জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে থাই এয়ারওয়েজের ব্যাঙ্ককগামী বিমান ছাড়ল রাত ১২টায়। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্কক বেড়ানো হয়েছে আগেই। এবার ব্যাঙ্কক যাত্রার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কোয়াই নদী, কোয়াইয়ের সেতু এবং ঐতিহাসিক ‘ডেথ রেলওয়ে’ দেখা।
ঘন্টা দুয়েকের আকাশপথ। ব্যাঙ্কক পৌঁছানো গেল। থাইল্যান্ডে পৌঁছে ভিসা করা যায়। কোনও টাকাপয়সা লাগল না। নিখরচায় ভিসা পাওয়া গেল। তবে দুই ঘন্টা সময় লেগে গেল। হোটেলে পৌঁছে মালপত্র রেখে খানিক বিশ্রাম নিতে নিতে কাচানাবেরি যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। এখানে কোয়াই সেতু, ডেথ রেলওয়ে দেখা যাবে। ভেসে পড়া যাবে কোয়াই নদীতেও। কাচানাবেরি থাইল্যান্ডের একটি খ্যাতনামা পর্যটন কেন্দ্র। সড়কপথে ব্যাঙ্কক থেকে কাচানাবেরির দূরত্ব প্রায় ১৪৪ কিলোমিটার।
দি ব্রিজ অন দি রিভার কোয়াই
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, ১৯৪২ সালে, জাপান ব্রিটিশদের হাত থেকে মায়ানমার ছিনিয়ে নেয়। তারপরেই মায়ানমার থেকে থাইল্যান্ড পর্যন্ত একটি রেলপথ তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় জাপানীরা। কাজটা ছিল ভয়ংকর রকমের কঠিন। পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে, বিপদসংকুল সব জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাততে হবে সেই রেলপথ। বর্ষায় অগম্য হয়ে ওঠে জঙ্গলগুলো। ব্রিটিশ সরকার এরকম একটা পরিকল্পনা করেও হাল ছেড়ে দিয়েছিল। জাপান তার লক্ষ্য থেকে সরে আসার পাত্র নয়।
শুরু হল অসাধ্যসাধনের এক মরনপণ প্রচেষ্টা। ১৯৪২ সালে মায়ানমার ও থাইল্যান্ড, উভয় প্রান্ত থেকেই শুরু হল রেললাইন পাতার কাজ। ৩ লক্ষ্য ৩০ হাজার যুদ্ধবন্দি ও এশীয় শ্রমিককে জোর করে রেলপথ তৈরির কাজে নামিয়ে দেওয়া হল। মাত্র ১৬ মাস পরে দুই প্রান্তের দুই দল মিলিত হল কাচানাবেরি অঞ্চলে। রেলপথ যাবে কোয়াই নদীর উপর দিয়ে। ১৯৪৩ সালে প্রথমে একটি কাঠের ব্রিজ এবং পরে ওই একই বছরে কংক্রিট ও ইস্পাতের আরেকটি ব্রিজ তৈরি হয়ে যায় কোয়াই নদীর উপর দিয়ে। তৈরি হল ৪১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মায়ানমার-থাইল্যান্ড রেলপথ। থাইল্যান্ডের বন পং থেকে মায়ানমারের থানবুজায়াৎ পর্যন্ত প্রলম্বিত এই রেলপথ। আর এই রেলপথ তৈরির কাজে মারা গেল লক্ষাধিক শ্রমিক। রেলপথটি ‘ডেথ রেলওয়ে’ নামে চিহ্নিত হয়ে গেল। কোয়াইয়ের ব্রিজ-২৭৭ সেই মৃত্যু-পথের সংযোগকারী সেতু হিসেবে কুখ্যাত ও খ্যাত হল। ডেভিড লিনের পরিচালনায় বিখ্যাত চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে কোয়াইয়ের ব্রিজ নিয়ে, ‘দি ব্রিজ অন দি রিভার কোয়াই’। একই নামে পিয়ের বোলের উপন্যাস রয়েছে।
আমরা পৌঁছালাম কাচানাবেরি। একদিকে অতীতের কালো ইতিহাস, অন্যদিকে অপূর্ব সুন্দর কোয়াই নদী, অপরূপ প্রকৃতি, নানা বিনোদনের ব্যবস্থা কাচানাবেরিকে বিশ্বখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র করে তুলেছে। কোয়াইয়ের তীরে প্রচুর পর্যটক। আমরা হেঁটে কোয়াইয়ের ব্রিজ পেরোলাম। খুব ভালো লাগছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটা ইতিহাসকে ছুঁতে পেরে।
