আলি ও বেদনী বুগিয়াল ট্রেক
আকাশ ছোঁয়া সব পাহাড়ে ঘেরা ঢেউ খেলানো তৃণভূমির বিস্তার, কোথাও কোথাও হলুদ আর বাদামী রঙের ছোঁয়া, শীতে বিছিয়ে থাকে বরফের চাদর, বর্ষায় ছেয়ে থাকে রংবেরঙের বুনো ফুলে, চোখ তুলে তাকালে ত্রিশূল, নন্দাঘুঁটি, মৃগথুনির মতো সব মহিমামন্ডিত পর্বতশৃঙ্গ, চৌখাম্বা পর্বতশ্রেণি আর মাথার উপর গভীর নীল আকাশ, সব মিলিয়ে সে এক স্বপ্নের দেশ। পৌঁছতে হবে ট্রেকপথে। আলি ও বেদনী বুগিয়াল পাশাপাশি বিস্তৃত দুই তৃণভূমি। আঞ্চলিক ভাষায় বুগিয়াল। হিমালয়ের অন্দরে সুন্দরের কত রূপ। আলি-বেদনী বুগিয়াল ট্রেকিং সেই রুপদর্শনের লক্ষ্যে জাদুকরী অভিযান।
ট্রেকিং শুরু হবে গাড়োয়াল হিমালয়ের লোহাজং থেকে। ট্রেকপথের দৈর্ঘ্য ৩৫ কিলোমিটার। সর্বোচ্চ পয়েন্ট তথা বেদনী টপের উচ্চতা ১২,৫০০ ফুট। সাধারণত ৫ রাত ৬ দিনের ট্রেকিং। বেসক্যাম্প লোহাজং।
প্রথম দিনঃ কাঠগোদাম বা হৃষিকেশ থেকে লোহাজং পৌঁছাতে হবে। কাঠগোদাম থেকে লোহাজং ২২০ কিলোমিটার। হৃষিকেশ-লোহাজং দূরত্ব ২৫৮ কিলোমিটার। লোহাজংয়ের উচ্চতা ৭৬০০ ফুট। দুই পথেরই দৃশ্য অপরুপ। লোহাজং থেকে দেখবেন নন্দাঘুঁটি শৃঙ্গ। নন্দাঘুঁটিতে অসাধারণ সূর্যাস্ত প্রত্যক্ষ করার সুযোগ রয়েছে। দীর্ঘ যাত্রার পরে এ দিন লোহাজংয়েই রাত্রিবাস।
দ্বিতীয় দিনঃ এ দিন লোহাজং থেকে ৮১৮৬ ফুট উচ্চতার দিদনা পর্যন্ত ট্রেকিং। পথের দৈর্ঘ্য সাড়ে ১০ কিলোমিটার। এ পথে মিশ্র উদ্ভিদের অরণ্য পাবেন, শান্ত পরিবেশে সোয়ালোর ডাক অচেনা সুরে বাজবে। ওয়ান নদীর বয়ে চলার ছন্দে কী যেন ব্যস্ততা। ওই নদী-প্রবাহ বেদনী গঙ্গার সাথে মিলিত হতে চলেছে। দিদনায় পৌঁছে গ্রামের পথে একটা চক্কর দিয়ে আসতে পারেন। এ দিন ঘন্টা পাঁচেকের ট্রেকিং শেষে দিদনা গ্রামের ক্যাম্পে রাত্রিবাস।

সৌজন্যে অরিজিৎ অধিকারী (গুগল থেকে সংগৃহিত)।
তৃতীয় দিনঃ এ দিন তালপানি হয়ে আলি বুগিয়ালের দিকে যাত্রা। পথের অনেকটাই গেছে ওকের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। ক্রমে উঠে আসতে হবে প্রায় ১১,২০০ ফুট উচ্চতায়। তালপানি থেকে আরও তিন কিলোমিটার এগনোর পরে হঠাৎ দৃশ্যপট পরিবর্তিত হবে। ঢুকে পড়বেন আলি বুগিয়ালের পরিসীমার মধ্যে। ক্রমে উঠে আসবেন একটা রিজের উপর দিকে। ওই গিরিশিরা থেকে দেখা যাবে নানা শেডের সবুজ বুগিয়ালের ঢেউ। রাত্রিবাস আলি বুগিয়ালে, ক্যাম্পে। এ দিন ৮ কিলোমিটারের ট্রেকিং। সময় লাগবে ৫ থেকে ৬ ঘন্টা।
চতুর্থ দিনঃ আজ বেদনী বুগিয়ালের শীর্ষে উঠে আসা। মাথার ওপরে গভীর নীল আকাশ, আর চতুর্দিকে সবুজের ঢেউ। নেমে আসুন বুগিয়ালের মধ্যে। হাঁটুন খালি পায়ে। সেই অনুভূতি মনে থাকবে সারা জীবন। এমন অঞ্চলে রোদ-বৃষ্টির খেলা চলে। হাতের কাছে রেনকোট রাখতে হবে। এবার নামার পালা। শুরু হবে ট্রি লাইন। ওক আর রডোডেনড্রনের অরণ্যের মধ্যে ঢুকে পড়বেন। দূরে দেখা দেবে ট্রেকার্স হাট। পৌঁছে যাবেন গহরোলী পাতাল। পরিষ্কার দিনে এখান থেকে মাউন্ট ত্রিশূলের অবাক করা রূপ দেখা যায়। গহরোলী পাতালে ক্যাম্পে রাত্রিবাস। এ দিন মোট ৭ কিলোমিটারের ট্রেকিং। সময় লাগবে ৬ থেকে ৭ ঘন্টা।
পঞ্চম দিনঃ এ দিন খাড়া উৎরাই পথে নেমে আসতে হবে নীলগঙ্গার তীরে। মুখেচোখে জল দিন। প্রাণ জুড়োবে। কিছুক্ষণের মধ্যে নীলগঙ্গা থেকে উঠে আসবেন ওয়ান গ্রামের উপরের রিজে। সাইপ্রাসের অরণ্যে ঘেরা ওয়ান গ্রামের নীচের অংশে নেমে এসে খানিক বিশ্রাম নিন। ওয়ান থেকে পৌনে এক ঘন্টার জিপ যাত্রায় ফিরবেন লোহাজং।
লোহাজং থেকে কাঠগোদাম বা হরিদ্বার চলে আসুন। তারপর গৃহপানে যাত্রা।
ট্রেকিংয়ের ব্যবস্থা
একা বা দল বেঁধে নিজেরাই ট্রেকিংয়ের আয়োজন করতে পারেন। লোহাজং থেকে গাইড, পোর্টারের ব্যবস্থা করতে হবে। যোগাযোগ করতে পারেন ভরত পুষ্পণের সঙ্গে। চোদ্দ বছর ধরে ভরত পুষ্পণ আলি-বেদনী বুগিয়াল-সহ উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন পার্বত্য অঞ্চলে ট্রেকিংয়ের আয়োজন করে আসছেন। যোগাযোগের নম্বরঃ ০৯৭১৯৮৭৫৩২৬, ০৯৪৫৬১০৮৭৮০।
ট্রেকিং এজেন্সি
নির্ভরযোগ্য কোনও এজেন্সির মাধ্যমেও ট্রেকিংয়ের ব্যবস্থাপনা করে নেওয়া যায়।
হিমালয় ট্রেকার্সঃ আলি-বেদনী বুগিয়াল ট্রেকিংয়ের আয়োজন করে থাকে এই সংস্থা। যোগাযোগের ঠিকানা: ৬৮বি, রাজা এস সি মল্লিক রোড,কলকাতা -৯২। ফোন: ৯১৬৩২৮৩০০০, ৯৮৩১১১২৪৬৯। ই-মেইল : info@himalayatrekker.com
ইন্ডিয়া হাইকস বছরের বিভিন্ন সময়ে আলি-বেদনী বুগিয়াল ট্রেকিংয়ের ব্যবস্থা করে থাকে। মোট ৬ দিনের ট্রেকিং। ফি ৯৪৫০ টাকা। সংস্থার দেরাদুন অফিসঃ ১৪,রাজভিলা, মিলন বিহার, জি এম এস রোড,দেরাদুন-২৪৮০০১। ফোন : ০৮০৪৬৮০১২৬৯। ই-মেল: info@indiahikes.com
ট্রেক দি হিমালয়াসঃ মোট ৬ দিনে আলি-বেদনী বুগিয়াল ট্রেকিংয়ের আয়োজন করে থাকে এই সংস্থা। ফোনঃ ৯৯১৭৭২৪৭৩৭। ওয়েবসাইটঃ www.trekthehimalayas.com
দয়ারা বুগিয়াল ট্রেকিং
উত্তরাখণ্ডের গাড়োয়াল ডিভিশনের উত্তরকাশী জেলায় প্রায় ১২০০০ ফুট উচ্চতায় জঙ্গলে ঘেরা এক বিস্তীর্ণ তৃণভূমি দয়ারা। আঞ্চলিক ভাষায় দয়ারা বুগিয়াল।
শীতে বরফাচ্ছাদিত হয়ে থাকে বুগিয়াল। গ্রীষ্মে তার অন্য রূপ। তখন মখমলের মতো সবুজ ঘাস আর রংবেরঙের ছোট ছোট অজস্র ফুলে ছেয়ে যায় সমগ্র বুগিয়াল। গ্রীষ্ম ও বর্ষার বুগিয়ালে গুজ্জর সম্প্রদায়ের পশুপালকরা অস্থায়ী ডেরা তৈরি । তখন ভেড়ার পালের বিচরণভূমি এই বুগিয়াল।
দয়ারা বুগিয়ালের সর্বোচ্চ জায়গাটির নাম বকরিয়া। উচ্চতা ১২০০০ ফুট। এখান থেকে গঙ্গোত্রী – ১ ও গঙ্গোত্রী -২,বান্দরপুঞ্চ, রুদ্রগইরা, জওনলি-সহ তুষারশুভ্র নানা পর্বতশৃঙ্গ দেখা যায়।
দয়ারা বুগিয়াল ট্রেক সহজ পর্যায়ের ট্রেকিং। সাধারণত ৫ দিনে ট্রেকিং সম্পূর্ণ হয়।
ট্রেকিং রুট:
প্রথম দিন : এদিন পোঁছে যেতে হবে দেরাদুন স্টেশনে। সেখান থেকে রইথল গ্রামে। রইথল থেকে ট্রেকিং শুরু হবে। দেরাদুন রেল স্টেশনের কাছেই মুসৌরি বাসস্ট্যান্ড। এখান থেকে সকাল ৮টা নাগাদ উত্তরকাশী যাওয়ার সরকারি বাস ছাড়ে। হরিদ্বার ও হৃষিকেশ থেকেও উত্তরকাশী যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে। উত্তরকাশী থেকে রইথল (৪৫ কিলোমিটার) যাওয়ার জন্য গাড়ি পাওয়া যাবে। দলে কয়েকজন সদস্য থাকলে দেরাদুন থেকে টেম্পো ট্রাভেলার (১২-১৪ সিটের) কিংবা টাটা সুমো বা মাহিন্দ্রা ম্যাক্সের (৬-৮ সিটের) মতো গাড়ি ভাড়া করে নেওয়া যায় রইথল পর্যন্ত। কোনো এজেন্সির মাধ্যমে ট্রেকিংয়ের ব্যবস্থা হলে তাঁরাই দেরাদুন থেকে রইথল যাওয়ার এবং ট্রেকিং শেষে দেরাদুন ফেরার গাড়ির ব্যবস্থা করে দেয়। এ বাবদ খরচ অনেক সময়েই ট্রেকিংয়ের খরচের সঙ্গে যুক্ত থাকে না। সরাসরি গাড়ির চালক বা মালিককে ভাড়ার টাকা দিয়ে দিতে হয়।
প্রথমদিন রইথলেই রাত্রিবাস। রইথলই হবে বেসক্যাম্প।
দ্বিতীয় দিন : সকালে হাঁটা শুরু চড়াই পথে, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যাবে ওদারি গ্রামে। ওদারির পর থেকে জঙ্গল ঘন হয়ে আসবে। ঘন্টা চারেকে ৪ কিলোমিটার ট্রেকিং শেষে যাত্রাবিরতি গুই গ্রামে। একটি জলাশয় আছে এখানে। তাকে ঘিরে কয়েকটি কুটির। গুই গ্রামে ক্যাম্পে রাত্রিবাস। গইয়ের উচ্চতা ৯৩৫০ ফুট।
তৃতীয় দিন: তৃতীয় দিন সকালে যাত্রা শুরু করে আরও চড়াই পথে উঠে আসতে হবে দয়ারা জঙ্গল ক্যাম্পে। উচ্চতা ১০৯৫৫ ফুট। এখান থেকে শুরু হয় তৃণভূমি। দৃশ্যপট বদলে যায়। দূরে দূরে দেখা যায় বান্দরপুঞ্চ, দ্রৌপদী কা ডান্ডা ১ ও ২,জওনলি প্রভৃতি পর্বতশৃঙ্গ। সারাদিন নিজের মতো বেড়ানো যায় বুগিয়ালে। ইচ্ছেমতো ফটো তোলা যায়।
চতুর্থ দিন : এ দিন একটু লম্বা যাত্রা। তৃণভূমির বুক চিরে যাত্রা। গন্তব্য বকরিয়া টপ। বুগিয়ালের উচ্চতম স্থান (১২০০৫ ফুট)। খুব চড়াই পথ নয়। তবে শীতে মরশুমে পথ খানিকটা কঠিন হয়ে ওঠে, তষারপাতের কারণে। বকরিয়া থেকে ৩৬০ ডিগ্রি দৃশ্যপট সম্মোহিত করে রাখে। হিমালয়ের নানা শৃঙ্গ আরও স্পষ্ট এখান থেকে।
এবার নামার পালা। ফিরে আসবেন দয়ারা জঙ্গল ক্যাম্পে। এদিন সবমিলিয়ে ১২ কিলোমিটার ট্রেকিং। সময় লাগবে প্রায় ৮ ঘন্টা।
পঞ্চম দিন : সকালে হাঁটা শুরু দয়ারা জঙ্গল ক্যাম্প থেকে। সহজ উৎরাই পথে ঘন্টা তিনেকের মধ্যে চলে আসবেন ৭৩৮০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বরসু গ্রামে। বরসু থেকে সেদিনই ভাটোয়ারি, উত্তরকাশী হয়ে ফিরে আসা যাবে দেরাদুনে।
ট্রেকিং এজেন্সি :
হিমালয় ট্রেকার্স অনেকদিন ধরেই দয়ারা বুগিয়াল ট্রেকিংয়ের আয়োজন করে আসছে। যোগাযোগের ঠিকানা: ৬৮বি, রাজা এস সি মল্লিক রোড,কলকাতা -৯২।
ফোন: ৯১৬৩২৮৩০০০, ৯৮৩১১১২৪৬৯। ই-মেইল : info@himalayatrekker.com
ইন্ডিয়া হাইকস বছরের বিভিন্ন সময়ে দয়ারা বুগিয়াল ট্রেকিংয়ের ব্যবস্থা করে থাকে। মোট ছ’দিনের ট্রেকিং। সংস্থার দেরাদুন অফিসের ঠিকানাঃ ১৪,রাজভিলা, মিলন বিহার, জি এম এস রোড,দেরাদুন-২৪৮০০১। ফোন : ০৮০৪৬৮০১২৬৯। ই-মেল: info@indiahikes.com ।