রাত গভীর। জঙ্গল ঘেঁষা বনবাংলোর হাতায় কিছু জোনাকির জ্বলে ওঠা ছাড়া আলোর রেশমাত্র নেই কোথাও। রাতের জঙ্গল বলে জেগে গ্রিল দিয়ে ঘেরা বনবাংলোর বারান্দায়। মাথার উপরে নকশি কাঁথার মতো তারা ভরা এক বিশাল চাঁদোয়া কখন যেন পৃথিবীর খুব কাছাকাছি নেমে এসেছে। চাঁদ ডুবেছে অনেকক্ষণ। তবে ভোর হতে এখনো অনেকটা দেরি। একটা খুরুলে প্যাঁচা যার কেতাবী নাম বারড আউলেট হঠাৎ কর্কশ স্বরে বার দুয়েক ডেকে সামনের একটা মহানিম গাছের ডালে গিয়ে বসল। সঙ্গী নীলরতনবাবু এতক্ষণ লোহার গ্রিলে ঘেরা বারান্দায় বসেছিলেন। একটু ঢুলুনিও এসেছিল বোধহয়। প্যাঁচার ডাকে চমকে উঠে এবার পাইচারি করা শুরু করলেন।
আমরা আছি ডুয়ার্সের মেন্দাবাড়ির গভীর জঙ্গল-লাগোয়া ফরেস্ট বাংলো মেন্দাবাড়ি জঙ্গল ক্যাম্পে। পৌঁছেছি আগের দিন। ওইদিন বিকেলেই দারুণ এক অভিঞ্জতা হয়েছে আমাদের। জঙ্গল ক্যাম্পের কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া সীমানার বাইরেই ঘন গাছের সারি। সেগুলোর মধ্যে বানরের দলের অস্থির দাপাদাপির দিকে নজর রেখেছিলাম। ক্রমশ ওদের উত্তেজনার কারণটা বোঝা গেল। কাঁটাতারের বেড়ার ওপারের জঙ্গল থেকে ভেসে এল বিরক্তিসূচক চাপা গর্জন। চিতাবাঘ। স্থানীয় বন সুরক্ষা কমিটির এক সদস্যের কাছ থেকে জানা গেল, সকাল থেকেই সে রয়েছে এই চত্বরে। কাছের কোনও বনবস্তি থেকে ভোররাতে একটা শুয়োর ছানা মেরে এনেছে। বনবাংলোর হাতার পিছনের জঙ্গলে শিকার সমেত আশ্রয় নিয়েছে সারাদিনের জন্যে। দিনমানে প্রকাশ্যে আসা একেবারেই পছন্দ নয় চিতাবাঘের। সন্ধ্যে নামলে তাদের চরতে বেরনোর সময়।
সন্ধ্যা নামতেই জঙ্গলের গাছ, লতাপাতার গন্ধমাখা পরিবেশে এক বিশেষ অনুভূতি ভর করল যেন আমাদের ওপর। বাংলোর চৌহুদ্দির মধ্যে সুবিধাজনক একটা বেঞ্চ খুঁজে নিয়ে বসলাম। মাত্রই সন্ধ্যা নেমেছে। তারমধ্যেই ঘনিয়ে এসেছে অরণ্যের আঁধার। ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকল জঙ্গলের নিজস্ব ভাষা। দূর দূর থেকে ভেসে আসতে থাকল নানা শব্দ। জন্তু-জানোয়ারের ডাক। ঘন হতে থাকল জঙ্গুলে গন্ধ।
আমরা যেখানে বসে আছি তার খানিকটা পিছনে বনবাংলোর সীমানার পর থেকেই গভীর জঙ্গলের শুরু। শিরীষ, শিমূল, জারুল, সেগুন, ময়না, অমলতাস, লালী, পিঠালি, আরও কত যে নাম না জানা মহীরূহের সমাবেশ সেই জঙ্গলে। ক্কেঁয়া ক্কেঁয়া ক্কেঁয়া, একটানা ভেসে আসছিল ময়ূরের কেকাধ্বনি। নীলরতনবাবুর কথায়, “বিরহিনীর বিলাপ”। আমি মেনে নিতে পারলাম না। বললাম, “স্ত্রী ময়ূর, অর্থাৎ ময়ূরী তো এভাবে ডাকতেই পারে না, বিরহিনীর বিলাপের প্রশ্ন আসছে কীভাবে? ভদ্রলোক একটু অসন্তুষ্ট হলেন বোধহয়। বললেন, “এ সব কাব্যিক ব্যাপার, পক্ষে অনেক উদাহরণ আছে”। এমনতর কথপোকথনে বাধা পড়ল, “আপনারা এবার উঠে পড়ুন”, নিঃশব্দে কখন আমাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বনবাংলোর এক কর্মী। কথাটা নির্দেশের মতো শোনালেও এমনিতে অমায়িক ব্যবহার ওঁদের। ব্যাটারির আলো জ্বলছে বাংলোর চত্বরে। রাত দশটা পর্যন্ত জ্বলবে এই আলোগুলো। সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে আমাদের রাতের আহারের ব্যবস্থা করে রেখে বাংলোর অধিকাংশ কর্মীই চলে গেল তাদের কোয়ার্টারে। রাতবিরেতে লেপার্ডের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। তাই এই ব্যবস্থা। রাতে আমরা খেলাম ভাত আর মারকাটারি স্বাদের দিশি মুরগির কারি, সঙ্গে স্যালাড।
জঙ্গলের রাত মিস করব না বলেই মাঝ রাতে উঠে পড়া। গভীর রাতে ঝিম ধরা নৈঃসব্দের মধ্যে জঙ্গলে নিশাচর পাখির ডাক, বন্য জন্তুর ডাক যাঁরা শোনেননি তাঁদের শুধু বলে সে পরিবেশের কথা বোঝানো প্রায় অসম্ভব। চারিদিক ডুবে রয়েছে জমাট অন্ধকারে। তবে একটা-দুটো করে পাখির ডাক শুনে বোঝা গেল রাত শেষ হতে চলেছে।
পুবের আকাশ একটু একটু করে ফর্সা হচ্ছে। বাংলোর গেটে একটা লং-টেলড শ্রাইক বা মেটে লটোরা স্থির হয়ে বসে। সেদিকে তাকিয়েছিলাম। চোখে পড়ল ঘন বুনোটের একটা লতাঝোপ দুলে উঠল আচমকা। শ্রাইকটা উড়ে গেল। ভয় পেয়েছে মনে হল। কালচে ধূসর রঙের বড়সড় একটা হাতি বেরিয়ে এল জঙ্গলের মধ্যে থেকে। দুলকি চালে হেঁটে পার হয়ে গেল বাংলোর সামনের রাস্তাটা। কয়েক সেকেন্ডের বিরতি। ধুপ ধুপ করে বাংলোর গেটের আরও কাছ দিয়ে দৌডানোর ভঙ্গিতে চলে গেল আরও দুটো অল্পবয়স্ক হাতি। রাস্তা পেরিয়ে এবার একের পর এক হাতি প্রথম হাতিটির দেখানো পথ ধরে ঢুকে পড়তে লাগল অন্য দিকের জঙ্গলে। ১২-১৪টা হাতি ছিল দলে। ভালো করে আলো ফোটার আগেই হাতির দলটা জঙ্গলের আরও গভীরে আদৃশ্য হয়ে গেল।
চারপাশ একটু স্পষ্ট হতেই আমাদেরও বাংলো থেকে বেরনোর পালা। পায়ে হেঁটে ভোরের জঙ্গল দেখার মজাই আলাদা। রাস্তার নানা দিক থেকে ভেসে আসছে পাখির ডাক। এক জায়গায় লাল মাথার ফুলটুসী তথা ব্লসম-হেডেড প্যারাকিটের একটা ঝাঁক ‘টু-ইক”টু-ইক’ ডাকে বনাঞ্চলটা একেবারে মাতিয়ে রেখছে। মাঝে মাঝেই পায়ে চলা পথ আগলে রেখেছে বড় বড় মাকড়সার জাল। অনেককে দেখেছি গাছের ডাল কুড়িয়ে নিয়ে চলার পথে পড়া এইসব জাল ছিড়ে দিতে। মনে হয়েছে, এমনটা না করে জালগুলোকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যায় আনায়াসে। তাতে মাকড়সার বাসস্থান ধ্বংস হয় না। ওটা তো ওদেরই জায়গা। হাঁটতে হাঁটতে হাত দশেক দূরে এক বনমোরগ পরিবারের দেখা পাওয়া গেল। আমাদের এগতে দেখে একরাশ রং ছড়িয়ে উড়ে গেল জঙ্গলের আরও গভীরে।
সূর্য উঠেছে। সকালের রোদের তেরছা রশ্মি ঠাসবুনোট জঙ্গলের ফাঁকফোঁকর দিয়ে মাটিতে এসে পড়েছে। মন নির্মল করে সেই আলোর আলপনা।
যাওয়ার পথ
শিলিগুড়ি-আলিপুরদুয়ার রেলপথে হ্যামিলটনগঞ্জ স্টেশন থেকে মেন্দাবাড়ির দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। শিয়ালদা-আলিপুরদুয়ার কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস (১৩১৪৯) হ্যামিলটনগঞ্জ স্টেশনে দাঁড়ায়। আলিপুরদুয়ার থেকে মেন্দাবাড়ির দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার।
থাকার ব্যবস্থা
সংস্কারের কাজ চলায় বর্তমানে মেন্দাবাড়ি জঙ্গল ক্যাম্পের বুকিং বন্ধ আছে। এই বনবাংলোর পরিচালন সংস্থাও বদল হতে চলেছে। ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির হাত থেকে ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের হাতে। সেক্ষেত্রে ভাড়াও কিঞ্চিৎ কমার সম্ভাবনা রয়েছে। খুব শীঘ্রই বুকিং শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মেন্দাবাড়ি জঙ্গল ক্যাম্প ছাড়াও এখানে রয়েছে মেন্দাবাড়ি ব্লু হোমস্টে। তিন শয্যার ঘরের ভাড়া ১২০০ টাকা। জনপ্রতি সারাদিনের খাওয়ার খরচ ৫০০ টাকা। যোগাযোগের নম্বরঃ ৯৭৩৩৩৩০৭১০।
হ্যামিলটনগঞ্জ বা আলিপুরদুয়ার থেকে গাড়ি-সহ সামগ্রিক ভ্রমণ ব্যবস্থাপনার জন্য শিবুন ভৌমিকের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারেন। ডুয়ার্স অঞ্চলটিকে হাতের তালুর মতোই জানেন শিবুনবাবু। ডুয়ার্স পর্যটন ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। যোগাযোগের নম্বরঃ ৯৮৩২৩৬৫১২৩