চলন্ত বাসের জানলা দিয়ে সবুজ খেত, ঘরবাড়ি, পুকুর, ঝিল দেখতে দেখতে চলেছি। চেনা পথ। নতুন করে চোখে পড়ে। ভালো লাগে। একটু আগে বাসের মধ্যেই পরিবেশিত হয়েছে লুচি, আলুর দম, মিষ্টি। আরামদায়ক ভলভো কোচ। সকাল সকাল ধর্মতলা থেকে যাত্রা করে বাস এই এসে দাঁড়াল শক্তিগড়ে। চায়ের বিরতি। এক দিদির কাছ থেকে মাটির ভাঁড়ে চা নিলাম। উনি জিজ্ঞেশ করলেন,”বোলপুর যাচ্ছেন”? প্রশ্নের আকারে কথাটা উচ্চারিত হলেও ঠিক প্রশ্ন ছিল না ওটা।
কয়েকটি পরিবার। এখন ৩০ জনের একটাই পরিবার। পরিচয়ের পর্ব মিটেছে বা মেটার পথে। আমরা তিনজনের ইউনিট। স্কুল-পড়ুয়া কন্যা ও কর্তা রয়েছেন সঙ্গে। ফের বাসে উঠে বসলাম। কোভিডের কারণে দীর্ঘ নিরালা-বাস যেমন বিচ্ছেদের কষ্ট দিয়েছে তেমন অন্তরঙ্গতার আকুতি বাড়িয়েছে। আমার বসার আসন সামনের দিকে। পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একবার। অচেনা কতগুলো পরিবার এবং সেইসব পরিবারের সদস্যরা এখন, এই চলমান যানে, হাসি-ঠাট্টায়, আলাপ-আলোচনায় মশগুল হয়ে রয়েছেন।
গ্রামমুখী লাল মাটির পথ, পুকুরপারে একসঙ্গে কিছু তালগাছের জটলা, হঠাৎ হঠাৎ ফুলে ফুলে ছয়লাপ পলাশ বৃক্ষ জানান দিচ্ছে, আমরা ঢুকে পড়েছি রাঢ়বঙ্গে। শান্তিনিকেতনে এসেছি কয়েকবারই। কিন্তু এবারের সফরটা যেন অন্যরকম। অনেকে মিলে যাচ্ছি বলে? হতে পারে। আজ দোলের আগের দিন। লাল মাটি, সবুজ খেত, নীল আকাশ। প্রকৃতিতে উৎসবের আহ্বান।
আমরা চলেছি ড্রিমজ খোয়াই গেস্টহাউসের ব্যবস্থাপনায়। কর্তৃপক্ষের দু’জন প্রতিনিধি চলেছেন আমাদের সঙ্গেই। থাকার জায়গাটা মূল বোলপুর শহরের বাইরে, খোয়াইয়ের সোনাঝুরির জঙ্গলের কাছাকাছি বলে জেনেছি। অপামর জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে দোলের উৎসব হচ্ছে না এবার (২০২২) বিশ্বভারতীতে। খোয়াই গেস্টহাউসে ছোট করে দোল খেলার আয়োজন থাকবে। সঙ্গে কয়েকটি কচিকাঁচা রয়েছে। ওঁদের শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও পরম্পরাটা জানিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব অনেকেরই। আপাতত আমরা আছি সঙ্গে।
বাংলো প্যাটার্নের একটা বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াল। বেশ সবুজে ঘেরা জায়গাটা। এটাই খোয়াই গেস্টহাউস। অনেকটা জায়গা নিয়ে বেশ বড়সড় গেস্টহাউস। বাড়ির একদিকের দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ প্রতিরূপের সঙ্গে একটি ইংরেজি কবিতা আঁকা আছে। কবিতাটির প্রথম দুটি লাইনঃ This is my prayer to thee, my Lord-strike,/ strike at the root of penury in my heart. জানা গেল গীতাঞ্জলির ৩৬ নম্বর কবিতা এটি। বাড়ির সঙ্গে বড়সড় একটা বাগান। সেখানে বেশ টম্যাটো ফলেছে দেখলাম। কিছু ক্যাপসিকামও আবিষ্কার করা গেল। কম্পাউন্ডের মধ্যে রংবাহারী এক পলাশ গাছ বসন্তের নিশান উড়িয়েছে। প্রান্তিক স্টেশনের কাছাকাছি গেস্টহাউসটি। হেঁটে গেলে ১০-১২ মিনিট সময় লাগবে।
সকলের স্নান ইত্যাদি সারা হলে দুপুরের খাওয়ার ডাক এল। ভাতের সঙ্গে ঘি, বেগুনভাজা, শুক্তো, মুগডাল, ফুলকপির মনোহারি, মাছের কালিয়া, চাটনি, দই সহকারে রসনা ও মন মজানো মধ্যাহ্নভোজনের পরে বারান্দায় পাতা চেয়ার টেনে বসি। চেয়ে থাকি সবুজের দিকে। জোরে হাওয়া বইলে মাটির গন্ধ পাওয়া যায়। সোনাঝুরির মুচমুচে পাতা ওড়ে। একেই কি বলে উড়ো পাতার নাচন? দূর থেকে ভেসে আসা একটা পাখির ডাক শুনতে শুনতে কখন চোখের পাতা লেগে এসেছিল। পাখিপ্রেমী কর্তার কাছ থেকে পরে জেনেছি, পাখিটার নাম ‘ব্রেন ফিভার’। এ কী অদ্ভুদ নাম। অনেকের কথাবার্তার মধ্যে চোখ জড়িয়ে আসা ঘুম ভাঙে।
কঙ্কালীতলায় চলেছে সবাই। ৫১ সতীপীঠের একটি এই কঙ্কালীতলা। সবুজের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার রাস্তাটা ভালো লাগে। খোয়াই গেস্টহাউস থেকে কঙ্কালীতলার মন্দির ৬ কিলোমিটার। কঙ্কালীতলা থেকে ফেরার পথে দেখলাম, দিগন্তরেখা থেকে লাফিয়ে উঠল চাঁদ।
ফিরে এসে গেস্টহাউসের স্থায়ী মঞ্চে ভূমিকন্যাদের নাচ দেখা গেল। আশেপাশের গ্রামগুলির প্রধাণত সাঁওতাল মেয়ে এঁরা। নাচের ছন্দে, প্রকরণে ওঁদের নিজস্ব সংস্কৃতিটাকে ধরে রাখতে পেরেছে এই ফিউশনের যুগে, এটা একটা আশার কথা।
সাতসকালে বেরনো হয়েছে। ভিতরে ঘুম কড়া নাড়ছে। নবরত্ন কারি, বাহারি চিকেন ও স্যালাড-সহযোগে রাতের আহার সেরে স্ট্রেট ঘুমের দেশে।
পরদিন ঘুম ভাঙলো সকাল সকাল। আজ দোল। কেমন একটা সুর বাজে এ-সময়ের শান্তিনিকেতনে। পলাশ গাছটা রঙে রঙে ছয়লাপ। মিষ্টি একটা বাতাস বয়ে আসছে। বেলা বাড়লে রোদ্দুরের তাপ বাড়ে। কিন্তু এই মিষ্টি বাতাসটা নানা ছন্দে বইতে থাকে দিনভর, বাঁশির সুরের মতো।
সকালে খাওয়াদাওয়ার পর্ব চলছে, বাগানের দিকে সাজো সাজো রব। লম্বা টেবিলে সাজানো হয়েছে নানা রঙের ভেষজ আবির। প্রথমে বাচ্চারা, তারপর বড়রা গুটিগুটি এগিয়ে গেল সেই টেবিলের দিকে। একদিন আগেও যাঁদের মধ্যে পারস্পরিক পরিচয় ছিল না, তাঁরা কেমন রং-খেলায় মেতে উঠেছে। বেলা বেড়েছে, রোদ চড়েছে, নীল আকাশের নীচে মিঠে হাওয়ায় দুলছে পলাশ গাছটা। গেস্টহাউসের কর্মীরা সরবত, লস্যির জোগান দিয়ে চলেছেন। ফাগুন হাওয়ায় খুশির ফাগ উড়ছে।
আজ দুপুরের খাওয়াদাওয়া একটু অন্যরকমের। গরম ভাতে ঘি, সেইসঙ্গে পাতে পড়ল সজনে ফুলের বড়া। বেড়াতে গিয়ে সজনে ফুলের বড়া খাওয়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। তারপর একে একে এল মুগডাল, আলুভাজা, এঁচোড়ের ডালনা, কাতলা মাছের তেলঝাল, চাটনি, পাঁপড় ও দই।
একটু বিশ্রাম। তারপর দলবেঁধে সোনাঝুরির হাটে। টোটোতে ৬-৭ মিনিট সময় লাগল। গেস্টহাউসের বাইরে এলেই টোটো পাওয়া যায়। হেঁটেও চলে যাওয়া যায় বেড়াতে বেড়াতে। টোটো-ভাড়ায় একটু দরদস্তুর চলে। খোয়াই গেস্টহাউস থেকে বিশ্বভারতী মিনিট পনেরোর টোটোযাত্রা।
দোলের দিনের হাট জমজমাট। গেরুয়ারঙা খাদের জাল-বিস্তার, সোনাঝুরির সবুজ বন, বাতাসের শব্দ, সবমিলিয়ে এই খোয়াই অঞ্চলটাকে বেশ রহস্যময় লাগে। বর্ষায় পাল্টে যাবে খোয়াই। খাদগুলোতে তখন জল। নতুন খাদ তৈরি হবে, পুরনো খাদের গতিপথ পরিবর্তিত হবে। ঝেঁপে বৃষ্টি নামবে সোনাঝুরির জঙ্গলে। বর্ষার খোয়াই যেন আরও বন্য। রবীন্দ্রনাথের নানা লেখায় এ হেন খোয়াইয়ের উল্লেখ পাওয়া যাবে না তা হয় নাকি? ‘খোয়াই’ শীর্ষক একটি কবিতাও আছে তাঁর।
এখন খাদগুলো শুকনো। তাতে ছড়িয়ে আছে সোনাঝুরির শুকনো পাতা। এ-খাদ, সে-খাদ বেয়ে চলে যাওয়া যায় খোয়াইয়ের গভীরাঞ্চলে। সে-কথা জানাতেই বাচ্চারা উদ্বেল। লুকোচুরি খেলবে খাদের গলিপথে। বিকেল পড়ে আসছে। অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে ওদের নিরস্ত করা হল। কথা দিতে হল, আবার আসা হবে। শিয়াল এখনো আছে কিনা এখানে, থাকলে কতগুলো আছে, এ-সব প্রশ্ন ছিল ওদের। আছে বলে পাশ কাটিয়েছি। আমিও জানতে চাই এখন। উচ্চমাকধ্যমিক পড়ুয়া আমার কন্যা প্রবল ভাবে ওদের হয়ে সওয়াল করল। কী আশ্চর্য, কয়েকবার তো শান্তিনিকেতনে এসেছি, সোনাঝুরির জঙ্গলে শিয়াল আছে কিনা, থাকলে তারা সংখ্যায় কত, সে পরিসংখ্যান জানতে চাইনি কখনো। এই স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা জানতে চাইছে।
সোনাঝুরির হাট বসে শনিবার। দুপুর ২টো থেকে সূর্যাস্তের আলো থাকা পর্যন্ত হাট চলে। সোনাঝুরি অঞ্চলটা বনবিভাগের অধীন। কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা নেই। সূর্যাস্তের মধ্যেই বিকিকিনি সেরে ফেলতে হয়। পসরা গোটানোর জন্য একটু-আধটু আলো জ্বালান দোকানিরা। তবে রাস্তার পাশের খানিকটা এলাকাতেই আর সীমাবদ্ধ নেই সোনাঝুরির হাট। খানিকটা ঢুকে পড়েছে বনের পরিসীমার মধ্যেও। পরিবেশ ক্ষুন্ন না করে আঞ্চলিক হস্তশিল্পের সম্ভার পর্যটকদের কাছে মেলে ধরার একটা শুভ প্রয়াস বলেই তো মনে হয়। রোজ নয়, সাধারণত সপ্তাহে ওই একদিনই হাট বসে। দোল উপলক্ষ্যে এ-দিনের হাট বসেছে শুক্রবারে। পরের দিন শনিবারও বসবে।
এমব্রয়ডারির শাড়ি, নানা রঙের পাঞ্জাবি, ঘর সাজানোর সামগ্রীর দোকানগুলো ঘিরে ভিড় জমেছে। বাউল গানের আসর বসেছে। আদিবাসী তরুণীদের নাচে পা মেলানো যাচ্ছে। কোথা দিয়ে কেটে গেল ঘন্টা দুয়েকের সময়।
ফিরে এলাম গেস্টহাউসে। সেখানে বাউল-সন্ধ্যা। আগের দিনের মতোই মঞ্চ ঘিরে বসার ব্যবস্থা। বিভিন্ন আখড়া থেকে এসেছেন বাউল গানের শিল্পীরা। একের পর এক গান হতে থাকল। হাতে হাতে ঘোরে চিকেন পকোড়া, কফি। ‘গাছের পাতা টাকা কেন হয় না’ গানটিতে বেশ হাততালি পড়ল।
নৈশভোজে ফের চমক। নিরামিষ আহার। বাসন্তী পোলাও, বেগুনি, ফুলকপির রোস্ট, মালপোয়া ও আইসক্রিম। চমৎকার খাওয়াদাওয়া সারা হল। দোল-ফাগুনের চাঁদের আলোয় এখন ভাসছে আশপাশটা।
পরদিন প্রাতরাশ সারা হলে বাসের আসনে গিয়ে বসলাম। ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর চালাচালি হতে থাকল। গেস্টহাউস কর্তৃপক্ষ আবার আসার অনুরোধ জানালেন। মনে মনে বলি–হ্যাঁ, আসতে হবে, বিশ্রামের জন্য, নিজের চিন্তাভাবনাগুলোকে একটু ঝাড়পোঁছ করে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য আসতেই হবে খোয়াইয়ের তীরে। খোয়াইয়ের খাদে লুকোচুরি খেলতেও আসতে হবে যে। শিয়ালের সংবাদটাও খুব দরকার।
বাস ছাড়ল। পেছন ঘুরে দেখলাম, গেস্টহাউসের রোদ-ঝকঝকে পলাশ গাছটা ঝিরঝিরে বাতাসে হেলছে, দুলছে।
খোয়াই গেস্টহাউসে ঘরের ভাড়া শুরু ১,৫০০ টাকা থেকে। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর ভাড়ায় ছাড় মেলে বলে গেস্টহাউস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। গেস্টহাউসের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরঃ ৯৮৭৫৩-৫১১৫৭, ৯৮৩৬৬-৬৯২৭৬।
ছবিঃ লেখক (প্রথম ছবিটি ছাড়া)।