Follow us
Search
Close this search box.

তাড়োবা-আন্ধেরির বাঘবনে

তাড়োবা-আন্ধেরির বাঘবনে

২৬ ডিসেম্বর (২০২৩)। কলকাতা বন্দর থেকে রাত ৮টা পাঁচের বিমান নাগপুরের উদ্দেশে রওনা দিল সওয়া ৯টায়। নাগপুর বিমানবন্দরে পৌঁছালাম রাত ১১টা নাগাদ। বুকিং ছিল হোটেল লেজেন্ড ইনে। বিমানবন্দর থেকে হোটেলে পৌঁছাতে সময় লাগল মিনিট পাঁচেক মাত্র। গন্তব্য তাড়োবার অরণ্য। মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর জেলার কুয়াশামাখা তাড়োবার জঙ্গল। আর বণ্যপ্রাণীর দর্শন পেলে সে তো উপরি পাওনা। ইতিউতি নাকি তিনটি ব্যাঘ্রশাবক দেখা যাচ্ছে। সে খবর ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে। যাক গে, সেরইকম দৃশ্য মুখোমুখি হতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার বলেই মেনে নিয়েছি।

পরের দিন ব্রেকফাস্টের পর তাড়োবা জাতীয় উদ্যানের প্রবেশদ্বার মোহরলির উদ্দেশে আমাদের যাত্রা শুরু হল বেলা ১০টা নাগাদ। নাগপুর থেকে দূরত্ব ১৩২ কিলোমিটার। দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ মোহরলি পৌঁছানো গেল। ওখানে ওয়াঘাই রিসর্ট অ্যান্ড হোমস্টেতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। মোহরলি গেট থেকে রিসর্ট-কাম-হোমস্টের দূরত্ব ৬০০ মিটার মাত্র। কাছেই তাড়োবার অরণ্যের আরেক প্রবেশদ্বার জুনোনা। দুটি গেট থেকেই সাফারি আয়োজিত হয়। সেদিক থেকে ওয়াঘাই রিসর্ট অ্যান্ড হোমস্টের অবস্থানটি বেশ সুবিধাজনক।

মহারাষ্ট্রের সবচেয়ে পুরনো ও বৃহত্তম জাতীয় উদ্যান তাড়োবা। চন্দ্রপুর জেলার তাড়োবার এই অরণ্য জাতীয় উদ্যান ঘোষিত হয় ১৯৫৫ সালে। পরে, ১৯৯৫ সালে তাড়োবার অরণ্যের সঙ্গে যুক্ত হয় আন্ধেরি বণ্যপ্রাণ অভয়ারণ্য। সমস্তটা মিলে তাড়োবা-আন্ধেরি টাইগার রিজার্ভ। আঞ্চলিক উপজাতি মানুষজনের দেবতা ‘তারু’ থেকে অরণ্যের নাম তাড়োবা।

বিকেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মোহরলি গ্রামের ইরাই লেকে চলে গেলাম। অনেক পাখি দেখা যাচ্ছিল। লেকে চমৎকার সূর্যাস্ত দেখা গেল।

পরের দিন, ২৮ ডিসেম্বর, সকাল-বিকেল এবং তার পরের দিনও দু’বেলা, অর্থাৎ মোট চারটি সাফারির ব্যবস্থা রয়েছে আমাদের। এবারের বেড়ানোর সূচিতে অন্য কোনও জায়গা নেই। শুধু তাড়োবা। জঙ্গলটাই ভালো করে ঘুরে দেখার ইচ্ছা নিয়ে আসা।

সকাল সাড়ে ৬টা থেকে বেলা সাড়ে ১০টা পর্যন্ত প্রথম সাফারি। দিনের দ্বিতীয় দফার সাফারি শুরু হয় বেলা ২টো থেকে, চলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টা পর্যন্ত। অনলাইনে সাফারি বুক করেছিলাম। ২৮ ডিসেম্বর ঠিক ৬টায় রিসর্টে সাফারির গাড়ি এল। প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। ৬ জন যাত্রীর সঙ্গে ১ জন গাইড আর গাড়ির চালক। গাড়ি এল জুনোনা গেটে। এখান থেকে সাফারি শুরু হল সকাল ঠিক সাড়ে ৬টায়। বাফার জোনে ভ্রমণ চলল।

