দার্জিলিং জেলায় ছড়ানো দশটি ভ্রমণ ঠিকানার কথা এখানে। কোনও একটি জায়গায় থেকে বেড়িয়ে নেওয়া যায় আরও নানা শান্ত, সুন্দর পাহাড়ি এলাকা, এমন ভাবে বাছাই করা হয়েছে এই দশ ঠিকানা।
শেলপু গ্রাম
শেলপু একেবারেই এক নতুন ভ্রমণ ঠিকানা। ৪০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত শেলপু লাটপাঞ্চার থেকে ৪ কিলোমিটার, অহলদাড়া থেকে ১ কিলোমিটার। পাখি, প্রজাপতি, ফুল, সুন্দর করে সাজানো ছোট ছোট বাড়ি, কমলালেবুর বাগান, দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা, পাহাড়ের জীবনের খণ্ডচিত্র, এ সব নিয়ে শেলপু গ্রাম। বেড়িয়ে আসা যায় আরেক ভ্রমণ ঠিকানা চটকপুর থেকে।
মাহালদিরাম, বাগোরার মতো অফবিট টুরিস্ট স্পট হয়ে চটকপুর পৌঁছাতে হয়। পথে পড়বে আরও নানা গ্রাম। পথের বিভিন্ন জায়গা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা দেবে। বাগোরা, মাহালদিরাম ও চটকপুরে থাকার জন্য হোমস্টে রয়েছে।
শেলপুর গা ঘেষেঁ অহলদাড়া পাহাড়ের ভিউপয়েন্ট। ওখানে থাকার ব্যবস্থা আছে। ভোরে রঙের খেলা শুরু হয় কাব্রু, সিনিয়ালচু শৃঙ্গে। সেই জাদুকরী সূর্যোদয়ের সাক্ষী থাকতে খুব ভোরে পৌঁছে যেতে হয় অহলদাড়ায়। লাটপাঞ্চার মহানন্দা অভয়ারণ্যের সর্বোচ্চ পয়েন্ট এটি। উচ্চতা ৫,০০০ ফুট।
পাখির আবাস হিসেবে বিশেষ নাম কিনেছে লাটপাঞ্চার। রুফাস নেকড হর্নবিল, মিনিভেট, ফ্যালকন, ঈগল, ক্রেস্টেড সারপেন্ট ঈগল, স্কারলেট মিনিভেট, সুলতান টিট, এমারেল্ড ড্রোভ, গ্রিন-বিলড মালখোয়া, ব্ল্যাক বাজা, মাউন্টেন স্কপস আউল ইত্যাদি সহ ২০০-র বেশি পাখির দেখা পাওয়া যায় লাটপাঞ্চারে।
যাওয়ার পথ
এন জে পি বা শিলিগুড়ি থেকে সেবক, কালিঝোরা হয়ে রাস্তা। কালিঝোরা শিলিগুড়ি থেকে ৩০ কিলোমিটার। কালিঝোরা থেকে বাঁদিকের রাস্তা ধরে শাল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে খানিকটা খাড়াই পথে ১৭ কিলোমিটার চলে এলে লাটপাঞ্চার। এখান থেকে অহলদাড়া ৩ কিলোমিটার। পাশে শেলপু গ্রাম। কালিঝোরা পর্যন্ত শেয়ার গাড়িতে এসে সেখান থেকে প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে শেলপু আসা যেতে পারে।
থাকার ব্যবস্থা :
শেলপু গ্রামেঃ মেঘদ্বার হোমস্টে, ফোনঃ ৯৭৩৩৪-৩২৪৭৭, ৭৬৭৯৬-৭৩৭৬১। কাসিস হোমস্টে, ফোনঃ ৮৫১৫৮-৮৮২৮৪।
পুবং
পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা সবুজ এক উপত্যকা। পাহাড়ের ঢালে ঢালে চায়ের বাগান। সেখানে চরে বেড়ায় মেঘের দল। এ পাহাড়ে ছায়া তো ও পাহাড়ে রোদ্দুর। চারিদিকে সবুজের রাজ্যপাট। বাতাসে বনজ আঘ্রাণ। শান্ত পরিবেশ। ইতিউতি শুধু পাখির ডাক।
