Follow us
Search
Close this search box.

উত্তর সিকিমে দিন কয়েক

উত্তর সিকিমে দিন কয়েক

১২৩৪৩ দার্জিলিং মেল নিউ জলপাইগুড়ি (এন জে পি) স্টেশনে পৌঁছালো ২০ মিনিট বিলম্বে। ২০২২-এর মে মাসের ২৮ তারিখ আজ। আকাশ মেঘলা। গাড়ি ঠিক করে রওনা হওয়া গেল উত্তর সিকিমের রিংঘিমের উদ্দেশে। এন জে পি থেকে দূরত্ব ৭৪ কিলোমিটার। সেবকের এক রেস্তোরাঁয় ব্রেকফাস্ট সারা হল।পেরিয়ে চলেছি একের পর এক পাহাড়ি জনপদ। বিশাল এক ছবির ক্যানভাসের মধ্যে দিয়ে চলেছি যেন।দুপুরে ছোট এক ফ্যামিলি রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি দাঁড় করালো ড্রাইভার।পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে তিস্তা নদী। রেস্তোরাঁর চেয়ার-টেবিল সবই এক-একটা গাছের গুঁড়ি। জায়গাটার নাম ডিকচু। বেশ নাম।

ডিকচুতে তিস্তা।

রিংঘিম

ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হল। খাওয়াদাওয়া সেরে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য রিংঘিম। একবার যাত্রাবিরতি হল মঙ্গনে। উত্তর সিকিমের মঙ্গন জেলার সদর শহর এই মঙ্গন। এখান থেকে রিংঘিম ৬ কিলোমিটার। চড়াই পথ ধরে দিনের আলো থাকতে থাকতেই রিংঘিম পৌঁছালাম। হেলিপ্যাড ঘেঁষে এক হোমস্টে আমাদের থাকার আস্তানা।

এখনো বেশি পর্যটকের আনাগোনা শুরু হয়নি রিংঘিমে। ছোট গ্রাম। জনসংখ্যাও কম। পায়ে হেঁটে বেড়িয়ে নেওয়া যায় গোটা গ্রাম। পাহাড়ের পর পাহাড়ের ঢেউ। হেলিপ্যাডের খোলামেলা পরিবেশ ভালো লাগে। অবস্থানগত কারণে রিংঘিমকে ঝুলন্ত বারান্দা বলা হয়। খাড়াই পথ ধরে যাওয়া যায় রিংঘিম মনাস্ট্রি। গ্রাম বেড়িয়ে, হেলিপ্যাডে পায়চারি করে যথেচ্ছ ছবি তুলে কোথা দিয়ে কেটে গেল দুটো দিন। প্রকৃতির অন্দরমহলে থাকতে যাঁদের ভালো লাগে তাঁরা রিংঘিমে এলে যে ঠকবেন না সে কথা জোর দিয়েই বলছি।

রিংঘিম মনাস্ট্রি।

জংগু

আজ যাব জংগু। রিংঘিম থেকে দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার।হালকা চালের বৃষ্টি শুরু হল। উত্তর সিকিমের মঙ্গন জেলার লেপচা জনজাতির আদি নিবাস জংগু। গ্যাংটক থেকে জংগু ৭০ কিলোমিটার। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম।

রাস্তা দুর্গম। বাইরের লোকের এখানে আসতে হলে পারমিট নিতে হয়। একদিকে খাড়া পাহাড়। অন্যদিকে গভীর খাদ। কোথাও অপরিসর রাস্তার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঝরনার জল। পাহাড়, জঙ্গল, নদী, ঝরনা, আর দূর আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা, জংগু যেন প্রকৃতির লীলাভূমি। খারাপ আবহাওয়ার জন্য আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পাইনি। যা পেয়েছি তা-ই বা কম কী। অকৃপন প্রকৃতির আশ্চর্য রূপ দেখলাম জংগুতে। লেপচা অধিবাসীদের হাসি মেঘলা আকাশের নীচে আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। তারের সেতু (কেবল ব্রিজ) দিয়ে এখানকার একটি নদী পারাপার বেশ রোমাঞ্চকর।

জংগুতে তারের ঝুলন্ত সেতু।

বেলা গড়িয়ে বিকেল হল। জংগুতে আমাদের রাত্রিবাসের পরিকল্পনা ছিল না। এলাম দেখলাম এবং জংগুর প্রেমে পড়লাম। মাঝ সেতুতে দাঁড়িয়ে জংগুকে কথা দিলাম, আবার আসব ফিরে।

নাগা জলপ্রপাত

গাড়ি চলল লাচেন অভিমুখে। ক’দিন ধরে বৃষ্টি হওয়ার কারণে পথের দু’পাশের ঝরনাগুলো ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। এক পথের বাঁকে শোনা গেল তেমনই এক ঝরনার রীতিমতো গর্জন। পাহাড়ের উপর থেকে ধাপে ধাপে তীব্র গতিতে নেমে আসছে জলধারা। কী ভয়ঙ্কর রূপ তার। চোখ ফেরানো যায় না। নাম নাগা ফলস। গ্যাংটক থেকে ৮২ কিলোমিটার।

নাগা জলপ্রপাত।

লাচেন

মঙ্গন জেলার ছোট্ট পর্যটন কেন্দ্র লাচেন। প্রচুর হোটেল এখানে। গুরুদোংমার লেক যেতে হয় এই লাচেন থেকেই। গুরুদোংমার যাত্রার আগে অন্তত একটা রাত লাচেনে কাটাতেই হয় উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য। গ্যাংটক থেকে লাচেন ১৩০ কিলোমিটার। সরাসরি এলে ঘন্টা ছয়েক সময় লাগে। পাহাড়ি রাস্তায় দীর্ঘ যাত্রার পরে লাচেনে পৌঁছে বিশ্রাম। লাচেনের নিজস্ব একটা সৌন্দর্য আছে। পায়ে হেঁটে বেড়াতে ভালো লাগে।

লাচেন।

গুরুদোংমার লেক

আজ খুব সকালে গুরুদোংমার লেকের উদ্দেশে রওনা হল আমাদের গাড়ি। শুনেছি বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ পথের আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করে। লাচেন থেকে গুরুদোংমার লেক ৬৬ কিলোমিটার। পথের বাড়তি উচ্চতা অনুভূত হচ্ছে। বাতাসে অক্সিজেনের ঘাটতি বোঝা যায়। পথে সামরিক বাহিনীর প্রহরা চোখে পড়ছে থেকে থেকে। কাছেই তিব্বত সীমান্ত। তিব্বত এখন চিনের অধীন।

গুরুদোংমার এলাকা।

১৭,৮০০ ফুট উচ্চতায় টলটলে নীল জলের হ্রদ গুরুদোংমার। তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু পদ্মসম্ভব বা গুরু রিনপোচের নামানুসারে হ্রদের নাম। আজ আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন। আবহাওয়া পরিষ্কার। রোদ ঝলমলে পরিবেশ। মাথার উপর ঘন নীল আকাশ। তার ছায়া লেকের জলে। শান্ত সৌন্দর্য বিছিয়ে রয়েছে চারিদিকে।

গুরুদোংমার লেক।

তিব্বতের মালভূমির সঙ্গে যুক্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের উত্তরাংশের হিমবাহ থেকে বয়ে আসা জলে পুষ্ট গুরুদোংমার হ্রদ। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত হ্রদের জল বরফে পরিণত হয়। মে মাসের মাঝামাঝি সময়েও লেকের জলে ভাসমান বরফের চাঁইয়ের দেখা মেলে। অপার বিষ্ময়ে চেয়ে থাকি লেকের দিকে।

কালাপাথর

গুরুদোংমার থেকে লাচেনের দিকে ফেরার পথে খানিকটা এগিয়ে ডান্দিকে মোড় ফিরল আমাদের গাড়ি। খানিকটা এগিয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম কালো রঙের পাহাড় ও পাথরের রাজ্যে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে বরফের আলপনা। প্রকৃতির আশ্চর্য সৃষ্টি। সাদা-কালো রঙের কী কনট্রাস্ট। আর হাতের নাগালেই বরফ। এই জুন মাসে আর কী চাই।

কালাপাথর।

লাচুং

লাচেন থেকে রওনা দিয়ে আমরা লাচুং এসে পৌঁছালাম রাত ন’টা নাগাদ। পথে দু’বার যাত্রাবিরতি হয়েছিল। লাচেন থেকে লাচুং ৪৭ কিলোমিটার। গ্যাংটক থেকে সরাসরি লাচুং ১১৭ কিলোমিটার। ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ। উচ্চতা ৮৬১০ ফুট। ইয়ুমথাং উপত্যকার প্রবেশদ্বার লাচুং তিব্বত সীমান্তের অনেকটা কাছাকাছি। একটু নজর করলে তিব্বতীয় সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায় এখানকার মানুষের জীবনচর্চায়। লাচুংয়ের মধ্যে দিয়ে বইছে লাচুং চু তথা লাচুং নদী। আকাশচুম্বি সব পর্বতের দেখা মিলবে লাচুং থেকে। দুই-একটা দিন লাচুংয়ে কাটানোই যায়।

বচ্চন ফলস

লাচুং যাওয়ার পথে পড়ে ভীমা জলপ্রপাত। রাস্তার পাশেই অবস্থান। গাড়িতে বসেও জলকণার স্পর্শ পাওয়া যায়। পাহাড়ের উপর থেকে আছড়ে পড়ছে দীর্ঘাকার জলপ্রপাতটি। সামনে দাঁড়িয়ে ঘাড় পিছনে হেলিয়ে প্রপাতের উপরিভাগ দেখতে হয়। উচ্চতার কারণে এই জলপ্রপাতটি অমিতাভ বচ্চন ফলস নামে বহুল পরিচিত।

ভীমা জলপ্রপাত।

ইয়ুমথাং

প্রাতরাশের পর লাচুং থেকে রওনা দিলাম ফুলের দেশ ইয়ুমথাংয়ের উদ্দেশে। লাচুং থেকে দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। কিছুদূর যাওয়ার পরে শুরু হল রডোডেনড্রনের জঙ্গল। বৃষ্টির জন্য বহু ফুল ঝরে গেলেও যতটা দেখা হল দাতে চোখ জুড়িয়ে গেল। চোখে পড়তে থাকল নানা প্রগাতির অর্কিড। পৌঁছালাম ইয়ুমথাং উপত্যকায়। গাড়ির জটলা, ভ্রমণার্থীদের ভিড়। দোকানপসার। কেনাকাটা। পিছনে পাহাড়ের পর পাহাড়। অন্যদিকে কুলকুল বয়ে চলেছে নদী। নদীর ওপারে রয়েছে এক উষ্ণ প্রস্রবন।পায়ে হেঁটে দেখে আসা যায়। ইতিউতি চরে বেড়াচ্ছে ইয়াকের দল।

ইয়ুমথাং

এপ্রিল থেকে মে ইয়ুমথাং রডোডেনড্রন, আইরিস, পপি ফুলে ছেয়ে যায়। জুন-জুলাইয়ে ফোটে অসংখ্য বুনো ফুল। শীতে উপত্যকা ঢাকা পড়ে বরফে। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে সাধারণত তুষারপাত হয় লাচুংয়েও।

ইয়ুমথাংয়ের রডোডেনড্রন

বাতাসে হেলছে-দুলছে কত ফুল। আপন বেগে বইছে নদী পতপত উড়তে থাকে রং-বেরঙের প্রার্থনা পতাকা। অবনত হই সুন্দরের কাছে।

লাচুং ও গুরুদোংমার লেকের সর্ব্বোচ্চ ফটো সৌজন্যঃ উইকিমিডিয়া কমনস।
অন্যান্য ফটোঃ লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *