকার ব্যবস্থা

চারমূর্তি গেস্টহাউস, ফোনঃ ৯৮৩৬৮-৩০৩৪২, ৯৮৩১৩-০৯৫১২। মাহাতো হোমস্টে, ৯৬৩৫১-৬২৮৭০, ৭০০৩১-০১০১৬।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *