এখন ফুলে ফুলে ছয়লাপ আপেলের বাগানগুলো। অগস্ট থেকে নভেম্বর ফলন তোলার কাজ চলবে জোরকদমে। শ্রীনগর থেকে পহলগামের দিকে যাত্রা করেছি বেলা ১০টা নাগাদ। এপ্রিল মাস (২০২৩)। কাশ্মীর উপত্যকায় বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে। কত যে ফুল চলার পথে। ডাললেকের পারে জবরওয়ান পাহাড়ের পাদদেশে জমে উঠেছে টিউলিপের উৎসব। পথে একটা আপেল বাগানে নেমেছিলাম। মিস্টি একটা আঘ্রাণ সেখানকার বাতাসে ঘন হয়ে আছে।
শ্রীনগর থেকে পুলওয়ামা হয়ে অনন্তনাগ জেলার পহলগাম ৯২ কিলোমিটার। পৌঁছোলাম বেলা দেড়টা নাগাদ। ওঠা গেল নির্দিষ্ট হোটেলে। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে গেলাম লিডার নদীর তীরে। লিডারের প্রবাহ পহলগামের সৌন্দর্যে এক বিশেষ মাত্রা। স্বচ্ছ জলের প্রবাহ। কুল কুল ধ্বনি, তুষারাবৃত পর্বত শৃঙ্গ, সবুজের ঢেউ, সবমিলিয়ে প্রকৃতির এক আশ্চর্য ছবি। সোনমার্গ বা সোনামার্গের কাছাকাছি কোলাহই হিমবাহ লিডার নদীর উৎস। অনন্তনাগ জেলায় ঝিলমের সঙ্গে মিলিত হয়েছে নদীটি।
সন্ধ্যা নামল। প্রচণ্ড ঠান্ডা। দিনে ৮-১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। রাতের তাপমাত্রা মাইনাসের ঘরে নেমে যাচ্ছে। আজ ৬ এপ্রিল। পহলগামের রাতের তাপমাত্রা মাইনাস ২ ডিগ্রিতে নেমে গিয়েছিল। এখানকার লোকেরা এটাকে মিষ্টি শীত বলে। সমতলের মানুষ আমরা। ঠান্ডার দাপটে প্রাণ ওষ্ঠাগত, বিশেষ করে রাতে। সন্ধ্যার পরে গিন্নি একগুচ্ছ কাশ্মীরি কম্বলের নীচে শয্যা নিয়েছেন। রুম হিটার চলছে। দিনে অবশ্য চমৎকার রোদ থাকছে। ওই রোদ্দুরটা যে কী আরামদায়ক।
সকালে উঠে চারিদিকে বিছিয়ে থাকা ওই সোনালী রোদ্দুরটা দেখে মনটা উড়ু উড়ু হয়ে উঠল। ব্রেকফাস্টের পরে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য ৮,৮২৫ ফুট উচ্চতার আরু ভ্যালি। পহলগাম থেকে মাত্রই ১৩ কিলোমিটার। রাস্তা ভালোই বলতে হবে। অল্পসল্প চড়াই-উৎরাই আছে। আরু ভ্যালিতে যাওয়ার জন্য চেকপোস্টে নাম নথিভুক্ত করাতে হয়। এন্ট্রি ফি জনপ্রতি ২৫ টাকা। বলে রাখা মনে হয় ভালো যে, পহলগাম ও তার আশেপাশে বেড়ানোর জন্য আঞ্চলিক গাড়ি ভাড়া করতে হবে। শ্রীনগর বা জম্মু থেকে ভাড়া করে আনা গাড়ি বিশ্রামে থাকবে ততক্ষণে।
একটি ছোট্ট গ্রাম আরু। তৃণভূমিতে ছোট ছোট ফুলের সমারোহ, পাইনের জঙ্গল, বরফে মাখামাখি পাহাড়, আরু উপত্যকা যেন এক লুকনো স্বর্গ। পহলগামের ভিড় নেই এখানে। অপার শান্তির জায়গা। কোলাহই হিমবাহ, তরসর-মরসর লেক ট্রেক করেন যাঁরা, তাঁদের বেসক্যাম্প হয় এই আরু ভ্যালি।
আরু গ্রামে থাকা যায়। কয়েকটি হোমস্টে আছে। এখানে থাকতে পারলে সেটা যে অন্যরকমের অভিজ্ঞতা হবে তা বেশ বোঝা যায়। আঞ্চলিক মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে মিষ্টি হাসি উপহার পাওয়া যাচ্ছিল। তৃণভূমিতে পশুপালন ও অল্পসল্প চাষ আঞ্চলিক মানুষজনের মূল জীবীকা। কয়েকটি ছোট দোকান চোখে পড়েছে। হোমস্টেতে অতিথি আপ্যায়ণ নতুন একটা দিক খুলছে আরু উপত্যকায়। আরুতে একটা রাত থাকতে পারলে মন্দ হয় না। ট্রেকারদের থাকতেই হয়। গড়পরতা ভ্রমণার্থীর কথা বলছি। পশ্চিম হিমালয়ের অন্দরমহলের রাতটা, ভোরটা দেখা যায় তাহলে।
চন্দনবাড়ির উচ্চতা ৯,৫০০ ফুট। আরু বেড়িয়ে দুপুরে চন্দনবাড়িতে পৌঁছালাম। পহলগাম থেকে চন্দনবাড়ি ১৫ কিলোমিটার। চন্দানবাড়িতে এসে আমরা বিস্মিত। চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ। আগে বলেছি, দিনটা ২০২৩-এর ৬ এপ্রিল। আমরা ওখানে থাকতে থাকতেই খানিকক্ষণ তুষারপাতও হয়েছিল সেদিন। জুন ও আগস্ট মাসে আমরনাথ যাত্রীদের সমাগমে এই চন্দনবাড়ির পাহাড় গমগম করে।
১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চন্দনবাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে আমরনাথের দিকে যাত্রা করেছিলাম। চন্দনবাড়ি থেকে অমরনাথ ৩২ কিলোমিটার। রাতে চন্দনবাড়িতে জীবনে প্রথম টেন্টে কাটিয়েছিলাম। সেবার চন্দনবাড়িতে হালকা বরফ পেয়েছিলাম। সকালে ফের যাত্রা শুরু করে পিসুটপ, শেষনাগ ও ১৪,৪০০ ফুট উচ্চতার মহাগুনা পাস পেরিয়ে সন্ধ্যায় জনমানবশূন্য পঞ্চতরণীর একটা পরিত্যক্ত রেস্টহাউসে আশ্রয় নিয়েছিলাম ৯ বন্ধুর দল। পরের দিন গুহাবাসী আমরনাথজির দর্শন হয়েছিল। তারপর আমরনাথ থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরের বালতাল এসে পৌঁছেছিলাম সন্ধ্যায়। ঝুঁকি নিয়ে পথে খরস্রোতা নদী পেরতে হয়েছিল। প্রচণ্ড ঠান্ডা ছিল। ভালোই মনে আছে, ওই রাতেই লে-শ্রীনগর হাইওয়েতে একটা ট্রাক থামিয়ে চালককে অনেক অনুনয় করে সেই ট্রাকে শ্রীনগর পৌঁছেছিলাম। সেই ১৯৮৯ সালে জনপ্রতি ১০০ টাকা ভাড়া লেগেছিল।
দ্বিতীয়বার পহলগামে এসেছিলাম ১৯৯৮ সালে। সেটা ছিল অক্টোবর মাস। কতদিন পরে লিডার নদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। এবারের মতো পর্যটক সমাগম পহলগামে আমার আগের দুই ভ্রমণে চোখে পড়েনি। অবশ্য এই এপ্রিল মাসটা কাশ্মীর বেড়ানোর সেরা এক মরসুম। এখন অবশ্য মরসুমী ভ্রমণের ধারণাটা বদলে যাচ্ছে। বিভিন্ন ঋতু নানা জায়গায় নিজের মতো করে ছবি আঁকে। জম্মু-কাশ্মীর তেমনই একটা অঞ্চল। ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে আলাদা আলাদা রূপে প্রকাশিত হয় কাশ্মীর।
যাইহোক, এবারের ভ্রমণে চন্দনবাড়ি থেকে পহলগাম ফেরার পথে আমাদের যাত্রাবিরতি হয়েছিল বেতাব ভ্যালিতে। জায়গাটার দীর্ঘকালের নাম ‘হগন’ বা ‘হজন’ ভ্যালি। ১৯৮৩ সালে সানি দেওল ও অমৃতা সিং অভিনীত ‘বেতাব’ ছবিটি রিলিজ করল। রাহুল রাওয়াইল পরিচালিত বেতাব সিনেমার অনেকাংশের শ্যুটিং হয়েছিল এখানে। ছবি হিট। অপূর্ব উপত্যকাটি যেন নতুন করে আত্মপ্রকাশ করল। হগন বা হজন ভ্যালির নতুন ডাকনাম হল বেতাব ভ্যালি। সে-সময় রোমান্টিক মধুচন্দ্রিমা যাপনের অন্যতম জনপ্রিয় ঠিকানা হয়ে উঠেছিল এই বেতাব ভ্যালি।
পাহাড়ঢালের সবুজ অরণ্য আর তাদের তুষারশুভ্র শৃঙ্গ, রংয়ের কী কনট্রাস্ট। সুন্দর একটি পার্ক আছে এখানে। পার্কে খানিক বেড়িয়ে ফের আমাদের পহলগামমুখী যাত্রা শুরু হল। বেতাব ভ্যালি থেকে পহলগাম বড়জোর ১৫ কিলোমিটার। সন্ধ্যায় পহলগামের হোটেলে ফিরলাম। জাঁকিয়ে বসেছে ঠান্ডা। রাত বাড়বে, ঠান্ডার তীব্রতাও বাড়বে।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য দকসুম। পরের লেখায় দকসুম বেড়ানোর কথা বলব।
ফটোঃ লেখক।
1 Comment
[…] লেখকের কাশ্মীর সিরিজের কাশ্মীরঃ পহলগাম থেকে আরু হয়ে বেতাব ভ্যালি শীর্ষক লেখাটি পড়তে পারেন এই লিঙ্কেঃ https://torsa.in/”>https://torsa.in/aru-and-betab-valley-from-pahalgam/ […]