মে-জুনে দার্জিলিংয়ে ভিড় জমে। এ প্রতি বছরের চিত্র। মলে যাওয়ার পথ নেহরু রোডে এ সময়ে ভ্রমণার্থীদের ঢল নামে। রাস্তার দু’পাশের দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ গ্রীষ্মে জমজমাট। পদছাপ বেশি বাঙালিরই। গ্রীষ্মে দার্জিলিং ভ্রমণের রোমান্টিকতাকে এখন আর কলোনিয়াল হ্যাংওভার বলে দাগিয়ে দেওয়া চলে না। বাঙালির বড় আপন হিল স্টেশন হয়ে উঠেছে দার্জিলিং অনেক আগেই। সঙ্গে কালিম্পং, কার্শিয়াং।
সমুদ্র থেকে যাত্রা শুরু করে মেঘরাশি ওই মে মাস নাগাদ আশ্রয় নেয় পাহাড়ের খাদে, পাইনের মাথায়, বাড়ির ছাদে। সেই সব মেঘ দু’-এক পশলা বৃষ্টি হয়ে নেমে আসবে পাথরের বুকে। কুয়াশায় মোড়া সে দার্জিলিংয়ের আরেক রূপ। এ সময় কিন্তু কাঞ্চনজনঙ্ঘার দেখা পাওয়া ভার হবে। সে তো থাকবেই বরাভয় হয়ে, তবে মেঘের আড়ালে। দেখা পাওয়া গেলে তা হবে আবিষ্কারের মতো। হালকা ঠান্ডা, রৌদ্র-ছায়া, মেঘ-কুয়াশাতেও রঙের কত যে শেড। তারপর তো বর্ষা, দার্জিলিং তখন এক অবাক করা জলছবি।
মলে যাওয়ার পথ নেহরু রোড, পাশের গান্ধি রোড আর চক বাজারের লাডেন লা রোডের সংযোগস্থলের ক্লক টাওয়ার দার্জিলিং শহরের একটি অতি পরিচিত ল্যান্ডমার্ক। ১৮৫০ সাল থেকে সময় ঘোষণা করে চলেছে ঘন্টাঘরের ঘড়ি। ক্লক টাওয়ারের নীচে বর্তমান পুরসভার ভবনটি ব্রিটিশ আমলে ছিল টাউন হল।
পড়তে পারেন
‘দার্জিলিংঃ মল থেকে হাঁটাপথে ভুটিয়া বস্তি মনাস্ট্রি’
https://torsa.in/bhutia-bustee-monastery-in-darjeeling/
কাছেই দার্জিলিংয়ের হেড পোস্ট অফিস। এটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। পোস্ট অফিস চালু হয়েছিল ১৯২১ সালে। আরেক দিকে প্ল্যান্টার্স ক্লাব। অতীতের বিত্তবান সাহেবদের ক্লাব। কাছেই ১৮৫০ সালে তৈরি জামা মসজিদ। ওই ঘন্টাঘর চত্বর থেকেই পায়ে পায়ে ঔপনিবেশিক দার্জিলিং শহরের খোঁজ শুরু হতে পারে। সে-ও এক রোমাঞ্চ যাত্রা।
এই ক্লক টাওয়ার চত্বরটি দার্জিলিংয়ে বসবাসকারি ব্রিটিশদের সামাজিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রত জড়িয়ে ছিল। কাছেই ইউনিয়ন চার্চ। তখনকার টাউন হল, ইউরোপিয়ান ঘরানার প্ল্যান্টার্স ক্লাব, অফিস-কাছারি, বাজার, খানিক এগিয়ে মল এলাকা। নিজেদের মতো করে দার্জিলিং শহরের এই অঞ্চলটিকে সাজিয়ে নিয়েছিল ইংরেজরা। নতুন পরিচয় এখানে, দেখাসাক্ষাৎ, শপিং। নেটিভ দার্জিলিংবাসীর মধ্যেও চারিয়ে গিয়েছে সে অভ্যাস। পরিকাঠামোটা তো ভেবেচিন্তে করা হয়েছিল। ভ্রমণার্থীরা দার্জিলিংয়ে সাক্ষাতের প্রসঙ্গে ‘মলে দেখা হবে’ বলে থাকেন। আঞ্চলিক দার্জিলিংবাসীরা ঘন্টাঘরে দেখা করার কথা বলেন।
ওই চত্বরেই রয়েছে দার্জিলিং শহরের পুরনো সুপার মার্কেট। একটি নতুন সুপারমার্কেট হয়েছে এখন। চলে আসুন জজ বাজার। বাজার অঞ্চল দেখতে পারেন। জজ বাজারের পথ ধরে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের দার্জিলিং স্টেশনে চলে আসতে পারেন। পাহাড়ে এ পথের শেষ স্টেশন। স্টেশন থেকে একটু উপরের দিকে সেন্ট কলম্বাস চার্চ। আলো-ছায়ায় কত তার বর্ণ বদল।
পড়তে পারেন
‘দার্জিলিংয়ের চিড়িয়াখানায় খানিকটা সময়’
https://torsa.in/some-time-at-darjeeling-zoo-this-summer/
চকবাজার থেকে ফের লেবং কার্ট রোড ধরে চলে আসা যায় দার্জিলিংয়ের পুরনো গোরস্থানে। ‘হিল কুইন’ দার্জিলিং নিয়ে স্বপ্নদর্শী অনেক গোরা চিরনিদ্রায় রয়েছেন এখানে। খুব যে যত্নে আছে এই কবরখানা এ দাবি করা যাবে না। জায়গাটা দুর্দান্ত। আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে চমৎকার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় এখান থেকে।
কাছেই সেন্ট জোসেপস স্কুলের ভবনটি যেন শিল্পীর আঁকা বিশালাকার ছবি। ওপরের দিকে রয় ভিলা। সিস্টার নিবেদিতা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন এই ভবনটিতে।
চকবাজারে ফিরে আসা যাক। ফিরতি পথে শেয়ার জিপ পাওয়া যাবে।
ক্লক টাওয়ার থেকে নেহরু রোড ধরে মলের দিকে চলা রাস্তায় কেভেন্টার্স ও গ্লেনারিজ, শতবর্ষ পেরনো দুই রেস্তোরাঁ। গ্লেনারিজ চিরকালই গ্লেনারিজ ছিল না। আগে এর নাম ছিল ‘ভাডো’। স্বাধীনতার পরে মালিকানার হাতবদল হয়। নাম বদলে হয় ‘কেভেন্টার্স। ঢুকে পড়া যেতে পারে যে-কোনওটিতে।
পড়তে পারেন
‘দার্জিলিংয়ের কুঙ্গায় তিব্বতের আস্বাদ’
https://torsa.in/taste-of-tibet-at-kunga-in-darjeeling/
মলে যাওয়ার পথে পড়বে দাস স্টুডিও (১৫, নেহরু রোড)। দার্জিলিংয়ের সবচেয়ে পুরনো স্টুডিও। ঠাকুরদাস প্রধান ১৯২৭ সালে স্টুডিও খুলেছিলেন। দার্জিলিং ও হিমালয় বিষয়ে মূল্যবান সব আলোকচিত্র রয়েছে এখানে। স্টুডিও ঘুরে দেখা যায়।
তারপরে মল চত্বর। কবি ভানুভক্তের মূর্তির মুখোমুখি দাঁড়ালে মল থেকে সিঁড়িপথে একটু নীচে ‘স্টেপ অ্যাসাইড’। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়ি। এখানেই মৃত্যু হয় তাঁর। এখন ভবনটি একটি মিউজিয়াম। স্টেপ অ্যাসাইডের পাশ দিয়ে ঢালু রাস্তাটি ধরে নেমে গেলে ভুটানি বস্তির মধ্যে দিয়ে প্রাচীন স্মৃতিবাহী নিরালা এক মনাস্ট্রির দেখা পাওয়া যাবে। ওখান থেকেও পরিষ্কার আবহাওয়ায় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়।
মল-লাগোয়া অবজার্ভেটরি হিলে মহাকাল মন্দির। সিঁড়ি বেয়ে খানিকটা উপরে উঠতে হয়। মহাকাল মন্দিরের পাহাড়ের নীচে মল রোড। এটা মল রোডের ডান দিক। বাঁ-দিকের রাস্তাটি দিয়ে হাঁটলে চোখে পড়বে সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চ (St. Andrew’s Church). পাশের বার্চ হিলে রাজভবন। ছিল কোচবিহারের রাজাদের প্রাসাদ। ১৮৭৭ সালে লেফট্যানেন্ট-গভর্নর স্যার অ্যাসলে ইডেনের অধিকারে আসে ভবনটি। এখনো এটি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের পার্বত্য আবাস। পাহাড়ের রাজভবন।
ওই মল রোডে রাজভবনের পাশে জিমখানা ক্লাব। তৈরি হয়েছিল ১৯০৯ সালে। হেরিটেজ ক্লাব ভবনটি অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। ক্লাবের অস্থায়ী সদস্য হওয়া যায়। ক্লাবের ফোন নম্বরঃ 354-2254342.
মল থেকে সোজা পথে নেহরু রোড ধরে ৩০ মিনিটের হাঁটাপথে পৌঁছানো যায় দার্জিলিংয়ের চিড়িয়াখানা (পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক) ও হিমামালয়ান মাইন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে। লেবং কার্ট রোড হয়েও এ চত্বরে আসা যায়।
মল থেকে একটু হেঁটে গেলে কনভেন্ট রোড। এখানে লোরেটো কনভেন্ট স্কুল। প্রতিষ্ঠা ১৮৪৬ সালে। দু’জন ছাত্রী নিয়ে স্কুলের শুরু। গার্লস স্কুল। কালক্রমে দার্জিলিংয়ের লোরেটো কনভেন্ট ভারতখ্যাত আবাসিক স্কুল হয়ে উঠেছে।
ক্লক টাওয়ার থেকে গান্ধী রোড ধরে মিনিট পনের হেঁটে পৌঁছানো যায় বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর একদা বাসভবনে। এখন ভবনটি বোস ইনস্টিটিউটের দার্জিলিং কেন্দ্র। বাড়িটির স্থাপত্য-নান্দনিকতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আচার্য নন্দলাল বসু এবং আরও অনেকের পরামর্শ নিয়েছিলেন বিজ্ঞানী। ১৯২০ সালে বাড়িটি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। আচার্য জগদীশ চন্দ্র এখানে মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন বলে বসু বিজ্ঞান মন্দির জানাচ্ছে।
রাস্তায়, দোকান-বাজারে সঙ্গে থাকবেন পাহাড়ের মানুষজন। আলাপচারিতায় দার্জিলিংয়ের কত গল্প শোনা যায়।
পড়তে পারেন
‘ছবি ও কথায় সাদা অর্কিডের কার্শিয়াং’
https://torsa.in/kurseong-of-white-orchids-in-pictures-and-words/
ফটো সৌজন্য
দার্জিলিং জেলা প্রশাসন
উদান হোটেলস ও রিসর্টস
ইন্ডিয়া পোস্ট
মহাকাল মন্দির কর্তৃপক্ষ
দাস স্টুডিও
লোরেটো কনভেন্ট স্কুল, দার্জিলিং
বোস ইনস্টিটিউট