রাতে পাইনের ঘন জঙ্গল থেকে ভেসে আসতে পারে কোনও বন্যপ্রাণীর ডাক। পুবং-সংলগ্ন জঙ্গলে বসত করে ভাল্লুক, হরিণ, বুনো শুয়োর, প্যাঙ্গোলিন, ময়ূর, বনমুরগি, লেপার্ড। পুবং গ্রামের বাসিন্দাদের বক্তব্য, তাঁরা লেপার্ড দেখে থাকেন। ভাবা যায়? ব্যস্ত ঘুম স্টেশন এলাকা থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরের জঙ্গলে বিচরণ করে লেপার্ড।
চৌরাস্তা, চকবাজার ইত্যাদি নিয়ে যে দার্জিলিং শহর, তা থেকে কমবেশি ১৩ কিলোমিটার দূরে জোরবাংলো-সুখিয়াপোখরি ব্লকে মেঘের আড়ালে পুবং উপত্যকায় ১৯১৩ সালে পুবং টি এস্টেট গড়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠাতা নামী চা উৎপাদক সংস্থা ডানকানস।
যাঁরা প্রকৃতির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তার রূপ রস বর্ণ গন্ধে অবগাহন করতে চান, বুক ভরে টেনে নিতে চান বিশুদ্ধ বাতাস তাঁদের জন্য এ জায়গা। দু’-একটা দিন এখানে কাটাতে পারলে প্রাণশক্তি পুনরুজ্জীবীত হয়।
যাওয়ার পথ
দার্জিলিং শহর থেকে পুবং ১৩ কিলোমিটার। ঘুম স্টেশন থেকে ৮ কিলোমিটার।
থাকার ব্যবস্থা
চায়ের বাগিচার কাজকর্মের জন্যই ১৯৩৫-এ গড়ে তোলা হয়েছিল একটি বাংলো। সামনে পহাড়ের সারি, কাছেই বালাসন নদী, একটু হেঁটে গেলে ঝরনা, পাহাড়ের ঢালে চায়ের বাগান আর জঙ্গল, এমন পরিবেশের মধ্যে ছবির মতো দ্বিতল বাংলোটির অবস্থান। ব্রিটিশ আর্কিটেকচার। সামনে সবুজ লন। প্রশস্ত জানালা, চওড়া ব্যালকনি, ঘরে ঘরে ফায়ারপ্লেস। এককালের ‘প্ল্যান্টার্স বাংলো’। থাকার ব্যবস্থা এখানেই, এখনকার পুবং টি রিসর্টে। রিসর্টের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরঃ ৯৬৭৪০৮৪০৬৭, ৯৮৩৬৫৮৪০৩২।
চাটাইধুরা
ব্যস্ত দার্জিলিং শহর থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার। কিন্তু ঘন সবুজ কনিফার অরণ্যে ঘেরা শান্ত নিরালা চাটাইধুরা আরেকটি শান্তির রাজ্য। দার্জিলিং জেলার নতুন ভ্রমণ ঠিকানা। চাটাইধুরায় প্রকৃতি নিবিড়ভাবে ঘিরে থাকবে আপনাকে। প্রায় ৭,০০০ ফুট উচ্চতার চাটাইধুরা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য, সে দেখার ব্যাপার। চাটাইধুরার হাওয়াঘর ভিউপয়েন্ট থেকে নীচের উপত্যকা, কাঞ্চনজঙ্ঘা-সহ নানা শৃঙ্গ, দার্জিলিং শহর, সান্দাকফু শীর্ষের দৃশ্য খুব সুন্দর। খানিকটা ট্রেক করে হাওয়াঘর ভিউপয়েন্টে উঠতে হয়।
জঙ্গলের পাশের নিরালা রাস্তা ধরে হাঁটুন। নানা পাখির দেখা পাবেন। কাছেই পরিচিত ভ্রমণ ঠিকানা লেপচাজগৎ। চাটাইধুরা থেকে বড়জোর দেড় কিলোমিটার। হাঁটাপথেই লেপচাজগৎ থেকে বেড়িয়ে আসা যায়। চাটাইধুরা থেকে ঘুম ৫ কিলোমিটার। ঘুম স্টেশন থেকে টয়ট্রেনে চড়ে খানিকটা বেড়িয়ে আসতে পারেন। দিনে দিনে দার্জিলিং থেকেও বেড়িয়ে আসা যায়।
যাওয়ার পথ
শিলিগুড়ি থেকে চাটাইধুরা ৬৩ কিলোমিটার। শিলিগুড়ি অথবা এন জে পি থেকে প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে সরাসরি চাটাইধুরা চলে আসা যায়। শিলিগুড়ি থেকে ঘুম ৫৮ কিলোমিটার। শিলিগুড়ি অথবা এন জে পি থেকে শেয়ার গাড়িতে ঘুম পৌঁছে সেখান থেকে আরেকটা গাড়িতে চাটাইধুরা পৌঁছাতে পারেন।
থাকার ব্যবস্থা
লপচান হোমস্টে, ফোনঃ ৮৯১৮৬-৮১২২৯, ৮৩৪৩৮-১৯৮৩৯।
লামাগাঁও
বিজনবাড়ি থেকে ছবির মতো ১২ কিলোমিটারের পাকদণ্ডী পথ ধরে চলে আসুন দার্জিলিং জেলার লামাগাঁওয়ে । মূল দার্জিলিং শহর থেকে দূরত্ব ৩৪ কিলোমিটারে। ৫,২০০ ফুট উচ্চতার লামাগাঁও থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য এককথায় অসাধারণ। শীতে লামাগাঁওয়ের গভীর খাদ ঘন কুয়াশায় ভরে থাকে। জানলা, দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে আসে সেই কুয়াশা। গ্রীষ্মের লামাগাঁও আরামদায়ক। পাহাড়ের ঢালে জৈব চাষ হয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে লামাগাঁওয়ের ঘন সবুজের সঙ্গে কমলা রঙের মিশেল ঘটে। তখন লামাগাঁও বড় বর্ণময়। সত্যি কথা বলতে কী লামাগাঁও চমৎকার।
পরিষ্কার দিনে লামাগাঁওয়ের পাহাড় থেকে দার্জিলিংয়ের বিস্তৃত চা বাগান দেখা যায়। দেখা যায় দার্জিলিং শহরটিকেও। রাতের দার্জিলিংয়ের আলোর মালা খুবই রোমান্টিক। আর মাথার উপরে থাকবে তারকাখচিত আকাশ। সকালে লামাগাঁওয়ের রাস্তায় বেরিয়ে পড়ুন। পাখির ডাকে চমৎকৃত হবেন। পাহাড়ি ফুলের রঙের বাহার মন ভালো করে দেবে। চোখে পড়তে পারে অর্কিডগুচ্ছ।
যেতে পারেন ১২ কিলোমিটার দূরের বিজনবাড়ি। যাওয়ার রাস্তাটি খুব সুন্দর। চাইলে বিজনবাড়িতে ছোটা রঙ্গীতে মাছ ধরতে পারেন। ছোট ছোট ট্রেক করা যায় লামাগাঁও থেকে। আর প্রকৃতির মধ্যে একশ শতাংশ বিশ্রামের সু্যোগ তো রইলই।
যাওয়ার পথ
এন জে পি থেকে লামাগাঁও ১০২ কিলোমিটার। এন জে পি অথবা শিলিগুড়ি থেকে প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে সরাসরি লামাগাঁও পৌঁছে যাওয়া যায়। অন্যথায় এন জে পি অথবা শিলিগুড়ি থেকে ঘুম পর্যন্ত এসে সেখান থেকে আরেকটি গাড়িতে লামাগাঁও হবে। দার্জিলিং থেকে লামাগাঁও ৩০ কিলোমিটার, ঘুম থেকে ৪০ কিলোমিটার।
থাকার ব্যবস্থা
লামাগাঁও হোমস্টে। এটি লামাগাঁওয়ের পুরনো হোমস্টে। হোমস্টের জমিতে বিভিন্ন সবজি ও ফলের চাষ করা হয়। ট্রেকিং, ফিশিং, সাইটসিয়িংয়ের ব্যাপারে হোমস্টে থেকে সহায়তা করা হয়। ফোনঃ ৭০৪৭০-৯৮৬৯৫।
বিজনবাড়ি
দার্জিলিংয়ের ভ্রমণ মানচিত্রে বিজনবাড়ি দ্রুত বিশিষ্ট জায়গা করে নিচ্ছে। ঘুম স্টেশন রোড় থেকে ২২ কিলোমিটার। পাহাড়ে ঘেরা একটি উপত্যকার মধ্যে বিজনবাড়ির অবস্থান। উচ্চতা ২,৫০০ ফুট। পথে পড়বে হিমা জলপ্রপাত, কয়েকটি চোখ জুড়ানো চা বাগান। আর পথের কয়েকটি জায়গা থেকে উপরের দিকে দার্জিলিং শহরটিকে দেখা যাবে নতুন চোখে। সবমিলিয়ে অপূর্ব সুন্দর এক পথ ধরে যাত্রা শেষ আপনি পৌঁছাবেন বিজনবাড়ি।
বিজনবাড়ির এক পাশ দিয়ে বইছে ছোটা রঙ্গীত নদী। এ কারণে বিজনবাড়ির উপত্যকাটি সুফলা। কমলালেবু্, আনারসের বেশ কিছু বাগিচা রয়েছে নদী-সন্নিহিত এলাকায়। ফল ছাড়াও নানা সবজি ও শস্যেরও চাষ হয় বিজনবাড়ির উর্বর জমিতে। বিজনবাড়ির পুলবাজার বা পালবাজার এলাকায় রয়েছে সুন্দর একটি মন্দির। পাথরে খোদাই করে দুর্গা, শিব, গণেশের মূর্তি রয়েছে মন্দিরটিতে।
বিজনবাড়ি ঘুরে দেখতেই অনেকটা সময় লেগে যাবে। দেখবেন দার্জিলিংয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জীবনযাপন। উপত্যকার নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়ান। ছোটা রঙ্গীত নদীর ধারে গিয়ে বসুন। চাইলে নদীতে মাছ ধরতে পারেন। হাইকিং, ট্রেকিংয়ে আগ্রহ থাকলে বিজনবাড়ি দারুণ এক স্ট্র্যাটেজিক কেন্দ্র হতে পারে। বিজনবাড়ি থেকে রেলিং (৮ কিলোমিটার) হাইকিং হতে পারে। হেঁটেই চলে যাওয়া যায় সোম টি এস্টেট, ঘন্টা চারেক সময় লাগবে। চলে যেতে পারেন কলবংয়ে। এখান থেকে সিকিমের কিছু অঞ্চল চমৎকার দেখা যায়।
যাওয়ার পথ
সকালে দার্জিলিংয়ের বাসস্ট্যান্ড থেকে বিজনবাড়ি যাওয়ার বাস ছাড়ে। দার্জিলিংয়ের চক বাজার এলাকা থেকে বিজনবাড়ি যাওয়ার শেয়ার গাড়ি পাবেন। ঘুম থেকেও বিজনবাড়ি যাওয়ার গাড়ি পাওয়া যাবে।
থাকার ব্যবস্থা
মেগিটার হোমস্টে, ফোনঃ ৯৯৩২১-৭৮১১৩, ৯৩৮২২-০৫৬৭২। বিজ্জু ভিলেজ রিট্রিট, ফোনঃ ৯৭৩৫৫-৮৫৫৫৫। রেলিং রঙ্গীত রিসর্ট, ফোনঃ ৯৮০০৩-১৫৩৪০।
তাকদা
ছবির মতো গ্রাম তাকদা। লেপচা ভাষায় ‘তুকদা’ শব্দের অর্থ ‘কুয়াশা’। তুকদা থেকে তাকদা। কুয়াশা-মাখা পাহাড়ি পথ, আশ্চর্য রং-রূপের অর্কিড, পাহাড়ের ধাপে ধাপে তরঙ্গায়িত সবুজ চা-বাগিচা, পাখির ডাক, ঝোরার জলধ্বনি, এ সব নিয়ে অপরূপ তাকদা। দার্জিলিং শহর থেকে ত ২৮ কিলোমিটার। রাতে তাকদার পাহাড় থেকে আলোকমালায় সজ্জিত দার্জিলিংয়ের রূপটি দেখবার মতোই।
৪০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত তাকদাকে মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশরা। তৈরি হয়েছিল সুন্দর সুন্দর বাংলো। কোনও কোনও বাংলো এখন হেরিটেজ হোমস্টে হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাকদার অর্কিড সেন্টারটি কিন্তু না দেখলেই নয়।
তাকদা বাজার এলাকা থেকে ২ কিলোমিটার নীচে রংলি রংলিয়ট চা বাগান দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে। অনেক নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে তিস্তা। তাকদা বাজার এলাকা ছাড়িয়ে একটু এগলেই দেখবেন বোল্ডার বাঁধানো একটি পথ উঠে গেছে উপরের দিকে। ওই পথ ধরে পৌঁছাবেন একটি মনাস্ট্রিতে। মনাস্ট্রি চত্বর থেকে চারপাশের দৃশ্য, বিশেষ করে চা বাগানের অসাধারণ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায়। ঘুরে দেখতে পারেন ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীর বাংলোগুলি। সিডার আর পাইন বনের মধ্যে দিয়ে এক চক্কর বেড়িয়ে আসতে পারেন। বনপথে ট্রেক করে যেতে পারেন লামাহাটায়। চাইলে লামাহাটা থেকে তিনচুলে হয়ে তাকদায় ফিরে আসতে পারেন। এই ট্রেকিংয়ে একজন আঞ্চলিক গাইড সঙ্গে থাকলে সুবিধা হবে।
যাওয়ার পথ
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে তাকদা ৬০ কিলোমিটার, শিলিগুড়ি থেকে ৫২ কিলোমিটার। উভয় জায়গা থেকেই গাড়ি ভাড়া করে তাকদা চলে আসা যায়।
থাকার ব্যবস্থা
সাইনো-দি হেরিটেজ গেস্টহাউস, ফোনঃ ৯৪৩৪৪-৬২৮০৬। শায়ন হোমস্টে, ফোনঃ ৮৬০৯১-২৮৮৪১। তাকদা হেরিটেজ কলোনিয়াল বাংলো নম্বর ১২, ফোনঃ ৯০০২৬-৭৭৭৭৯। সাই হৃদয়ম-আ ব্রিটিশ হেরিটেজ বাংলো, ফোনঃ ৮০০১৯-০১১৭২। গ্লেন মারি হোমস্টে, ফোনঃ ৮২৫০২-১২১৪১, ৬২৯৫৩-৫৬৮০৯।
তিনচুলে
তিনচুলের ভিউপয়েন্টকে কাঞ্চনজঙ্ঘায় বর্ণবহুল সূর্যোদয় দেখার ব্যালকনি বলা চলে। সূর্যোদয়ের অপরূপ সেই দৃশ্য বহুদিন মনে থাকবে। একটি ছোট্ট ও নিরালা গ্রাম। ছবির মতো অল্প কিছু বাড়িঘর। তিনচুলে ফুলেরও গ্রাম। বাড়িতে বাড়িতে যত্নলালিত অর্কিড ও অন্যান্য ফুলের গাছ, চলার পথের ধারে ধারে চেনা-অচেনা ফুলের ঝাড় তিনচুলেকে রঙিন করে রাখে বছরভর। দার্জিলিং শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে ৫৮০০ ফুট উচ্চতায় তিনচুলের আবস্থান। তাকদা থেকে তিনচুলে মাত্র ৩ কিলোমিটার। সামান্য ঊর্ধমুখী পথ ধরে তাকদা থেকে তিনচুলে পৌঁছাতে
হয়।
তিনচুলে থেকে রংলি রংলিয়ট ও পেশক চা বাগানের দৃশ্য অতীব সুন্দর। দেখবেন তিনচুলে মনাস্ট্রি। একটু হেঁটে অবশ্যই গুম্বাদাড়া ভিউ পয়েন্টে যাবেন। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও এবং রঙ্গীত নদীর দৃশ্য অপরূপ। তিনচুলেতে যদি থাকার ব্যবস্থা হয় তবে ডে টুরে অবশ্যই তাকদা বেড়িয়ে আসবেন। কাছেই আরেক ভ্রমণ ঠিকানা লামাহাটা।
যাওয়ার পথ
এন জে পি থেকে তিনচুলে ৭৩ কিলোমিটার। এন জে পি বা শিলিগুড়ি থেকে তিনচুলে যাওয়ার গাড়ি পাবেন।
থাকার ব্যবস্থা
গুরুং গেস্টহাউস, ফোনঃ ৯৯৩৩০-৩৬৩৩৬। তিনচুলে হিমালয়ান হোমস্টে, ফোনঃ ৯৭৩৩২-৬৬৬৩৩। তিনচুলে রাই রিসর্ট, ৯৭৩৩২-৪২৮৭৬। হামরো তিনচুলে হোমস্টে, ৯৭৩৩২-৮১৭৮৪।
লামাহাটা
তাকদা, তিনচুলের প্রতিবেশী আরেকটি শান্ত, সুন্দর গ্রাম লামাহাটা। উচ্চতা ৫৭০০ ফুট। দার্জিলিং থেকে লামাহাটার দূরত্ব ২৩ কিলোমিটার। তিনচুলে থেকে পেশক চা বাগানের মধ্যে দিয়ে রাস্তা ধরুন। পেশক ভিউ পয়েন্ট থেকে চারপাশের অপরূপ দৃশ্যপট দেখুন। চা বাগানের ওই রাস্তা পেশক রোডে মিলিত হয়েছে। পেশক রোডে পৌঁছে বাঁয়ে মোড় নিয়ে লামাহাটায় চলে আসুন।
পরিবেশবান্ধব পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে অতি দ্রুত সুনাম অর্জন করেছে লামাহাটা। পথের ধারে যত্নলালিত চমৎকার একটি বাগান লামাহাটার বিশেষ আকর্ষণ। মরসুমী ফুল, বিভিন্ন প্রজাতির অর্কিডের বাহার দেখা যায় এই বাগানে। একটি নজরমিনার রয়েছে বাগানের মধ্যে। সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, তিস্তা ও রঙ্গীত নদী, সিকিমের পর্বতশ্রেণি দেখা যায়।
লামাহাটায় থাকলে বনের মধ্যে দিয়ে খানিকাটা হেঁটে আসতে পারেন। পাহাড়ের উপরের দিকে রয়েছে ছোট একটি জলাশয়। আঞ্চলিক অধিবাসীদের কাছে এটি অত্যন্ত পবিত্র জলাশয়। ছোট ট্রেক করে চলে যেতে পারেন এই জলাশয়টির কাছে। এরকমই ছোট ট্রেকপথে যেতে পারেন ৮-মাইল অর্গানিক সেন্টার। দেখতে পারেন জৈবচাষের নানা পদ্ধতি। মাঝারি দৈর্ঘ্যের ট্রেক করতে চাইলে যেতে পারেন মাটি, পাথর ইত্যাদি দিয়ে তৈরি ছোট্ট একটি বৌদ্ধ মনাস্ট্রির চত্বরে। ট্রেকিংয়ের পথটি অসাধারণ। এই পথে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও সিঙ্গালিলা রেঞ্জের দৃশ্য ভালো লাগবে। পথে পড়বে তুতি হাত্তা চা বাগান। চা বাগানের ছোট্ট টি-শপে ঢুকে প্রকৃতই অর্গানিক চায়ের স্বাদ যাচাই করে নিতে নিতে ভুলবেন না যেন।
যাওয়ার পথ
এন জে পি অথবা শিলিগুড়ি থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে-৩১, লপচু ও পেশক টি এস্টেট রোড ধরে লামাহাটা ৬৯ কিলোমিটার। শিলিগুড়ি থেকে জোরবাংলো হয়ে লামাহাটা ৭২ কিলোমিটার। দার্জিলিং থেকে লামাহাটা ২৩ কিলোমিটার। কালিম্পং থেকে লামাহাটা ৪১ কিলোমিটার।
থাকার ব্যবস্থা
এভারেস্ট হাট হোমস্টে, ফোনঃ ৮৫৩৮০-৮৭১০৫। লামাহাটা মাউন্টেন ভিউ হোমস্টে, ফোনঃ ৯৭৭৫৪-৮২০২৭। লামাহাটা ফার্মস, ফোনঃ ৯৮০০০-২৪৫৫৩। লামাহাটা দ্রুক হোমস্টে, ফোনঃ ৯৯৩৩০-২০৩৯১।
পালমাজুয়া
দার্জিলিংয়ের মানেভঞ্জন থেকে ধোতরে ১৭ কিলোমিটার। ধোতরের উচ্চতা ৮৫০০ ফুট। ধোতরে থেকে খানিকটা ঢালু পথে আরো ৫ কিলোমিটার অতিক্রম করলে সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যানের প্রান্তসীমায় ছবির মতো ছোট্ট গ্রাম পালমাজুয়া। নিবিড় নৈঃশব্দ ছেয়ে থাকে পালমাজুয়ায়। গ্রামে কয়েকটি পরিবারের বসতি। চতুর্দিকে পাহাড়। একটা ঝরনা আছে। ছবির মতো ছোট্ট একটা সেতু। আর আছে নির্দোষ বাতাস। দিনদুয়েকের নির্ভেজাল অবকাশ যাপন করতে চাইলে পাহাড়ি গ্রাম পালমাজুয়া এক চমৎকার ঠিকানা। এখানে ঘুমপাড়ানিয়া ঝরনার কলধ্বনি সারারাত জেগে থাকে।
একেবারে পালমাজুয়া গ্রাম থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পাবেন না। ভোর ভোর গাড়ি নিয়ে চলে যান তিনশুলে। তিনচুলে নয় কিন্তু, তিনশুলে। এখানে জঙ্গলের পথ ধরে একটু এগোলেই সেই সোনার পাহাড়ের দেখা পাবেন। পাখি পর্যবেক্ষণের নেশা যাঁদের, তাঁদের কাছে এ জায়গাটা স্বর্গরাজ্য। পালমাজুয়া গ্রাম থেকে কমবেশি আড়াই কিলোমিটার দূরে মনিখোলাতেও নানা জাতের পাখির দেখা মেলে।
হাতে একটু সময় থাকলে আর সঙ্গে গাড়ি থাকলে শ্রীখোলা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেন। গাড়িতে ঘন্টা দেড়েক সময় লাগবে। একটু থেমে থেমে গেলে ঘন্টা দুয়েক। রিম্বিক হয়ে যেতে হবে। রিম্বিক থেকে শ্রীখোলা ৪ কিলোমিটার। পালমাজুয়া থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার। মানেভঞ্জন থেকে শ্রীখোলা ৪১ কিলোমিটার। পথে পড়বে লোধমা নদী। নদীর ধার দিয়ে সে এক চমৎকার যাত্রা।
যাওয়ার পথ
শিলিগুড়ি বা এন জে পি থেকে গোটা টুরের জন্য গাড়ি ভাড়া করে নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে মিরিক হয়ে যাওয়া ঠিক হবে। পথের দৈর্ঘ্য অপেক্ষাকৃত কম হবে। এ পথের বৈচিত্রও বেশি। পথ অনেকবারই নেপালের মধ্যে ঢুকবে। চাইলে দার্জিলিং বা ঘুম পৌঁছে সেখান থেকেও গোটা টুরের জন্য গাড়ি ভাড়া করে নিতে পারেন। দার্জিলিঙের চকবাজার থেকে মানেভঞ্জন পর্যন্ত শেয়ার গাড়ি পাওয়া যায়। মানেভঞ্জন পৌঁছে সেখান থেকেও পালমাজুয়া যাত্রার জন্য গাড়িভাড়া করতে পারেন। শেয়ার গাড়িতে করেও গোটা ট্রিপটা সম্পূর্ণ করা যায় অবশ্য। তাতে সময় একটু বেশি লাগবে।
থাকার ব্যবস্থা
সিঙ্গালীলা জঙ্গল লজ পালমাজুয়ায় থাকার একটি সুন্দর ব্যবস্থা। এখানে রয়েছে দুটি দ্বিশয্যার কটেজ, দুটি ডিলাক্স রুম, একটি চার শয্যার কটেজ। যোগাযোগের নম্বর: ৮৬৭০৮৯১৫৭৪।
শ্রীখোলা
সান্দাকফু, ফালুট ট্রেক করে ফেরার পথে সাধারণত শ্রীখোলা বিশ্রামস্থল। সান্দাকফু-ফালুট থেকে ফেরত-পথে ট্রেকিংয়ের শেষ পয়েন্ট শ্রীখোলা। গাড়ি চলাচল করে শ্রীখোলা পর্যন্তই।
নদীর নামে গ্রামের নাম। নদীর নাম শ্রীখোলা। গ্রামের নামও তাই। ৩,৬০০ ফুট উচ্চতার শ্রীখোলা বৃহত্তর দার্জিলিংয়ের আরেক রূপ। সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ। তার মধ্যে ইতিউতি ছড়িয়ে কিছু কাঠের বাড়িঘর। বাড়িগুলো সুদৃশ্য কটেজের মতো দেখতে লাগে। সামনে ছোট ছোট ফুলের বাগান। পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে বয়ে চলেছে শ্রীখোলা নদী। নদীর ধারে গিয়ে বসুন। বিশুদ্ধ বাতাসে শরীর-মনের ক্লান্তি উধাও হবে। চাইলে নদীতে মাছ ধরতে পারেন। প্রচুর ট্রাউট মাছ আছে শ্রীখোলা নদীতে।শ্রীখোলা নদীর ওপর ছোট্ট সেতুটি ছবির মতো মনে হয়। বেড়ান গ্রামের মধ্যে। একটি মনাস্ট্রি আছে শ্রীখোলা গ্রামে। সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যানের পাদদেশে শ্রীখোলা গ্রামের অবস্থান। গ্রামের প্রান্তে বার্চ, পাইনের বন। গ্রামের মধ্যে বড় এলাচ, ভুট্টার চাষ হয়।
শ্রীখোলা থেকে নানা দিকে ট্রেকিংয়ের সু্যোগও যথেষ্ট। শ্রীখোলা থেকে ৬ কিলোমিটার ট্রেক করে ৭,১৫০ ফুট উচ্চতার গুরদাম উপত্যকায় যাওয়া যায়। ঘন অরণ্যে ঘেরা গুরদাম উপত্যকার বন্য রূপের একটা বিশেষ সৌন্দর্য আছে। এই গুরদাম থেকে আরও ১০ কিলোমিটার ট্রেক করে পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ পয়েন্ট ১১,৯২৯ ফুট উচ্চতার সান্দাকফুতে পৌঁছে যাওয়া যায়। অর্থাৎ শ্রীখোলা থেকে মোট ১৬ কিলোমিটার ট্রেক করে সান্দাকফু পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে। আবার শ্রীখোলা থেকে ১২ কিলোমিটার ট্রেক করে রাম্মাম পৌঁছানো যায়। রাম্মামের উচ্চতা ৮,৪০০ ফুট। রাম্মাম থেকে ৯ কিলোমিটার এগলে গোর্কে গ্রাম। গোর্কে থেকে আরও ১৫ কিলোমিটার ট্রেক করে পৌঁছানো যায় ফালুট, উচ্চতা ১১,৮১১ ফুট। সান্দাকফু থেকে ফালুটের দূরত্ব ২১ কিলোমিটার। শুধু শ্রীখোলা থেকেই বেড়িয়ে আসা যায়। সঙ্গে একটা ছোট ট্রেকিং যুক্ত করে নিলে সে ভ্রমণ হবে আরও রোমাঞ্চকর।
যাওয়ার পথ
এন জে পি স্টেশন থেকে শ্রীখোলা ১৩২ কিলোমিটার। দার্জিলিং থেকে পুলবাজার-জোরথাং রোড হয়ে শ্রীখোলা ৬১ কিলোমিটার। এন জে পি বা শিলিগুড়ি থেকে মানেভঞ্জন বা ঘুম চলে আসা যায়। ঘুম থেকে মানেভঞ্জন যাওয়ার শেয়ার গাড়ি পাওয়া যাবে। মানেভঞ্জন থেকে শ্রীখোলা ৪১ কিলোমিটার। বেলা ১টা নাগাদ শিলিগুড়ির দার্জিলিং মোড় থেকে সরাসরি শ্রীখোলা যাওয়ার শেয়ার জিপ ছাড়ে (সাধারণত)। দার্জিলিং থেকেও সকালে ও দুপুরে শ্রীখোলা যাওয়ার শেয়ার জিপ ছাড়ে। ম্যাল থেকে খানিকটা নেমে জিপ স্ট্যান্ডে গিয়ে শেয়ার জিপের খোঁজ নেবেন।
থাকার ব্যবস্থা
হোটেল শোভরাজ, ফোনঃ ৯৯৩৩৪-৮৮২৪৩, ৯৮৩২৩-৭৫৫৪৬। লিপ্পোহোচ্ছা হোমস্টে, ফোনঃ ৮৯৭২৮-৫৯২৩১, ৯৭৩৫০-৩৪৬২৬, পানকর্মা হোমস্টে, ফোনঃ ৭০০১৯-৬৭২৯৭। রেড পান্ডা হোটেল হোমস্টে, ফোনঃ ৯৭৩৩০-৬১৭৯৩।
ব্যানার ফটোঃ দূর থেকে ভুটিয়া বস্তি মনাস্ট্রি;
ফটো সৌজন্যঃ দার্জিলিং প্রশাসন।