Follow us
Search
Close this search box.

বকখালি ফ্রেজারগঞ্জ জম্বুদ্বীপ

বকখালি ফ্রেজারগঞ্জ জম্বুদ্বীপ

ফ্রেজারগঞ্জ ও বকখালি 

দিঘার সহচর যেমন শঙ্করপুর, বকখালির তেমন ফ্রেজারগঞ্জ। এক ভ্রমণে দুই সৈকত। অন্যথায় ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

জম্বু দ্বীপে। সৈকত ধরে বেড়াতে বেড়াতে চলুন পুব পানে। ডাইনে সমুদ্র। বাঁয়ে মৎস্যজীবী মনুষজনের জীবনযাপন। সৈকতে লাল কাঁকড়ার অসংখ্য ঘরবাড়ি, মাটির নীচে। ওরা সারাটা পথ থাকবে আপনার সঙ্গে। চকিতে ঝাঁকে ঝাঁকে কাঁকড়া অন্তর্হিত হবে আপনার আগমনে, ধরিত্রীর অন্দরে। একটু দূরেই ভেসে উঠবে আবার, অন্য দল। এভাবেই অপার্থিব এক লুকোচুরি খেলা চলতে থাকবে লাল কাঁকড়াদের। জোরে হাঁটলে কমবেশি আধ ঘন্টা। বেড়াতে বেড়াতে চলুন না কেন ! বেড়াতেই তো আসা। এ তো রোজকার দৃশ্য নয়। সমুদ্রকে সঙ্গে করে কখন ২ কিমি পথ বেয়ে এসে পৌঁছাবেন বকখালি। উল্টোটআও হতে পারে। বকখালি থেকে ফ্রেজারগঞ্জ।

কালে কালে বকখালি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রচুর হোটেল, লজ, রেস্তোরাঁ বকখালিতে। বেশিরভাগ ভ্রমণার্থীর মূল গন্তব্য বকখালি সৈকত। সেখান থেকে ফ্রেজারগঞ্জ, আর চাইলে জম্বুদ্বীপ বেরিয়ে আসা।

আমরা শুরু করেছি ফ্রেজারগঞ্জ থেকে। আসলে ফ্রেজারগঞ্জ থেকে যে যাত্রার শুরু হয়েছিল, ফ্রেজারগঞ্জ ও বকখালি মিলিয়ে সেই সৈকত অন্তত ৭ কিমি দীর্ঘ। আরম্ভ করা যায় যে কোনো প্রান্ত থেকেই। গোটা সৈকতটাই অত্যন্ত শান্ত। ভাটায় সমুদ্র দূরে সরে যায়। তখন সদ্য স্নান করে ওঠা সেই বালুকাবেলার আরেক রূপ। নিরাপদে খানিকটা গিয়ে দেখে আসা যায়। ছোট্ট জলে আটকে পড়েছে হয়তো কোনও জেলিফিশ। উপড়ে আসা নাম-না-জানা সামুদ্রিক উদ্ভিদ। সামুদ্রিক শামুক, শঙ্খ, শ্যাওলা। সামুদ্রিক প্রাণের নানা উদাহরণ স্নিগ্ধ সৈকত জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। একটু চোখ খোলা রাখলেই হলো। জীবনবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের কাছে সে জীবন্ত এক গ্যালারি। চোখ মেললেই ধূ ধূ চড়াতেও প্রকৃতির নানা কিসিমের বুনোন চোখে পড়তেই পারে। আটকে পড়া জলে ঝিলিক দিচ্ছে তীব্র আলো। প্রতিফলিত সূর্য। একটু দূরে অতিকায় কোনো মাছের মাথাটা শুধু ভেসে এসে আটকে পড়েছে। প্রতি জোয়ার-ভাঁটাতেই সৈকত অন্য হয়ে ওঠে। রং-রূপ-অবয়ব পাল্টে যায় প্রতিবার। সমুদ্র নানা ছবি আঁকে সৈকতে। বকখালির বালিতেও লালকাঁকড়ার মাতামাতি খুবই। ওরা ঘরদোর তৈরি করার সময়ে মাটিতে আল্পনা আঁকে। মাটিতে সুড়ঙ্গ তৈরির সময়ে গোলমরিচের মতো দেখতে, আকারে ছোট, অসংখ্য মাটির পুঁটি তৈরি হয়। সেগুলি ছড়িয়ে ফেলার কায়দাটা গর্ত তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গেই যুক্ত। কায়দাটা আল্পনা আঁকার মতো। এইসব রূপকারেরা সমুদ্রতীরে আল্পনা আঁকতেই থাকে। ঢেউ এসে ধুইয়ে দেয়, আবার আঁকা হয়। ভিতর-বাইরের খেলাটা চলতেই থাকে।

