পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট একটি রাজ্য। শান্ত, সুন্দর সিকিমের অসংখ্য ঝর্ণা, উপত্যকা, বনাঞ্চল পর্যটকদের কাছে দুর্নিবার আকর্ষণ। আর সেই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে যেখান সেখান থেকে দৃশ্যমান কাঞ্চনজঙ্ঘা। পরিচ্ছন্নতা সিকিমের মূলমন্ত্র। পাহাড় ঢালের চাষ-আবাদ সব জৈব পদ্ধতিতে। এ হেন সিকিম ভারতের পর্যটন মানচিত্রে যে একটি বিশিষ্ট জায়গা করে নেবে তাতে আর আশ্চর্য কী।
প্রচুর ভ্রমণপ্রিয় মানুষ বেড়াতে যান সিকিমে। সে ভ্রমণে হিমালয়ের কোলের এই ছোট্ট পাহাড়ি রাজ্যটির মানুষজনের জীবনযাপন, উৎসব-অনুষ্ঠান, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ মেলে। সুযোগটা হাতছাড়া করা উচিৎ হবে না।
বেড়ানোর সঙ্গে ওতপ্রতো যুক্ত থাকে খাওয়াদাওয়া। খাবার টেবিলে দু-একটি আঞ্চলিক পদের স্বাদ গ্রহণের মধ্যে দিয়ে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের খাদ্য-সংস্কৃতির আঁচ পাওয়া যেতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে সিকিমে তিব্বতী, নেপালী, ভুটিয়া খাদ্যরীতির একটা মিলমিশ ঘটেছে। অন্যদিকে রয়েছে সিকিমের আদি বাসিন্দা লেপচাদের খাদ্যাভ্যাস। সব মিলিয়ে গড়ে উঠেছে সিকিমের খাদ্য সংস্কৃতি।
এখানে গ্যাংটকের কোন কোন রেস্তোরাঁয় আঞ্চলিক কী কী পদ পাওয়া যেতে পারে তার একটা সংক্ষিপ্ত মানচিত্র পেশ করা গেলঃ-
টেস্ট অফ টিবেটঃ একটি নামী রেস্তোরাঁ। থুকপা মূলত একটি তিব্বতী খাদ্য। টেস্ট অফ টিবেটের থুকপা অত্যন্ত জনপ্রিয়। এখানকার মোমোর খ্যাতিও যথেষ্ট। রেস্তোরাঁটির অবস্থান গ্যাংটকের এম জি মার্গে।
থাকালিঃ গ্যাংটকের এম জি মার্গের ওবেরয় বিল্ডিংয়ে অবস্থিত এই রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায় দুর্দান্ত পর্ক চোলিয়া। এটি প্রকৃতপক্ষে নেওয়ারি নেপালী ডিশ। সিকিম জুড়েই এই পদটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। গ্রিলড পর্ক কিউব মশলা-সহ রান্না করা হয়।
দি ড্রাগন ওকঃ গ্যাংটকের এম জি মার্গের ইয়ামা টাওয়ার্সের এই রেস্তোরাঁয় যে স্পেশাল ডিশটি পাবেন তা হল ড্রাগন চিকেন। এটি একটি চাইনিজ চিকেন রেসিপি। চিকেন ব্রেস্টের লম্বা লম্বা টুকরো দীর্ঘ সময় ধরে ম্যারিনেট করে ভাজা হয়, খেতে হয় ঝাল ঝাল সস সহযোগে।
ট্যানজারিন লাউনজ অ্যান্ড বারঃ টম ইউম স্যুপ চাখতে চাইলে এখানে আসতে হবে। লেমনগ্রাস, মাশরুম, বিশেষ প্রজাতির লঙ্কা (থাই চিলি), মিষ্টি পেঁয়াজ, ফিশ সস ইত্যাদি সহযোগে এক আহামরি স্যুপ। প্রকৃতপক্ষে থাই স্যুপ। সিকিম তথা গ্যাংটকে কদর খুব। গ্যাংটকের টিবেট রোডের চুমবি রেসিডেন্সি হোটেলে অবস্থান এই রেস্তোরাঁটির।
রোল হাউসঃ গ্যাংটকের এম জি মার্গের রোল হাউসে যেতে হবে মাশরুম মোমো খাওয়ার জন্য। এখানকার চিলি-পনির-চিজ রোলটাও দুর্দান্ত।
মু কিমচিঃ গ্যাংটকের পাহাড়ে বসে অথেনটিক কোরিয়ান কুইজিনের স্বাদ পেতে হলে বিশাল গাঁও এলাকার মু কিমচিতে একবার অন্তত ঢুঁ মারতেই হবে। এখানকার কোরিয়ান সুশি রোল (কিমবাপ) আর সি-উইড স্যুপ বিখ্যাত।
মামাস কিচেনঃ এম জি মার্গের মামাস কিচেনে যাবেন বিভিন্ন রকমের মোমো আর চাউমিনের টানে। সয়া চিলি মোমো, মাশরুম চিলি মোমো, পনির ফ্রায়েড মোমো, সয়া চাউমিন, পনির চাউমিন, ক্যাপসিকাম চাউমিন প্রভৃতি এখানকার বিশেষ পদ। টেক অ্যাওয়ে কাউন্টার। কিনে নিয়ে এসে হোটেলে বসে খান।
সম্পূর্ণতই আঞ্চলিক কয়েকটি পদ
সায়েল রোটিঃ
জলে চালের গুড়ো মিশিয়ে অনেকটা জিলিপির মতো আকার দেওয়া হয়, তারপর সেই উপকরণটিকে ভাজা হয়। খাওয়া হয় টম্যাটো কারি দিয়ে। আদপে এটি একটি নেপালী খাবার। তবে সিকিম জুড়েই এটি একটি প্রাত্যহিক খাদ্য।
ফাগশাপাঃ পর্ক ফ্যাট এই পদটির মূল উপকরণ। চর্বির স্ট্রিপ শুকনো লঙ্কা, কখনো কখনো মূলো দিয়ে রান্নাকরা হয়।
কিনেমা কারিঃ ফার্মেন্টেড বা গাঁজানো সয়াবিন, ভাজা পেঁয়াজ, টম্যাটো ও মশলা সহযোগে রান্না এই কারি সিকিম জুড়ে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
ছুরপি স্যুপঃ গরু বা ইয়াকের দুধ থেকে তৈরি চিজের সঙ্গে পেঁয়াজ, টম্যাটো, আদা, পাঁচ ফোড়ন ইত্যাদির মিশেল দিয়ে স্যুপটি বানানো হয়।
গুন্ড্রুক স্যুপঃ ফার্মেন্টেড নানা সবজি পেঁয়াজ, রসুন, টম্যাটো-সহযোগে এই স্যুপটি তৈরি করা হয়। শীতে খাওয়ার চল বেশি। কোনও কোনও রেস্তোরাঁয় পদটি পরিবেশিত হয়। খুজে বের করতে হবে। খাঁটি সিকিমিজ কোনও হোমেস্টেতে থাকলে সেখানে পদটির জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে।
মোমোঃ তিব্বতী ডাম্পলিং তথা মোমো এখন কলকাতা তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তে একটি সহজলভ্য পদ। সিকিম ও দার্জিলিংয়ে বহু তিব্বতীর বসবাস। দুই জায়গাতেই মোমো অত্যন্ত জনপ্রিয় খাদ্য। সিকিমের যে-কোনও প্রান্তে মোমোর সরবরাহ পাওয়া যাবে। মাংসের মোমো, সবজির মোমো, চিজ ও পনির মোমো, স্যুপ-সহ মোমো পাবেন রাস্তার কিয়স্কে, হোটেল-রেস্তোরাঁয়, হোমস্টেতে।
টমবাঃ টমবা বা টংবা সিকিমে প্রচলিত একটি আ্যলকোহলিক পানীয়। পূর্ব নেপালের লিম্বু জনগোষ্ঠীর মধ্যে পানীয়টি ব্যবহার বহুকাল ধরেই। এখন সিকিমেও বেশ জনপ্রিয়। লিম্বু সম্প্রদায়ের কাছে পানীয়টি পবিত্রও বটে। অনেক সময়েই বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নের জন্য টমবা পরিবেশন করা হয়। সিকিমে লিম্বু জনগোষ্ঠীর প্রচুর মানুষের বসবাস। তাঁদের পাশাপাশি তিব্বতী ও লেপচা জনগোষ্ঠীর মানুষজনের মধ্যেও টমবা পান যথেষ্ট প্রচলিত।