নভেম্বর থেকে জানুয়ারি, আরও নির্দিষ্ট করে বলতে হলে, মাঝ-নভেম্বর থেকে মাঝ-জানুয়ারি, সিটং কমলা বর্ণ ধারণ করবে। সকালে পাকা কমলা থেকে টুপ টুপ ঝরে শিশির বিন্দু।
সবুজ আর কমলার মিশেল সে এক আশ্চর্য রংবাহার। সেই অবাক করা ক্যানভাসে দূরের নীল আকাশে শুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। পথের পাশে নাম না জানা ফুল। এদিক ওদিক থেকে ভেসে আসে পাখির ডাক। সকালে রোদ উঠলেই নানা রঙের প্রজাপতি ওড়ে। হঠাৎ চোখে পড়তে পারে অর্কিডগুচ্ছ।
মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট, হরিয়াণা, পাঞ্জাব থেকে কমলালেবু বাজারে পৌঁছে যায় শীতের শুরুতেই। আমাদের রোমান্টিকতা, নস্টালজিয়া জড়িয়ে আছে যে কমলা-ঘরানারটির সঙ্গে, সেই দার্জিলিংয়ের কমলালেবু বাজারে আসে একটু পরে। মাঝ-নভেম্বর বা ডিসেম্বরের গোড়া থেকে দার্জিলিংয়ের বাগিচাগুলোতে কমলালেবুর ফলন তোলা শুরু হয়। চলে ডিসেম্বরের শেষ, কখনো কখনো জানুয়ারির কিছুটা সময় পর্যন্ত।
আকারে তুলনামূলক ভাবে একটু ছোট, কিন্তু স্বাদে-সুঘ্রাণে অতুলনীয় পাতলা খোসার পাহাড়ের লেবুটি। দার্জিলিংয়ের যেমন কাঞ্চনজঙ্ঘা, দার্জিলিংয়ের যেমন চা, তেমনই দার্জিলিংয়ের কমলালেবু।
দার্জিলিংয়ের মিরিক, লাবডা, সিটং খাসমহল, মংপু এবং কালিম্পংয়ের সাংসে, বিদ্যাং, মুনসং প্রভৃতি অঞ্চলে কমলালেবুর বাগিচা রয়েছে। সবটাই দার্জিলিংয়ের কমলালেবু পরিচয়ে খ্যাত। একটি নয়, কয়েকটি গ্রাম নিয়ে সিটং খাসমহল। দার্জিলিংয়ে কমলালেবু উৎপাদনের ক্ষেত্রে সিটং খাসমহল একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। দার্জিলিং জেলার কার্শিয়াং ব্লকের সিটং গ্রামটিতে বছরভরই পর্যটকদের আনাগোনা লেগে থাকে। শান্ত প্রকৃতি। হৈ-হুল্লোড়ের নামগন্ধ নেই। কান পেতে প্রকৃতির ভাষা শুনতে হয় এখানে।
সিটংয়ের গড় উচ্চতা ৪৫০০ ফুট। অনেকগুলো গ্রাম নিয়ে সামগ্রিক সিটং। সিটংয়ের প্রায় প্রতি বাড়িতেই রয়েছে ছোট-বড় কমলালেবুর বাগান। গ্রাম বেড়ান হেঁটে। জঙ্গলে ঘেরা প্রকৃতির কত রূপ রস গন্ধ বর্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে। অনাবিল আনন্দময় পরিবেশ।
নিখাদ প্রকৃতির মধ্যে আঞ্চলিক নানা উপকরণ দিয়ে তৈরি একটি মনাস্ট্রি আছে আপার সিটংয়ে। সেই মনাস্ট্রি-চত্বর থেকে দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের দৃশ্য অনেক দিন চোখে ও মনে ভেসে থাকবে।
সিটংয়ে নানা পাখির দেখা পাবেন। রুফাস-নেকড হর্নবিলের দেখা পাওয়া যায় সিটংয়ে। তবে বার্ড ওয়াচিংয়ে বিশেষ ঝোঁক থাকলে চলে যান লাটপাঞ্চারে। নানা প্রজাতির পাখির ডেরা হিসেবে লাটপাঞ্চার এখন পরিচিত নাম। সিটং থেকে লাটপাঞ্চার ৭ কিলোমিটার। মহানন্দা বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্যের সর্বোচ্চ স্থান এই লাটপাঞ্চার। লেপার্ড, ভারতীয় বাইসন, পাহাড়ি ছাগল, বুনো শুওর, হরিণ রয়েছে মহানন্দার পাহাড়ি জঙ্গলে।
বেড়িয়ে আসুন রিয়াং নদীর তীরের যোগিঘাট থেকে। নদীর উপর সুদৃশ্য একটি সেতু আছে। সেতুটি আপার ঘালায়তারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য মংপুর যোগাযোগ ঘটিয়েছে। সেতু থেকে চারপাশের নিসর্গ শোভা এক কথায় অনবদ্য। আপার ঘালায়তার পাহাড়ের নতুন ভ্রমণ ঠিকানা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছে। বৃহত্তর সিটংয়ের অন্তর্গত ঘালায়তার। থাকার ব্যবস্থা আছে এখানে। মংপু সিটং থেকে ৮ কিলোমিটার।
যেতে পারেন অহলদাড়া পর্বত শীর্ষে। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দীর্ঘ রেঞ্জ এবং তিস্তার দীর্ঘ প্রবাহ দেখা যায়। অহলদাড়া যাওয়ার পথেও কমলালেবুর বাগান দেখা যাবে। দেখে আসতে পারেন মহালদিরাম চা-বাগান ও লেপচা জলপ্রপাত। সিটং থেকে বাগোরা ট্রেক করতে পারেন। ৭১০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বাগোরা থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘার অসাধারণ ভিউ পাওয়া যায়। সিটং থেকে বাগোরা হয়ে আরেক জনপ্রিয় ভ্রমণ ঠিকানা চটকপুরে যাওয়া যায়। বাগোরা থেকে চটকপুর ১০ কিলোমিটার। সিটং থেকে বাগোরা ১৭ কিলোমিটার। বাগোরা থেকে দিলারাম ২ কিলোমিটার। দার্জিলিংয়ের পর্যটন মানচিত্রে আবাক করা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিলারাম আরেকটি অপেক্ষাকৃত নতুন সংযোজন।
সিটংয়ে থেকেই দিনে দিনে বেড়িয়ে আসতে পারেন কার্শিয়াং শহর থেকে। সিটং থেকে কার্শিয়াং ২৪ কিলোমিটার। কার্শিয়াং থেকে দার্জিলিং ৩২ কিলোমিটার। মন চাইলে সিটংয়ে দুটো দিন কাটিয়ে অন্যত্রও রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করতে পারেন।
যাওয়ার পথ
এন জে পি থেকে সিটং প্রায় ৭৬ কিলোমিটার। গাড়ি ভাড়া করে সরাসরি চলে আসা যায়। মংপু বাজার হয়ে অথবা ৩১-এ জাতীয় সড়ক ধরে মহানন্দা অভয়ারণ্যের মধ্যে দিয়ে কিংবা হিল কার্ট রোড ধরে কার্শিয়াং, দিলারাম, বাগোরা হয়ে সিটং পৌঁছানো যেতে পারে। এন জে পি বা শিলিগুড়ি থেকে শেয়ার গাড়িতে কার্শিয়াং পৌঁছে সেখান থেকে গোটা গাড়ি ভাড়া করে সিটং পৌঁছানো যাবে।
থাকার ব্যবস্থা
সিটং অরেঞ্জ ভিলেজ ভিলা অ্যান্ড নেচার ক্যাম্প, ফোনঃ ৭৪৩৯৯ ০৪২১৬। পাঁচপোখরি হোমস্টে, ফোনঃ ৮৯১৮১-৬৩৬৯০। হামরো হোম-হিমালয়ান ইকো স্টে, ফোনঃ ৯৭৩৩০-৬৯৬৯০। হেরিটেজ হোমস্টে সিটং, ফোনঃ ৯৮৩২৭-৯৮২৫৬। অ্যাভোকাডো হোমস্টে, ফোনঃ ৮১৪৫৮-৬২৪০৪। নেচার লাভার হোমস্টে, ফোনঃ ৯৭৩৩০-১৪৬৭২।
হেডার ফটো সৌজন্যঃ সিটং অরেঞ্জ ভিলেজ ভিলা অ্যান্ড নেচার ক্যাম্প।