বকখালি বাসস্ট্যান্ড থেকে সৈকত সামনেই। এই বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন অঞ্চল জুড়ে হোটেল,লজ, রেস্তোরাঁ। বাসস্ট্যান্ডের উল্টোদিকে। আশপাশে আটপৌরে গ্রামজীবন। সৈকত ধরে ফ্রেজারগঞ্জের উল্টোদিক হাঁটতে হাঁটতে চলে যান সৈকতের শেষ প্রান্তে। সেখান থেকে বাঁদিকে ঘুরে ঢুকে পড়ুন কাজুবাদামের জঙ্গলে। কিছুটা এগলে বনবিবির থান। বনবিবি বনের দেবী। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সুন্দরবনের জল-জঙ্গলের অধিবাসীরা বনবিবিকে মান্য করে চলেন। এই অরণ্যকন্যা দেবীকে নিয়ে নানা উপকথা চালু আছে সমগ্র সুন্দরবনে। প্রসঙ্গত, সুন্দরবনের এক-তৃতীয়াংশ বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত। তা, সে অংশেও বনবিবির সমান দাপট।

ওই বকখালিকেও প্রাচীন জঙ্গল হাসিল করে মনুষ্য বাসযোগ্য করা হয়েছে। কিন্তু জঙ্গল-সম্পর্কিত আচার-অনুষ্ঠান রয়ে গেছে আঞ্চলিক জীবনচর্চায়। এই ফোর-জি নেটওয়ার্কের জমানাতেও সুন্দরবনের দ্বীপগুলিতে বনবিবির পালায় মানুষ উপচে পড়ে।

সুন্দরবনের দ্বীপগুলিতে খাঁড়ি, খালের ছড়াছড়ি, শিরা-উপশিরার মতো। খাঁড়ি আঞ্চলিক কথায় খালি। এখানকার নানা অঞ্চলের নামের সঙ্গে ‘খালি’ কথাটি যুক্ত হয়েছে। যেমন-সজনেখালি, ধামাখালি ইত্যাদি। এভাবে বকখালি। বাদাবনের জলকাদায় বকের অভাব নেই। প্রচুর বক-অধ্যুষিত একটি খাঁড়ি থেকে বা খালি থেকে লোকমুখে রচিত নাম বকখালি। সেই বকখালির গর্ব অর্ধচন্দ্রাকার, দীর্ঘ সৈকত। পরিচ্ছন্ন সৈকত, সমুদ্রতীর বরাবর কাজুগাছের সারি। লাল কাঁকড়া। শান্ত পরিবেশ।

বকখালির সৈকত মাটি-মিশ্রিত। সমুদ্রে নামতে গেলে এখানে সেখানে কাদা। স্নান করতে গেলে বরং ফ্রেজারগঞ্জের দিকে চলে যাওয়া ভালো। শুধু সৈকতের প্রশ্নই যদি ওঠে , তবে এটা বলতেই হয় যে, ফ্রেজারগঞ্জ-সংলগ্ন সৈকত গুণমানে উন্নত। সমুদ্রে নেমে অনেকটা পর্যন্ত বালি পাওয়া যায়।

