Follow us
Search
Close this search box.

দার্জিলিংঃ মল থেকে হাঁটাপথে ভুটিয়া বস্তি মনাস্ট্রি

দার্জিলিংঃ মল থেকে হাঁটাপথে ভুটিয়া বস্তি মনাস্ট্রি

চৌরাস্তা বা মল চত্বরটি দার্জিলিং শহরের প্রাণকেন্দ্র। মলের এক প্রান্তে নেপালি কবি ভানুভক্ত আচার্যের মূর্তি চোখে পড়বে। সেই মূর্তির দিকে মুখ করে দাঁড়ালে মলের ডান প্রান্ত থেকে নীচের দিকে নেমে যাওয়া একটি রাস্তা পাওয়া যাবে। এখন কাফে কফি ডে (সিসিডি) দার্জিলিং মলের একটি দিকচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই কাফে কফি ডে-র পাশ দিয়েই নেমেছে আমাদের আলোচ্য রাস্তাটি। এই রাস্তাটি দুটি ভাগে বিভক্ত। সোজা পথটি গিয়েছে পাহাড়ের অভ্যন্তরের বসতির দিকে। আরেকটি রাস্তা গেছে বাঁয়ে। ধরবেন ওই বাঁ-হাতি রাস্তাটি।

একটু এগোন ওই রাস্তা ধরে। বাঁদিকে পড়বে ‘স্টেপ অ্যাসাইড’। বাড়িটির বর্তমান নাম ‘দেশবন্ধু মিউজিয়াম’। এটি ছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের দার্জিলিংয়ের বসতবাড়ি। আঞ্চলিক মানুষের কাছে বাড়িটি স্টেপ অ্যাসাইড নামেই পরিচিত। এই বাড়িতেই দেশবন্ধু মারা যান। দেশবন্ধুর সঙ্গে পরামর্শের জন্য এ বাডিতে এসেছেন মহাত্মা গান্ধী। কয়েকদিন তিনি ছিলেনও এখানে। এসেছেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক অ্যানি বেসান্ত। খোলা পেলে স্টেপ অ্যাসাইডের মধ্যে একবার ঢুঁ মারতে পারেন। অনেক ঐতিহাসিক দলিল রয়েছে এখানে।

স্টেপ অ্যাসাইড থেকে বেরিয়ে ওই পথ ধরেই মলের সীমানা ছাড়িয়ে আরও এগিয়ে চলুন। রাস্তা আরও ঢালু হতে থাকবে। তারপর সেই রাস্তার কখনো দু’ধারে, কখনো একধারে বাড়ির সারি শুরু হবে। বুঝবেন, আপনি ভুটিয়া বস্তির সীমানায় ঢুকে পড়েছেন। এটা দার্জিলিংয়ের ভুটিয়া পাড়া। পাহাড়ের বিভিন্ন জনবসতি বস্তি হিসেবে পরিচিত হয়। এর সঙ্গে আমাদের শহুরে বস্তির মিল নেই। ভুটিয়া বস্তির ছোট ছোট একতলা, দোতলা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাড়িঘর এবং বাড়ির বারান্দায়, প্রাচীরে বা এক টুকরো খোলা জায়গায় ফুটে থাকা রং-বেরঙের ফুলের সমারোহ লক্ষ্য করা যাবে।

বাড়ির ব্যালকনি থেকে বাচ্চারা হাত নাড়ায়। পথের বাঁকে ক্যারাম খেলায় ব্যস্ত তরুণের দল। মহিলারা কর্মব্যস্ত। এই মহিলাদের অনেককেই বিকেলে মহাকাল মন্দিরের নীচে ম্যাল রোডের ভুটিয়া বাজারে দেখা যাবে। প্রধাণত শীতবস্ত্রের বাজার। প্রিয়াঙ্কা চোপড়া ও রণবীর কাপুর অভিনীত ‘বরফি’ সিনেমার কিছু দৃশ্য এই ভুটিয়া বস্তিতে শ্যুট করা হয়েছিল। সেই সিনেমার কল্যাণে কিছু মানুষের আনাগোনা শুরু হয়েছিল ভুটিয়া বস্তিতে। সে টানে ভাটা পড়েছে। ম্যালে যখন প্রচুর ভ্রমণার্থীর সমাগম, তখনো ভুটিয়া বস্তির রাস্তায় দার্জিলিং বেড়াতে আসা মানুষের পদচারণা বিরল প্রায়। এই রাস্তাটিই ভুটিয়া বস্তির উঠোন। ভুটিয়া বসতির ছবি দেখতে দেখতে এগিয়ে চলুন।


দার্জিলিঙে ঘুম স্টেশনের কাছে টয়ট্রেনের ট্র্যাকে “বরফি” সিনেমার একটি দৃশ্যে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া ও রণবীর কাপুর। ফটো: বলিউড হাঙ্গামা।

উৎরাই পথে নামতে কষ্ট হয় না। নেমে চলুন। মনে রাখতে হবে, ওই পথ ধরেই কিন্তু ফের উঠে আসতে হবে। তখন একটু পরিশ্রম হবে বটে। থেমে থেমে উঠবেন। দেড় কিলোমিটার পথ পেরিয়ে আপনি পৌঁছাবেন একটি বৌদ্ধ মন্দির তথা মনাস্ট্রির প্রবেশদ্বারে। ঢুকে পড়ুন মনাস্ট্রির চত্বরে।নাম কর্মা দর্জি চাইয়োলিং মনাস্ট্রি। তবে ভুটিয়া বস্তি মনাস্ট্রি নামেই খ্যাত। এটিই দার্জিলিংয়ের প্রাচীনতম মনাস্ট্রি বলে এ পর্যন্ত স্বীকৃত।

একসময় এই মনাস্ট্রির অবস্থান ছিল অবজার্ভেটরি হিলে, মহাকাল মন্দিরের প্রায় পাশেই। ১৭৮৮ সালে গোর্খা আক্রমণে প্রভূত ক্ষতি হয় মনাস্ট্রির। কিছুকালের জন্য মনাস্ট্রির স্থান হয়েছিল ম্যাল থেকে চিড়িয়াখানায় যাওয়ার রাস্তার পাশে অবস্থিত সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চের কাছে। শেষপর্যন্ত ১৮৬০ সালে মনাস্ট্রি চলে আসে ভুটিয়া বস্তি-সংলগ্ন তার বর্তমান ঠিকানায়।

ঘুরেফিরে দেখুন মনাস্ট্রি চত্বরটি। মনাস্ট্রির পিছন দিক থেকে পরিষ্কার দিনে চমৎকার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। মনাস্ট্রির দরজা বন্ধ দেখলে একটু অপেক্ষা করুন। আদিতে সিকিমের ফোডং মনাস্ট্রির একটি শাখা ছিল এখনকার এই মনাস্ট্রি। লাল বস্ত্রধারী সন্ন্যাসী তথা লামা সম্প্রদায়ের (রেড সেকট) উপাসনাস্থল সিকিমের ফোডং মনাস্ট্রি এবং দার্জিলিংয়ের এই কর্মা দর্জি চাইয়োলিং মনাস্ট্রি। ভিতরে ঢুকলে মনাস্ট্রির অন্দরসজ্জায়, ফ্রেস্কোতে, দেওয়াল চিত্রণে তিব্বতি প্রভাব চোখে পড়বে।

আচমকা আপনার সামনে আবির্ভূত হতে পারেন মনাস্ট্রির দায়িত্বপ্রাপ্ত লামা। নিয়ে যাবেন ভিতরে। দেখাবেন ভিতরটা। দেওয়াল-চিত্রগুলিতে তান্ত্রিক প্রভাব স্পষ্ট। পুরনো মনাস্ট্রি। একবার দেখেছিলাম, নববিবাহিত এক হিন্দু নেপালি দম্পতি দলবল, বাজনদার প্রভৃতি-সহ মনাস্ট্রিতে এসেছেন আশীর্বাদ নিতে। এটা এখানকার নিয়মিত চিত্র।

পুজোয় বা গ্রীষ্মের মরসুমে দার্জিলিংয়ে বেড়াতে আসা বিপুল সংখ্যক ভ্রমণার্থীর মধ্যে গুটিকয়েক মানুষ হয়তো ভুটিয়া বস্তির মনাস্ট্রি দেখতে আসেন। ওই রাস্তা ধরে ভুটিয়া বস্তির চালচিত্র দেখতে দেখতে পথ চলা এবং মনাস্ট্রি দর্শন বেশ লাগে। একদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পরে গুটি গুটি পায়ে রাস্তাটি ধরতে পারেন। যাতায়াত মিলিয়ে মোট ৩ কিলোমিটারের পদযাত্রা। উঠে আসার সময়ে বয়স্করা ধীরে ও থেমে থেমে উঠুন। রাস্তা ক্রমশ উৎরাই। তাই অসুবিধা হয় না।

ভুটিয়া বস্তি মনাস্ট্রি বেড়িয়ে ম্যালে ফিরবেন। নামা-ওঠার রাস্তায় হেঁটে আসার পরে খিদেটা চনমনিয়ে উঠবে। এবার জমিয়ে মধ্যাহ্নভোজ। এক বেলার চমৎকার একটি বেড়ানো।

দার্জিলিং মলের ফটো সৌজন্যঃ হোটেল ড্রিমল্যান্ড।
সাদা বাড়িটি ‘স্টেপ অ্যাসাইড’ ভবন (দেশবন্ধু মিউজিয়াম)।

দেবযানী সরকারের ‘দার্জিলিংয়ের চিড়িয়াখানায় খানিকটা সময়, এই গ্রীষ্মে’ ও ‘দার্জিলিংয়ের কুঙ্গায় তিব্বতের আস্বাদ’ শীর্ষক লেখা দুটি পড়তে পারেন নীচের দুই লিঙ্কে।

https://torsa.in/some-time-at-darjeeling-zoo-this-summer/
https://torsa.in/taste-of-tibet-at-kunga-in-darjeeling/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *