অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় তখন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রবার্ট ক্লাইভ ষড়যন্ত্রের জাল বুনছেন। লক্ষ্য, বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় নবাবি শাসনের পতন ঘটানো। এরকম সময় ও পরিস্থিতিতে চৌথা তথা কর আদায়ের জন্য বাংলা আক্রমণে আসা দুদ্ধর্ষ মারাঠা বর্গীদের কোনও কোনও গোষ্ঠী সুফলা বাংলায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। বর্গী কুন্দনদের একাংশ হুগলিতে নোঙর ফেলল। পত্তন হল তাঁদের জমিদারির। বাংলার জল-হাওয়ায় কালক্রমে মারাঠা কুন্দনদের পদবী হল কুন্ডু।
সেই কুন্ডু পরিবারে জমিদার সাফল্য নারায়ণ কুন্ডুর আমলে হুগলির খন্যান এলাকার নদীর পারে ইটাচুনা গ্রামে পেল্লায় এক প্রাসাদের গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হল। মাথা তুলে দাঁড়াল ইটাচুনা রাজবাড়ি। সে ১৭৬৬ সালের কথা। আঞ্চলিক মানুষজন সেই প্রাসাদ ও সংলগ্ন এলাকাকে ‘বর্গীডাঙ্গা’ বলে চিনল। স্বাধীনতার পর জমিদারি ব্যবস্থার অবলুপ্তির আগে পর্যন্ত কুন্ডুদের জমিদারি চলেছে বেশ সুনামের সঙ্গেই।
বাংলা তথা এ দেশের ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণের স্মারক এই ইটাচুনা রাজবাড়ি। প্রকৃতপক্ষে জমিদার বাড়ি। তবে লোকমুখে ইটাচুনার প্রাসাদ রাজবাড়ি হিসেবেই পরিচিত হয়ে উঠেছিল বহুকাল আগেই। কয়েকবছর ধরে ইটাচুনা রাজবাড়ির একাংশ হেরিটেজ হোমস্টে হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বিশাল প্রাঙ্গনের চারদিক জুড়ে বিভিন্ন মহল। বিরাটাকার বৈঠকখানা, উঁচু সিলিং থেকে ঝুলছে অ্যান্টিক সব ঝাড়বাতি। হাতে টানা প্রাচীন পাখা, বনেদি আসবাবপত্র, টানা দরদালান, চওড়া চওড়া সিঁডি, সন্ধ্যায় ঠাকুরদালানে আরতি, রাজকীয় পরিবেশে বিশ্রাম, জব্বর খাওয়াদাওয়া, সঙ্গে গ্রাম দর্শন, কাছেপিঠে বেড়ানো, সব মিলিয়ে ইটাচুনা রাজবাড়িতে সপ্তাহ শেষের বা কোনও ছোট ছুটির অবকাশযাপন এক অন্যরকমের অভিজ্ঞতা।
বর্ধমানগামী কোনও ট্রেনে উঠে পড়ুন। নামবেন খন্যান স্টেশনে। হাওড়া থেকে ঘন্টা দেড়েক সময় লাগবে। স্টেশন থেকে টোটোতে ১০ মিনিট। পৌঁছে যাবেন প্রচুর গাছগাছালি আর জলাশয়ে ঘেরা ইটাচুনা গ্রামে। প্রবেশ করবেন অনেক ইতিহাসের সাক্ষী ইটাচুনা রাজবাড়িতে।
কান পাতলে রাজবাড়ির অন্দরের অলিগলিতে রাতের শান্ত মৃদু আলোয় অতীতের ফিসফিস শোনা যেতেও পারে। দু’দিকে সুউচ্চ প্রাচীর, বহু উঁচু থেকে ঝুলছে স্থির হয়ে থাকা আলো, নৈঃশব্দ, নিজের পায়ের আওয়াজ কানে আসছিল এরকম অলিন্দে পদচারণের সময়। ওই রাস্তাগুলিতে অন্যরকম লাগে তো বটেই। ওই দেওয়ালগুলিতে রাজবাড়ির কতই না ঘাতপ্রতিঘাত প্রতিধ্বনিত ও প্রতিফলিত হয়েছে। সকালে রাজবাড়ির বিশালাকার ছাদ থেকে গ্রামের সবুজ, সূর্যের উদয় দেখে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ এর কথা মনে পড়তে পারে। কুন্ডু পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের কিছু সদস্য এখনও এই রাজবাড়িতেই, অন্য অংশে বসবাস করেন।
ইটাচুনা রাজবাড়িতে অতিথিদের থাকার ঘরগুলির নাম এরকমঃ বড় বৌদি, ছোট বৌদি, ঠাকুমা, বড় পিসি, গিন্নি মা, বড় মা, মেজ মা, জ্যাঠামশাই, পিসেমশাই ইত্যাদি। নামগুলির মধ্যে পরম্পরার প্রতি সম্মান ও সেইসঙ্গে আন্তরিক আতিথেয়তার ইঙ্গিত মেলে। দ্বিশয্যা ব্যবস্থার ঘরে রাতপিছু থাকার খরচ ঘর, ঘরের অবস্থান অনুসারে ৩,০০০-৫,০০০। অতিরিক্ত সদস্যের জন্য আলাদা খরচ ধার্য হবে। ৫ জনের থাকার উপযোগী ঘরের ভাড়া ৮,৯০০ টাকা। সবক্ষেত্রেই সঙ্গে নির্দিষ্ট হারে জি এস টি যুক্ত হবে। ঘরের অন্দরসজ্জায় বনেদি ঐতিহ্যের পরিচয় পাওয়া যাবে। দামি কাঠে বাঁধানো বড় বড় আয়নাগুলিতে কাদের কাদের ছায়া পড়েছে কে জানে।
খাওয়াদাওয়ার খরচ আলাদা। খাওয়ার পাতে বনেদি ঘরানার সঙ্গে আরেকপ্রস্থ পরিচয় ঘটবে। এই বর্ষাতেই এখানে খেয়েছি বেগুন ও কালোজিরে দিয়ে ইলিশের ঝোল। কাঁসার থালা-গেলাস, খাবারের থালা-বাটির সজ্জা তিলে তিলে গড়ে ওঠা একটা ঐতিহ্যের ঝলক দেখা যাবে। কিচেনে নেতৃত্ব দেন প্রভাতী দেবী। ওঁনার পরিবারের সদস্যরা বংশ পরম্পরায় রাজবাড়ির হেঁসেল সামলেছেন। প্রভাতী দেবী ঐতিহ্যবাহী নানা পদ রান্নার রহস্য জানেন।
ইটাচুনার আশেপাশে
রাজবাড়ি থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ২০০ বছরের পুরনো মহানাদ কালিবাড়ি। বলা হয়, রানী রাসমণি এই মন্দিরে পুজো দিতে এসেছিলেন এবং মন্দিরটি দেখে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির স্থাপবের ব্যাপারে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। মহানাদ কালিবাড়ি থেকে ২ কিলোমিটার দূরে জটেশ্বর শিব মন্দি। কাছাকাছির মধ্যে দেখে নেওয়া যায় দেবীপুরের টেরাকোটা শৈলীর লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির ও পাণ্ডুয়ার ত্রয়োদশ শতকের ১২৫ ফুট উচ্চতার মিনার। ইটাচুনা রাজবাড়ি থেকে হংসেশ্বরী মন্দির ২০ কিলোমিটার।
যাওয়ার পথ
মেন লাইনে বর্ধমানগামী কোনও ট্রেনে চড়ে নামতে হবে খন্যান স্টেশনে। হাওড়া থেকে মেমারি বা পাণ্ডুয়া লোকালেও ওঠা যায়। ব্যান্ডেলের পর চতুর্থ স্টেশনে খন্যান। খন্যানের আগের স্টেশন তলাণ্ডু। খন্যান স্টেশনে নেমে অটো, টোটোয় ১০ মিনিটের পথ ইটাচুনা রাজবাড়ি।
নিজেদের গাড়ি নিয়ে সড়কপথে যেতে চাইলে দ্বিতীয় হুগলি সেতু বা দক্ষিণেশ্বর হয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরতে হবে। প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পর বাঁ-দিকে আজাদ হিন্দ ধাবা ও হিন্দুস্থান হোটেল পেরিয়ে বাঁয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে আসবেন বসীপুর। এখান থেকে সোজা রাস্তায় ১৯ কিলোমিটার চলার পরে পৌঁছাবেন হালুসাই। হালুসাই যেতে বাঁয়ে ঘুরে একটু এগলেই খন্যান রেলস্টেশন। এখান থেকে মিনিট দশেকে ইটাচুনা রাজবাড়ি।
ইটাচুনা রাজবাড়ির (হেরিটেজ হোমস্টে) সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরঃ ৯১৪৭০ ৮৭১১৪, ৯৮৩০৫-৪৭৭৫৯।
ফটোঃ মহানাদ কালিবাড়ি ও জটেশ্বর শিবমন্দির
ছাড়া অন্য সবক’টি ফটো ও ভিডিও লেখক।
‘মহেশগঞ্জ এস্টেটের বালাখানা প্রাসাদে’ লেখাটি পড়তে পারেন এই লিঙ্কেঃ https://torsa.in/balakhana-palace-of-mahesgunge-estate/