রাতে বকখালি সৈকত অনেকটা জুড়ে আলোকিত। বেলাভূমির এই প্রবেশপথ-সংলগ্ন অঞ্চলটি জুড়ে নিত্যদিনের মেলা। চা-কফি, ঠাণ্ডা পানীয়, ঝালমুড়ি, ফুচকা, মাছভাজার অভাব হবে না। খাওয়ার জন্য দু-পা বাড়ালেই রেস্তোরাঁ। । রাজ ওয়েসিস,পারিজাত, নিরালা, সাগরকন্যা, রাজবালা প্রভৃতি রেস্তোরাঁ অনেকদিন ধরেই বকখালির ভ্রমণার্থীদের রসনা তৃপ্ত করে চলেছে। চাইনিজ, কন্টিনেন্টাল, মোগলাই? পেয়ে যাবেন। নানা পরবে বকখালি-ফ্রেজারগঞ্জে এখন ভালোই পর্যটক সমাগম হয়। তখন বকখালি জমজমাট। শীতে ভিড় বাড়ে। যাওয়া যায় বছরভরই। বর্ষায় ধূ-ধূ সৈকত জুড়ে বৃষ্টি। সে আরেক রূপ। রামধনু রঙের ছাতার নিচে বসে অলস সময় কাটাতে পারেন। বসার জন্য ঘন্টাপিছু চেয়ার ভাড়া পাওয়া যায়। ছোট খাবার দোকানগুলোতে আঞ্চলিক রন্ধন-প্রণালীর আস্বাদ পাওয়া যাবে। জেলেদের কাছ থেকে সামুদ্রিক মাছ কিনে এনে দিলে সামান্য দক্ষিনায় সেই মাছ ভেজে দেবেন দোকানিরা।

কাছেপিঠে :

বকখালি বাসস্ট্যান্ডের পিছনে বনবিভাগের পার্ক। ঢুকলেই ম্যানগ্রোভ নার্সারি। সুন্দরবনে নানা ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের চারা তৈরি হয়। আছে একটি কুমির প্রকল্প, ছোট আকারেই। কচ্ছপ প্রজননের জন্যও রয়েছে একটি জলাশয়। বেশকিছু হরিণ রয়েছে এখানে। তারপর বনকর্মীদের বাড়ি। আশেপাশে জঙ্গল। বেশিরভাগই ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ। সুন্দরী, গরান, হেঁতাল, কাঁকড়া– সব গাছের নাম। চলে যেতে পারেন একটু ভেতরে। চোখে পড়তে পারে হরিণ, বাঁদর, বুনো শুয়োর। আর হঠাৎ হঠাৎ পাখি।

 

সৈকত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফ্রেজারগঞ্জ। সৈকত ভ্রমণের সে অভিজ্ঞতা মনে রাখার মতো। সকাল সকাল গেলে মৎস্য বন্দরের জমজমাট ব্যস্ততা চোখে পড়বে। এডওয়ার্ড-ক্রিক (খাঁড়ি) ধরে সমুদ্র ফেরত নৌকা, ট্রলার এসে পৌঁছচ্ছে বন্দরে। রকমারি সব সামুদ্রিক মাছ। নিলামের পর সেইসব মাছ চলে যাচ্ছে দূরদূরান্তে। শংকরপুরে যেমন চম্পা নদীর মোহনা, ফ্রেজারগঞ্জে তেমন এডওয়ার্ড খাঁড়ির মোহনাকে কেন্দ্র করে মৎস্যবন্দর গড়ে উঠেছে। একটা দিন ফ্রেজারগঞ্জে থেকে যাওয়া যায়। বেনফিশের সুন্দর লজ রয়েছে ফ্রেজারগঞ্জে। মাছের বন্দর তো, সিগালের ওরাউড়ি বেশি এখানে। ফ্রেজারগঞ্জ শুঁটকি মাছের একটি বিশেষ উৎপাদন কেন্দ্রও। সমুদ্র পারে, খাঁড়ির ধারে রয়েছে মাছ শুকানোর দেশি পরিকাঠামো। শুকনো মাছ এই বঙ্গোপসাগরের কোল থেকে পাড়ি দেয় দেশের বিভিন্ন বাজারে। উত্তর-পূর্ব ভারতে রয়েছে বড় বাজার।