স্পিডবোটে চড়ে কোয়াই নদীতে ভ্রমণও হল। অনেক স্পিড বোট নদীতে। স্বচ্ছ জল। নদীর দু-পাশের দৃশ্য খুবই মনোরম। কোয়াই নদীর একদিকে থাইল্যন্ড, অন্যদিকে মায়ানমার। নদীতেই আমোদ-প্রমোদের নানা ব্যবস্থা। নদীর বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে প্রমোদতরী। ভাসমান রেস্তোরাঁ। ভাসমান নাইট ক্লাব। নদী-ভ্রমণ শেষে কাচানাবেরির মিউজিয়ামটি ঘুরে দেখলাম। কীভাবে ডেথ রেলওয়ে তৈরি হয়েছিল তা ছবিতে, লেখায় সুন্দর করে বোঝানো হয়েছে। দেখা গেল রেলপথ তৈরির নানা যন্ত্রপাতি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র। সে এক রোমহর্ষক ইতিহাস এবং অভুতপূর্ব অনুভূতি।
কোয়াই নদীতে ভ্রমণ করে শরীরের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গিয়েছিল। নদীর তীরে বড় আকারের ডাব বিক্রি হচ্ছে। ডাবগুলো বরফের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়েছে। ডাবের জল খেয়ে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। বিক্রেতা ডাবের খোল কেটে শাঁস বের করে দিল। এখানে সর্বত্র নানারকমের ফল, রান্না করা নানা খাবার বিক্রি হচ্ছে। আমার এক ডাবেই পেট ভরে গেছে।
হোটেলে ফিরে এলাম। রাতে আমাদের অনুরোধে সুস্বাদু দক্ষিণ ভারতীয় খাবার পরিবেশিত হল। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য লাওসের লুয়াং প্রবং।
মেকং নদীর দেশে
প্যাকেট-ব্রেকফাস্ট সঙ্গে নিয়ে সকাল সাড়ে ৬টায় ব্যাঙ্কক বিমানবন্দরে চলে এলাম। লাওসের লুয়াং প্রবাং যাওয়ার যাওয়ার বিমান ছাড়ল ৮ঃ৪৫-এ। দেড় ঘন্টায় পৌছে গেলাম লুয়াং প্রবাং বিমানবন্দরে। ছিমছাম বন্দর। রাস্তাঘাটে ভিড় নেই। এখানকার পরিবেশ খুবই শান্ত। প্রথম দেখাতেই তাই ভালো লেগে গেল দেশটাকে। ভিসা হল।সময় লাগল না বেশি। আমার লাওস ভ্রমণ এই প্রথম।
হোটেলে পৌঁছানোর আগেই আমরা কয়েকটা জায়গা ঘুরে নেব। পথেই পড়ল সুন্দর একটি বৌদ্ধ মন্দির, ওয়াট জিয়াং থং। তৈরি হয়েছিল ১৫৫৯-১৫৬০ সালের মধ্যে। মন্দিরটিতে লাওসের ঐতিহ্যবাহী চারু ও কারুশিল্পের অসাধারণ সব নিদর্শন দেখা যায়। ওয়াট জিয়াং থং মন্দিরটি লুয়াং প্রবাং শহরের মধ্যেই অবস্থিত। উল্লেখ্য, প্রাচীণ ও ঐতিহ্যপূর্ণ নানা স্থাপত্য এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দারুণ এক মেলবন্ধন ঘটেছে লুয়াং প্রবাংয়ে। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট লুয়াং প্রবাং।
এরপর মেকং ও নামখেন নদীর সঙ্গমস্থলে গেলাম। জায়গাটা খুবই সুন্দর। আরও কিছু বৌদ্ধমন্দির দেখে আমরা কুয়াং সি জলপ্রপাতের দিকে চললাম। চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে জলপ্রপাতটি। দারুন প্রাণবন্ত জলপ্রপাত। চোখ ফেরানো যায় না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেকগুলি জলধারা। প্রধান ধারাটি ২০০ ফুট উচ্চতা থেকে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বেশ খানিকটা এলাকা জুড়ে এই জলপ্রপাত। প্রপাতের জমা জলে প্রচুর মানুষ স্নান করছে। নানা খাবারদাবার বিক্রি হচ্ছে। যেন মেলা বসেছে জায়গাটিতে।
জলপ্রপাত দেখে হোটেলে এলাম সারাদিন পরে। খুব সুন্দর হোটেল। খাবারের প্রকারে, স্বাদে নতুনত্ব পাওয়া গেল। এখানে মাছ পাওয়া যায় প্রচুর। নৈশভোজে মাছের নানা পদ পাওয়া গেল। শেষ পাতে পাওয়া গেল ড্রাগন ফ্রুট। খাওয়াদাওয়া সেরে কাছাকাছি একটি নৈশবাজারে ঢুঁ মারা গেল। জমজমাট রাতের বাজার। সকলেই কিছু না কিছু কিনছে। এরপর এক নতুন অভিজ্ঞতা। ফুট ম্যাসাজ। প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে পা ম্যাসাজ করিয়ে খুব আরাম বোধ হল।
আজ ২৯ জানুয়ারি। আজ আমরা যাব ফনসাভান। লাওসের জিয়াংখুউয়াং প্রভিন্সের রাজধানী। এই লাওস দেশটিকে মোটেই বিদেশ বলে মনে হচ্ছে না। আমাদের দেশের সুন্দর কোনও পার্বত্য অঞ্চলের সঙ্গে খুব মিল পাওয়া যাচ্ছে। দেশটির যত্রতত্র পাহাড়, যেন পাহাড়গুলির সঙ্গে দেশটির এক অকৃত্রিম সখ্যতা। শান্ত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় দেশ।
সকাল সকাল প্রাতরাশ সেরে আমরা সাড়ে ৮টা নাগাদ ফনসাভানের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। মনোরম পাহাড়ি পথ। উপত্যকার পর উপত্যকা পেরিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি। চমৎকার আবহাওয়া। বিশেষ বিশেষ জায়গায় গাড়ি থামছে। আমরা ঘুরেফিরে দেখছি জায়গাটা। পাহাড়ের পর পাহাড় আর উপত্যকা। আর পাইনের জঙ্গল। সবুজে সবুজ চারিদিক। তার মধ্যে ছোট ছোট কাঠের বাড়ি। নানা রং সেগুলির। কী সুন্দরই যে দেখতে লাগছিল। আদিবাসী নানা জনগোষ্টির বসবাস ফনসাভানে। এখান থেকে আমরা গেলাম মুয়াং খোম নামে আরেকটি স্থানে। ।
অতীতে জিয়েং খুয়াং ছিল এক সমৃদ্ধ জনপদ। ৬২টি বৌদ্ধ স্তূপ ছিল জিয়াং খুয়াংয়ে। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের আক্রমণ এবং পরে ইন্দো-চায়না যুদ্ধে জিয়াং খুয়াং প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। পরে নতুন করে গড়ে তোলা হয় জিয়াং খুয়াংকে এবং জিয়াং খুয়াংয়ের নতুন নামকরণ হয় মুয়াং খোম। সারা অঞ্চলটি জুড়ে বিশাল বিশাল গহ্বর দেখা গেল। এগুলি ইন্দো-চায়না যুদ্ধের সময়কার বোমাবর্ষণের চিহ্ন বহন করে। । আক্রমণে, যুদ্ধে কীভাবে যুগ যুগ ধরে গড়ে তোলা একটি সভ্যতা, সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায় তা চাক্ষুষ করা যায় মুয়াং খোমে এলে।
এরপর যাওয়া গেল মুয়াং খোমের ‘প্লেইন অফ জারস’এ। অবাক করা জায়গা এটি। শয়ে শয়ে বিশালাকার প্রাগৈতিহাসিক পাথর ছড়িয়ে রয়েছে একটা এলাকা জুড়ে। পাথরগুলোর একটা নির্দিষ্ট আকৃতি আছে। অনেকটা আমাদের মাটির কুঁজোর মতো দেখতে। পাথরগুলির সজ্জার মধ্যে একটা জ্যামিতিক প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়। পাথরগুলির আশেপাশে মাটির নীচে মানুষের দেহাবশিষ্ট, বহু প্রাচীণকালে ব্যবহৃত সমাধি-উপকরণ পাওয়া গেছে। এ সব থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকরা জায়গাটিকে একটি প্রাগৈতিহাসিক সমাধিক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
হোটেলে ফিরে এলাম এক অমলিন ভ্রমণ তৃপ্তি নিয়ে। নৈশাহার পরিবেশিত হল সাড়ে ৭টায়। খানিকটা গোছগাছ সেরে শয্যাগ্রহণ করা গেল। কাল যাব ভিয়েতনাম।
ফটোঃ লেখক।