দার্জিলিং জেলার তাকদা, তিনচুলে আর লামাহাটার পারস্পরিক অবস্থান ভ্রমণরসিকদের কাছে বেশ পছন্দের। সুবিধা হল, যে কোনও একটি ঠিকানায় থেকে সহজেই অন্য দু’টি জায়গা বেড়িয়ে নেওয়া যায়। মন চাইলে একাধিক জায়গাতেও থাকার ব্যবস্থা করে নেওয়া যেতে পারে বৈচিত্রের কারণে। ট্রেক করেও যাওয়া যায় এ গ্রাম সে গ্রাম। যেমন, তাকদা থেকে লামাহাটা ও তিনচুলে হয়ে তাকদায় ফিরে আসা যায় কয়েক ঘন্টায়।
তাকদা
ছবির মতো গ্রাম তাকদা। লেপচা ভাষায় ‘তুকদা’ শব্দের অর্থ ‘কুয়াশা’। তুকদা থেকে তাকদা। কুয়াশা-মাখা পাহাড়ি পথ, আশ্চর্য রং-রূপের অর্কিড, পাহাড়ের ধাপে ধাপে তরঙ্গায়িত সবুজ চা-বাগিচা, পাখির ডাক, ঝোরার জলধ্বনি, এ সব নিয়ে অপরূপ তাকদা। দার্জিলিং শহর থেকে ত ২৮ কিলোমিটার। রাতে তাকদার পাহাড় থেকে আলোকমালায় সজ্জিত দার্জিলিংয়ের রূপটি দেখবার মতোই।
৪০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত তাকদাকে মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশরা। তৈরি হয়েছিল সুন্দর সুন্দর বাংলো। কোনও কোনও বাংলো এখন হেরিটেজ হোমস্টে হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাকদার অর্কিড সেন্টারটি কিন্তু না দেখলেই নয়।
তাকদা বাজার এলাকা থেকে ২ কিলোমিটার নীচে রংলি রংলিয়ট চা বাগান দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে। অনেক নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে তিস্তা। তাকদা বাজার এলাকা ছাড়িয়ে একটু এগলেই দেখবেন বোল্ডার বাঁধানো একটি পথ উঠে গেছে উপরের দিকে। ওই পথ ধরে পৌঁছাবেন একটি মনাস্ট্রিতে। মনাস্ট্রি চত্বর থেকে চারপাশের দৃশ্য, বিশেষ করে চা বাগানের অসাধারণ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায়। ঘুরে দেখতে পারেন ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীর বাংলোগুলি। সিডার আর পাইন বনের মধ্যে দিয়ে এক চক্কর বেড়িয়ে আসতে পারেন। বনপথে ট্রেক করে যেতে পারেন লামাহাটায়। চাইলে লামাহাটা থেকে তিনচুলে হয়ে তাকদায় ফিরে আসতে পারেন। এই ট্রেকিংয়ে একজন আঞ্চলিক গাইড সঙ্গে থাকলে সুবিধা হবে।
যাওয়ার পথ
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে তাকদা ৬০ কিলোমিটার, শিলিগুড়ি থেকে ৫২ কিলোমিটার। উভয় জায়গা থেকেই গাড়ি ভাড়া করে তাকদা চলে আসা যায়।
থাকার ব্যবস্থা
সাইনো-দি হেরিটেজ গেস্টহাউস, ফোনঃ ৯৪৩৪৪-৬২৮০৬। শায়ন হোমস্টে, ফোনঃ ৮৬০৯১-২৮৮৪১। তাকদা হেরিটেজ কলোনিয়াল বাংলো নম্বর ১২, ফোনঃ ৯০০২৬-৭৭৭৭৯। সাই হৃদয়ম-আ ব্রিটিশ হেরিটেজ বাংলো, ফোনঃ ৮০০১৯-০১১৭২। গ্লেন মারি হোমস্টে, ফোনঃ ৮২৫০২-১২১৪১, ৬২৯৫৩-৫৬৮০৯।
তিনচুলে
তিনচুলের ভিউপয়েন্টকে কাঞ্চনজঙ্ঘায় বর্ণবহুল সূর্যোদয় দেখার ব্যালকনি বলা চলে। সূর্যোদয়ের অপরূপ সেই দৃশ্য বহুদিন মনে থাকবে। একটি ছোট্ট ও নিরালা গ্রাম। ছবির মতো অল্প কিছু বাড়িঘর। তিনচুলে ফুলেরও গ্রাম। বাড়িতে বাড়িতে যত্নলালিত অর্কিড ও অন্যান্য ফুলের গাছ, চলার পথের ধারে ধারে চেনা-অচেনা ফুলের ঝাড় তিনচুলেকে রঙিন করে রাখে বছরভর। দার্জিলিং শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে ৫৮০০ ফুট উচ্চতায় তিনচুলের আবস্থান। তাকদা থেকে তিনচুলে মাত্র ৩ কিলোমিটার। সামান্য ঊর্ধমুখী পথ ধরে তাকদা থেকে তিনচুলে পৌঁছাতে
হয়।
তিনচুলে থেকে রংলি রংলিয়ট ও পেশক চা বাগানের দৃশ্য অতীব সুন্দর। দেখবেন তিনচুলে মনাস্ট্রি। একটু হেঁটে অবশ্যই গুম্বাদাড়া ভিউ পয়েন্টে যাবেন। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও এবং রঙ্গীত নদীর দৃশ্য অপরূপ। তিনচুলেতে যদি থাকার ব্যবস্থা হয় তবে ডে টুরে অবশ্যই তাকদা বেড়িয়ে আসবেন। কাছেই আরেক ভ্রমণ ঠিকানা লামাহাটা।
যাওয়ার পথ
এন জে পি থেকে তিনচুলে ৭৩ কিলোমিটার। এন জে পি বা শিলিগুড়ি থেকে তিনচুলে যাওয়ার গাড়ি পাবেন।
থাকার ব্যবস্থা
গুরুং গেস্টহাউস, ফোনঃ ৯৯৩৩০-৩৬৩৩৬। তিনচুলে হিমালয়ান হোমস্টে, ফোনঃ ৯৭৩৩২-৬৬৬৩৩। তিনচুলে রাই রিসর্ট, ৯৭৩৩২-৪২৮৭৬। হামরো তিনচুলে হোমস্টে, ৯৭৩৩২-৮১৭৮৪।
লামাহাটা
তাকদা, তিনচুলের প্রতিবেশী আরেকটি শান্ত, সুন্দর গ্রাম লামাহাটা। উচ্চতা ৫৭০০ ফুট। দার্জিলিং থেকে লামাহাটার দূরত্ব ২৩ কিলোমিটার। তিনচুলে থেকে পেশক চা বাগানের মধ্যে দিয়ে রাস্তা ধরুন। পেশক ভিউ পয়েন্ট থেকে চারপাশের অপরূপ দৃশ্যপট দেখুন। চা বাগানের ওই রাস্তা পেশক রোডে মিলিত হয়েছে। পেশক রোডে পৌঁছে বাঁয়ে মোড় নিয়ে লামাহাটায় চলে আসুন।
পরিবেশবান্ধব পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে অতি দ্রুত সুনাম অর্জন করেছে লামাহাটা। পথের ধারে যত্নলালিত চমৎকার একটি বাগান লামাহাটার বিশেষ আকর্ষণ। মরসুমী ফুল, বিভিন্ন প্রজাতির অর্কিডের বাহার দেখা যায় এই বাগানে। একটি নজরমিনার রয়েছে বাগানের মধ্যে। সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, তিস্তা ও রঙ্গীত নদী, সিকিমের পর্বতশ্রেণি দেখা যায়।
লামাহাটায় থাকলে বনের মধ্যে দিয়ে খানিকাটা হেঁটে আসতে পারেন। পাহাড়ের উপরের দিকে রয়েছে ছোট একটি জলাশয়। আঞ্চলিক অধিবাসীদের কাছে এটি অত্যন্ত পবিত্র জলাশয়। ছোট ট্রেক করে চলে যেতে পারেন এই জলাশয়টির কাছে। এরকমই ছোট ট্রেকপথে যেতে পারেন ৮-মাইল অর্গানিক সেন্টার। দেখতে পারেন জৈবচাষের নানা পদ্ধতি। মাঝারি দৈর্ঘ্যের ট্রেক করতে চাইলে যেতে পারেন মাটি, পাথর ইত্যাদি দিয়ে তৈরি ছোট্ট একটি বৌদ্ধ মনাস্ট্রির চত্বরে। ট্রেকিংয়ের পথটি অসাধারণ। এই পথে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও সিঙ্গালিলা রেঞ্জের দৃশ্য ভালো লাগবে। পথে পড়বে তুতি হাত্তা চা বাগান। চা বাগানের ছোট্ট টি-শপে ঢুকে প্রকৃতই অর্গানিক চায়ের স্বাদ যাচাই করে নিতে নিতে ভুলবেন না যেন।
যাওয়ার পথ
এন জে পি অথবা শিলিগুড়ি থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে-৩১, লপচু ও পেশক টি এস্টেট রোড ধরে লামাহাটা ৬৯ কিলোমিটার। শিলিগুড়ি থেকে জোরবাংলো হয়ে লামাহাটা ৭২ কিলোমিটার। দার্জিলিং থেকে লামাহাটা ২৩ কিলোমিটার। কালিম্পং থেকে লামাহাটা ৪১ কিলোমিটার।
থাকার ব্যবস্থা
এভারেস্ট হাট হোমস্টে, ফোনঃ ৮৫৩৮০-৮৭১০৫। লামাহাটা মাউন্টেন ভিউ হোমস্টে, ফোনঃ ৯৭৭৫৪-৮২০২৭। লামাহাটা ফার্মস, ফোনঃ ৯৮০০০-২৪৫৫৩। লামাহাটা দ্রুক হোমস্টে, ফোনঃ ৯৯৩৩০-২০৩৯১।