বকখালি থেকে গাড়িতে হেনরি আইল্যান্ড ৫ কিমি। ঘুরে আসা যায় কয়েক ঘন্টায়। বিশাল অঞ্চল জুড়ে মাছ চাষের বন্দোবস্ত দেখা যায় ঘুরে ঘুরে। ওয়াচ টাওয়ারে উঠে দূরে সুন্দরবনের রূপরেখা চাক্ষুষ করা যায়। আর ধৈর্য ধরে পাখি দেখার ইচ্ছে থাকলে তো হেনরি আইল্যান্ড এক স্বর্গরাজ্য। ফ্রেজারগঞ্জে থাকলে বকখালি তো আসতেই হবে। যাতায়াত মোটরভ্যানে। উপরি পাওনা জম্বু দ্বীপ।

জম্বুদ্বীপ

ফ্রেজারগঞ্জের ৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে একটি ছোট্ট দ্বীপ জম্বু। এটি একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলও। দ্বীপের মোট আয়তন ১৯৫০ হেক্টর। দ্বীপটিকে বেড় দিয়ে রয়েছে সাদা বালির তট। কাজু বাদামের জঙ্গল রয়েছে এই দ্বীপে। আর আছে নানা প্রজাতির পাখি, সমুদ্র তীরের কর্দমাক্ত জমিতে আটকে পড়া মাছ, পোকামাকড় এইসব পক্ষীকুলের খাদ্য।

জম্বু দ্বীপে মানুষের বসবাস নেই। ২০০১ পর্যন্ত মাছধরার মরশুমে মৎস্যজীবীরা এই দ্বীপে অস্থায়ী ছাউনি তৈরি করতো মাছ শুকনো ও থাকার জন্য। ২০০২ এর অগাস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে এই দ্বীপে মৎস্যজীবীদের সমস্তরকম কার্যকলাপ নিষিদ্ধ হয়।

স্বাভাবিকভাবেই জম্বু দ্বীপে থাকবার কোনও বন্দোবস্ত নেই। তবে বেড়িয়ে আসা যায় মোটর বোটে চড়ে। যাত্রার ব্যবস্থা রয়েছে ফ্রেজারগঞ্জ থেকে। মোটর বোট প্রথমে এডওয়ার্ড ক্রিক (খাঁড়ি) ধরে এগোবে খানিকটা। খাঁড়ির দু-ধারে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের জঙ্গল। এরপর সমুদ্রপথে নৌযাত্রা। ৩০-৪০ মিনিটের রোমাঞ্চকর জলযাত্রা মনে রাখার মতো। যাওয়ার পথে বাঁদিকে, দূরে একটা ছোট্ট দ্বীপ নজরে আসবে। ওটা সুন্দরবনের লোথিয়ান দ্বীপ।

জম্বু দ্বীপ থেকে আদিগন্ত সমুদ্র দেখবেন, পাখি দেখবেন, লাল কাঁকড়ার ব্যস্ততা দেখা যাবে, তবে জম্বু দ্বীপকে বেড় দিয়ে মাছের জগৎটা দেখা যাবে না। মাছের এক বিরাট জগৎ রয়েছে জম্বু দ্বীপ সংলগ্ন সমুদ্রে।

যাওয়ার পথ :
থাকার ব্যবস্থা :

বেনফিশের সাগরকন্যা টুরিস্ট লজ ফ্রেজারগঞ্জে থাকার ভালো ব্যবস্থা। (০৩৩)২৩৫৭-৫২১৫, (০৩৩)২৩৫৫-৪৯৩১।

বকখালি
বে ভিউ টুরিস্ট লজ – ৯৮৩৬১-৩৫৯৪২, ৯৬৪৭০-৩৯৪৪৮।
বলাকা লজ – ৯০০৭৭৪১৫৫০।
হোটেল অমরাবতী – ৯৭৩২৬১৯৩৪০।
হোটেল আইকন হেরিটেজ – ৮৫১৪৯১২১১৬, ৯৮৩০২০৩৭৯৫।
হোটেল ডলফিন – ৮৩৩৬৯১৬৮৬০, ৯৪৩৩৫৪৬৪১৭।
হোটেল দীপক – ৯৭৩২৬০৪৮৩৩।
হোটেল ইনোদয়- ৯১৬৩৬৮০১১১, ৯০৭৩৯৬০৯৯৫।
সাগরবেলায় গেস্টহাউস – (০৩৩)২৪৫৩৫৮১৭।
নারায়ণী লজ – ৭৭৯৭১১৬৪৯৯।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *