বগুড়ান
প্রসস্ত সাদা বালুকাবেলা। ডানে-বাঁয়ে ধূ ধূ করে সেই সৈকত। ছড়িয়ে থাকে কত ঝিনুক। গ্রীষ্মে, বর্ষায় অজস্র লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি সৈকত জুড়ে। সমুদ্র আর সৈকত রাঙিয়ে সূর্য ওঠে। সমুদ্রের তীর বরাবর যতদূর চোখ যায় ঝাউ আর আকাশমণির ঘন সবুজ জঙ্গল। তার পেছনে মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মানুষজনের বসবাস। তাঁদের সংসারযাপনের টুকরো টুকরো ছবি দেখতে দেখতে সৈকতে পৌঁছে যাবেন।
বগুড়ান-জলপাই পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি মহকুমার এক নম্বর ব্লকের ছায়ানিবিড় শান্ত সমুদ্রতীরবর্তী গ্রাম। আম,জাম, কাঁঠাল কলাগাছ যত্রতত্র। মাঝে মাঝে জলাশয়। গ্রীষ্ম, বর্ষায় গ্রামে নানা পাখির আনাগোনা। পাখি পর্যবেক্ষকদের কাছে সে এক উপরি পাওনা।
কাঁথি সেন্ট্রাল বাস-টার্মিনাস এলাকা থেকে সৌলা রোড ধরতে হবে। বাঁ-দিকে সৌলা খাল। ডাইনে মফস্বলীয় জনজীবন, খেত, মাঠ। সৌলার মোড় থেকে গাড়ি উঠবে বাঁ-দিকে সি-ডাইক রোডে। রাস্তার দু’ধারে চিংড়ি চাষের ভেড়ি। চিংড়ির চাষ আঞ্চলিক মানুষের অন্যতম প্রধান জীবীকা। মফস্বলীয় পরিবেশ পেরিয়ে এতক্ষণে ঢুকে পড়েছেন গ্রামীণ এলাকায়। এই বাঁধের পথ ধরে বগুড়ান ছাড়িয়ে আরও আড়াই-তিন কিলোমিটার পথ এগিয়ে পৌঁছানো যায় হরিপুরে। এই হরিপুরে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার পরিকল্পনার প্রতিবাদে তীব্র গণ-আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল ২০০৬-০৭ সালে। পরিণামে ২০১১-য় প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়।
সি-ডাইক রোড থেকে ডাইনে মোড় নিয়ে গ্রামের পথে আপনি ঢুকে পড়বেন বগুড়ানে। সামনেই ‘সমুদ্র নিরালায়’। থাকার ব্যবস্থা এখানেই। বড় জায়গা নিয়ে সাগর নিরালায়-এর সামগ্রিক ব্যাবস্থা। গেস্টহাউসের পিছনদিকে ঝাউয়ের বন। বাতাসে সোঁঁ সোঁ শব্দ হয়।
সৈকত পথেঃ গেস্টহাউসের মূল গেট থেকে বেরিয়ে সুন্দর একটি গ্রাম্য পথ ধরে সৈকতে যাওয়া যায়। বিস্তৃত ও দীর্ঘ সৈকত। গাড়ি চলার উপযোগী সৈকত। সারা জুড়ে ছড়ানো ঝিনুক। আর ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়া। তবে শীতে এদের দেখা যাবে না। পূর্ণিমায় বগুড়ানের সৈকত কবিতার ছন্দ পায়। এক মায়াবী আলোয় জলছবির মতো উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সৈকত। গাছের মাথায় মাথায় জোছনার ঝিলিক। আর সমুদ্রে স্নান করে চাঁদ। সমুদ্রের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে বাঁ-দিকে ৪ কিলোমিটার দূরে জুনপুট সৈকত। সৈকত ধরে হেঁটে জুনপুট চলে যাওয়া যায়। ছোট করে একটা বিচ ট্রেকিং হতে পারে আর কী। ভোরে বেরলে সমুদ্র, সৈকতে সূর্যোদয়ের রং-বাহার দেখতে দেখতে হাঁটা যাবে। ডানদিকে কিছুটা এগলে ভাণ্ডারা খাল। সমুদ্রে এসে পড়েছে সেই খাল। খাল-পথে মৎসজীবীদের নৌকার সমুদ্রে যাতায়াত। নিয়মিত পারাপারের ব্যবস্থা নেই। তবে কোনও নৌকাচালককে অনুরোধ করলে খাল পার করে দেবে। খাল পেরিয়ে খানিকটা এগলে সৌলার সৈকত। মকর সংক্রান্তিতে মা গঙ্গার পুজো উপলক্ষে মেলা বসে সমুদ্রতীরে। গ্রামীণ মেলা। দূরদূরান্ত থেকে মৎস্যজীবী পরিবরের মানুষজন আসেন মেলায়। সৌলা থেকে আরও এগিয়ে প্রথমে কাঁথি খাল, তারপর অপ্রশস্ত পিছাবনী নদী। নদীর ওপারে মন্দারমণির সৈকত। বগুড়ান সৈকত থেকে মোট ৬ কিলোমিটারের হাঁটাপথ। মাঝে পেরতে হবে দুটি খাল আর খাল-সম একটি নদী (পিছাবনী নদী)।
কাছাকাছিঃ বগুড়ানে থেকেই দিনে দিনে বেড়িয়ে নেওয়া যায় পেটুয়াঘাট মৎস্যবন্দর, কপালকুণ্ডলার মন্দির, দরিয়াপুর লাইটহাউস, হরিপুরের দুর্গামন্দির ও শঙ্কেশ্বরের মন্দির। নিজেদের গাড়ি থাকলে পথ দেখানোর জন্য একজন গাইডের দরকার হবে। প্রয়োজনে গেস্টহাউস থেকে গাড়ি পেয়ে যাবেন। বিচ ট্রেকিংয়ে আগ্রহ থাকলে বগুড়ান সৈকত ধরে ৪ কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছে যেতে পারেন জুনপুট সৈকতে। বগুড়ান থেকে অটোও পাবেন জুনপুট যাওয়ার জন্য।
যাওয়ার পথ
বগুড়ান-জলপাই যাওয়ার জন্য প্রথমে পৌঁছাতে হবে কাঁথি সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড বা কাঁথি স্টেশন। কলকাতা থেকে কাঁথির দূরত্ব ১৪৫ কিলোমিটার। সড়কপথে দিঘাগামী যে-কোনও বাসই কাঁথি সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড হয়ে যাবে। ট্রেনে যেতে চাইলে হাওড়া থেকে হাওড়া-দিঘা সুপার এ সি এক্সপ্রেস, কান্ডারী এক্সপ্রেস ও পাহাড়িয়া এক্সপ্রেস। বগুড়ান-জলপাই কাঁথি সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড থেকে ১২ কিলোমিটার, কাঁথি স্টেশন থেকে ১৩ কিলোমিটার। দুই জায়গা থেকেই প্রাইভেট গাড়ি, অটোরিক্সা, টোটো পাবেন। যেতে হবে রিজার্ভ করে। আগেভাগে বলে রাখলে গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে গেস্টহাউস থেকে, নির্দিষ্ট ভাড়ার বিনিময়ে।
থাকার ব্যবস্থা
থাকার জায়গা একটিই। সাগর নিরালায় গেস্টহাউস। বড় এলাকা জুড়ে গেস্টহাউস। একাংশে ঝাউয়ের বন। বাতাসে সোঁ সোঁ শব্দ ওঠে। গ্রামের মধ্যে দিয়ে সামান্য হেঁটে গেলেই সৈকত। পথটিও সুন্দর। গেস্টহাউসের যত্রতত্র টাঙানো হ্যামকে গা এলিয়ে বিশ্রাম নিতে পারেন। খাওয়ার ব্যবস্থা গেস্টহাউসেই।
যোগাযোগের নম্বর : ৯৪৩৪০১২২০০।
চাঁদপুর
চাঁদনিরাতে সমুদ্রের মায়াময় রুপ দেখতে চলুন চাঁদপুর। পূর্ব মেদিনীপুরের আরেক সৈকত। পশ্চিমবঙ্গের সৈকত মানচিত্রে চাঁদপুর অপেক্ষাকৃত নতুন সংযোজন। সারিবদ্ধ দোকানপাট, হাঁকডাক, ভিড়ভাট্টা নেই। শান্ত পরিবেশ। সমুদ্র থেকে বয়ে আসে হু হু বাতাস। ঘনবদ্ধ ইমারতশ্রেণির ফাঁকফোঁকর দিয়ে নয়, চাঁদপুর থেকে অবাধ দর্শন মেলে সমুদ্রের। কতদিন সৈকতে আপনমনে ঝিনুক কুড়োননি বলুন তো? চাঁদপুর সৈকতে একা বা দলবেঁধে ঝিনুক কুড়োতে পারেন। সমুদ্র এখানে শান্তশিষ্ট নয় মোটেই। পাড় ভাঙছে। কংক্রিটের বাঁধ দিয়ে ভাঙন রোখার চেষ্টা চলছে। জোয়ারে সমুদ্রস্নান চলে না। ভাটায় চলতে পারে। ভিড়ভাট্টা হইচইয়ের বালাই নেই। দুটো দিন নিখাদ বিশ্রামের জন্য আদর্শ জায়গা। আর জোৎস্নায় চাঁদপুর সৈকতের রুপ-রহস্য উন্মোচিত হয়। গোটা সৈকতটাই তখন আপনার।
যা করতে পারেন
দিনে সৈকত-বাঁধের ওপর দিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ানো যায়। সৈকতের পশ্চাদপটে গ্রামীণ পরিবেশ। সমুদ্রের মুখোমুখি দাঁড়ালে ডানে-বাঁয়ে প্রায় সমদূরত্বে দুটো জনপ্রিয় সৈকত। সৈকত ধরে আধ ঘন্টার হাঁটাপথে পৌঁছানো যায় শঙ্করপুর। আবার, উল্টো দিকে ওই আধ ঘন্টার হাঁটাপথে পৌঁছে যাবেন তাজপুর সৈকত। সে অর্থে চাঁদপুরকে একটা ভালো স্ট্রাটেজিক পয়েন্ট বলা চলে। দিনমানে শঙ্করপুর, তাজপুর বেড়িয়ে সন্ধ্যায় চাঁদপুর ফিরে আসুন।
সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটুন, লাল কাঁকড়াদের ঘর-সংসার, দৌড়াদৌড়ি। বুক ভরে শ্বাস নিন। অপরিমেয় অক্সিজেনে শরীর, মন তাজা হবে।
চাইলে দিঘা, উদয়পুর, তালসারি, চন্দনেশ্বর মন্দির থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেন।
যাওয়ার পথ
দিঘাগামী ট্রেনে নামতে হবে রামনগর স্টেশনে। বাসে গেলে নামতে হবে বালিসাই স্টপেজে। দু’জায়গা থেকেই চাঁদপুর যাওয়ার গাড়ি, অটোরিকশা, মোটরভ্যান পাবেন। দূরত্ব ৭ কিলোমিটার।
থাকার ব্যবস্থা
এ-ওয়ান রিসর্টঃ ফোন ৯৭৩২৫০১৬৯৭। হোটেল মুনঃ ফোন ৯৮৩০৪০১৪৬০। হোটেল রাইঃ ফোন ৯৭৩৩৯৯৯০০১।