দক্ষিণ ভারতে পূর্বঘাট পর্বতমালার একাংশে কোল্লী মালাই বা কোল্লী পর্বতমালা। তামিলনাড়ুর একটি অনাঘ্রাত হিল স্টেশন। নমক্কল জেলার পূর্বাংশে ২৮০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে পাহাড়, অরণ্য, ঝর্ণা, ফল, ভেষজ উদ্ভিদের বাগিচা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, প্রাচীন গুহা, সবুজে ঘেরা টলটলে জলের লেক ইত্যাদি নিয়ে চমৎকার এই অফবিট পার্বত্য এলাকাটি পর্যটকদের মন কেড়ে নিয়েছে। কোল্লী আসলে আবিষ্কৃত হচ্ছে। কোল্লীর দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত ঘেঁষে বয়ে চলেছে কাবেরী নদী। নিকটবর্তী রেল স্টেশন সালেম।
৩,৩০০-৪,৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত কোল্লী পার্বত্য এলাকায় ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে ঠাণ্ডা প্রবল। বছরের বাকি সময়টায় এখানকার আবহাওয়া মনোরম। গ্রীষ্মে দিনের তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। রাতে তাপমাত্রা নেমে আসে অনেকটা। গ্রীষ্মের মরশুমে রাতের গড় তাপমাত্রা ১৮ ড়িগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। বর্ষায় পাহাড়ের সবুজ জুড়ে বৃষ্টি আরেক সৌন্দর্য।
অতীতে আদিবাসীদের রাজত্ব ছিল এখানে। তামিলনাড়ু সরকারের পর্যটন বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুসারে, বর্তমানে কোল্লী হিলস এলাকায় ১৬টি ছোট ছোট আদিবাসী গ্রাম রয়েছে। ফলে পাহাড় ও অরণ্যে আদিবাসী সংস্কৃতির নানা ছবি দেখা যাবে এখানে। কোল্লীর পাহাড়ি এলাকার মালয়ালী আদিবাসীরা রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে ভেষজ নানা গাছগাছড়া থেকে তৈরি ওষুধ ব্যবহার করে আসছেন দীর্ঘকাল ধরে এবং এক্ষেত্রে তাঁদের কাছ থেকে অনেক তথ্য জানার আছে।
কোল্লী পার্বত্য এলাকায় প্রবেশের রাস্তাটি যেমন সুন্দর তেমনই রোমাঞ্চকর। ৪৬ কিলোমিটার রাস্তায় রয়েছে ৭০টি হেয়ার-পিন বাঁক। কয়েকটি বাঁক অসাধারণ ভিউপয়েন্টও বটে, বিশেষ করে ৩৪, ৩৫ ও ৩৭ নম্বর বাঁক। আরও ভিউপয়েন্ট রয়েছে। সেলুর ওয়্যারলেস ভিউপয়েন্ট, বিন্নাম ভিউপয়েন্ট, সিরুমালাই ভিউপয়েন্ট। ভিন্ন ভিন্ন ভিউপয়েন্ট থেকে কোল্লীর ভিন্ন ভিন্ন রূপ উন্মোচিত হতে থাকে। বৈচিত্রের সমাহার কল্লি হিলস।
কোল্লী হিলসের মসিল্লা ও নম্মা জলপ্রপাত ও তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এক কথায় অপরূপ। আইয়িয়ারু নদী থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া আগাসাগানগাই জলপ্রপাত। পরিপূর্ণ রূপটি দেখতে হলে হাজারখানেক সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নীচে নামতে হবে। ওই সিঁড়িপথ বেয়ে উঠে আসার কথাটি মাথায় রেখেই নামতে হবে কিন্তু।
কোল্লী হিলসে রয়েছে কিছু প্রাচীন গুহা। ট্রেক করে যাওয়া যায়। আঞ্চলিক আদিবাসীদের মত অনুসারে, অতীতে সিদ্ধাই বা অষুধ প্রস্তুতকারকরা নানান ভেষজ গাছগাছড়া নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন এই গুহাগুলির মধ্যে। তথ্য যথার্থ হলে এই গুহাগুলিকে ওষুধ আবিষ্কারের প্রাচীন ভারতীয় গবেষণাগার হিসেবে মান্যতা দিতে হয়।
কল্লির আরাপল্লীশ্বরার মন্দিরটি একটি তীর্থস্থান। প্রাচীন শিবমন্দির এটি। আদিবাসী গোষ্ঠীগুলির বিশ্বাস, কল্লি পার্বত্য এলাকার রাজা ভলভিল অরি প্রথম বা দ্বিতীয় শতকে এই শিবমন্দিরটি তৈরি করেছিলেন। মন্দির ঘিরে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কোন সে সুদূর অতীত থেকে প্রবাহিত হয়ে চলেছে আজও। এট্টুকাই আম্মান কল্লির আঞ্চলিক দেবতা। অনেক উপকথা শোনা যায় এই দেবতাকে নিয়ে।
প্রচুর ফল হয় কোল্লীতে। পাহাড়ের ঢালে ঢালে কলা, কাঁঠাল, কমলালেবু, কফি, গোলমরিচের বাগিচা এখানে সেখানে। ভাসালুরপট্টিতে হরেক ফলের সরকারি বাগিচা তৈরি হয়েছে। ভাসালুরপট্টিতে যাওয়ার পথে ভালাভান্ডিনাড়ুতে দেখে নেওয়া যায় তামিলনাড়ু সরকারের বিশাল ভেষজ উদ্ভিদের বাগিচাটি। দেশের আয়ুর্বেদ, সিদ্ধা, ইউনানি ওষুধ প্রস্তুতকারক শিল্পে প্রচুর কাঁচামালের সরবরাহ আসে কল্লির পাহাড় থেকে। বেড়াতে গিয়ে কিনতে পাবেন গোলমরিচ,কফি,মধু, চাইলে পছন্দের চাল। ফল পাবেন প্রচুর।
দক্ষিণ ভারতের পার্বত্য অঞ্চলের প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য কোল্লী হিল স্টেশনে একবার আসতেই হয়। কোল্লির পাহাড়ের এক একটা বাঁক থেকে পার্বত্য প্রকৃতির দৃশ্যগুলি এক একটা রূপকথা। দাক্ষিণাত্যের একটি পর্বতাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী আদিবাসী সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়টাও ঘটে যায় সেই সঙ্গে।
সুতরাং, তামিলনাড়ু বেড়ানোর পরিকল্পনা থাকলে কোল্লী মালাইকে সেই ভ্রমণের অন্তুর্ভুক্ত করে নিতে পারেন আগ্রহীরা।
যাওয়ার পথ
কল্লি হিলসের নিকটতম রেলস্টেশন সালেম। এখান থেকে কল্লি হিলস ৯০ কিলোমিটার।
নমক্কল শহর থেকে ৫২ কিলোমিটার। ত্রিচি থেকে কল্লি ১২৮ কিলোমিটার। চেন্নাই থেকে কল্লি হিলস ৩৬২ কিলোমিটার।
হাওড়া থেকে (হাওড়া-ই আর এস স্পেশাল, এস সি এল-টিভিসি প্রভৃতি) ট্রেন সালেম যায়।
সালেম থেকে কল্লি হিলস যাওয়ার বাস ও ভাড়ার গাড়ি পাওয়া যাবে। হাতে সময় থাকলে সালেম, কোয়েম্বাটোর, ত্রিচি থেকে তামিলনাড়ুর নানা দিকে যাওয়া যায়। সালেম জেলাতেই রয়েছে জনপ্রিয় হিলস্টেশন ইয়েরকর্ড। সালেম থেকে ট্রেনে কোয়েম্বাটোরে এসে সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে তামিলনাড়ুর আরেক জনপ্রিয় হিলস্টেশন উটিতে চলে আসা যায়। সালেম থেকে কোয়েম্বাটোর ট্রেনে সাড়ে ৪ ঘন্টার পথ।
থাকার ব্যবস্থা
কল্লি হিল রিসর্ট, ফোন ৯৪৪৪৪০৪২২০, অ৪২৮৬-২৪৭৪৮৪। নল্লাথাম্বি রিসর্ট, ফোন ৯৪৪৩২০৯৮৪২, ৭৩৭৩৬১২৫৫৫। সিলভার লাইন রিট্রিট হোটেলস, ফোন ০৭৫০২১৫৮৫৮৫, ০৭৫০২১৫৮৫৮৫। ইয়ুথ হস্টেল, ফোন ০৪২৮৬-২৪৭৪২৫। আরাসা কুদিল, ফোন ৯৭৫১৭১৯২৯৬, ০৪২৮৬-২৪৭৪২৫।