কিছু হরিণ চোখে পড়ল। পাখি বেশকিছু। নির্দিষ্ট একটি জায়গায় গাড়ি থেকে নামা গিয়েছিল। ওয়াশ রুম আছে ওখানে। চা খাওয়া গেল। বেলা সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সাফারি চলল। জঙ্গুলে গন্ধ। জঙ্গল-অভ্যন্তরের হাতছানি। দূরে আবছা রহস্য। বেশ লাগল।

সকালের সাফারি সেরে রির্সর্টে ফিরে এসেছিলাম। ব্রেকফাস্টের পর খানিক পদচারণা। আবহসঙ্গীতের মতো পাখির ডাক। নিষ্কলুষ প্রকৃতি। প্রচুর অক্সিজেন। শরীর চনমনে হয়ে উঠল।

দুপুরের স্নানাহার সারার পর পৌনে ২টো নাগাদ দ্বিতীয় দফার সাফারির গাড়ি উপস্থিত। এবার আমরা জঙ্গলের কোর এলাকায় ঢুকব মোহরলি গেট দিয়ে।

জঙ্গল ঘন হতে থাকল। একটা প্যাঁচা দেখা গেল প্রথমে। একটা ভাল্লুক রাস্তা পেরল রাজকীয় মেজাজে। ময়ুর দেখলাম। একটা বাইসন আমাদের গাড়ি দেখে থমকে দাঁড়াল। পৌঁছালাম একটা লেকের ধারে। লেকে একটা কুমির চোখে পড়ল। এদিনও বাইসন দেখা গিয়েছিল। বাঁদর, হনুমানেরা ছিল সঙ্গে।

জঙ্গলের নিজস্ব বাঙ্ময় নৈঃশব্দ আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে ততক্ষণে। ‘ঘোস্ট ট্রি’ দেখা গেল। মরসুম থেকে মরসুমে রং বদল করে এ গাছ। এখন গুঁড়ি, কাণ্ডের রং অনেকটা ধূসর-সাদাটে, পাতা বাদামি। গাছটির বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘স্ট্রেকুলিয়া ইউরেন্স’। আঞ্চলিক আদিবাসীরা এই গাছের বীজ ভেজে খান অনেকদিন ধরেই। বীজের তেল এখন সাবান তৈরির কাজে লাগছে। অনেক অর্জুন গাছ চোখে পড়েছে। এক ঝাড়ে বাঁশের ফুল দেখা দিয়েছিল। সন্ধ্যায় রিসর্টে ফিরে এলাম।

তার পরের দিন, মানে ২৯ ডিসেম্বর দু’বেলাই কোর জঙ্গলে সাফারি। এ দিনটা আরেকটু অন্যরকম। এ দিন একটা লেপার্ড দর্শন দিয়ে আমাদের জঙ্গল সফর শুরু হয়েছেল। তারপর সেই দৃশ্য, ৬০-৭০ মিটার দূরে জঙ্গল প্রান্তে অকস্মাৎ তিন তিনটে বাঘের বাচ্চা। বায়নাকুলার দিয়ে ভালোই দেখলাম। জঙ্গল চেনার খেলায় মত্ত মনে হয়। নিশব্দ পরিবেশ। একটি জীবন্ত স্বর্গীয় ছবি যেন। কাছাকাছি মা বাঘটি থাকতেও পারে বা, এমন একটা পরিবেশ। টেলিলেন্স ছাড়া ভালো ফটো হবে না বুঝে আর সে চেষ্টায় যাইনি। তবে বাচ্চাগুলোকে দেখেছি খানিকক্ষণ ধরে।

এ জঙ্গলের ৮০ শতাংশই কোর অঞ্চল। গভীর জঙ্গল। সেখান সাফারি হয় না। ২০ শতাংশ এলাকায় সাফারি আয়োজিত হয়। তাড়োবা-আন্ধেরি টাইগার রিজার্ভে কমবেশি ১১৫টি বাঘ আছে। কোর জঙ্গল-সংলগ্ন বাফার এলাকায় ১০-১২টি বাঘের চলাফেরা আছে বলে জানা গেল। বেলা গড়াতে জঙ্গল নিঝুম হয়ে এল। প্যাঁচাটা উড়বে হয়তো এখন।

রিসর্টে ফিরলাম। মহারেষ্ট্রের মানুষ সব, কিন্তু কী সুন্দর বাঙালিদের ভালোলাগা সব পদ রান্না করেছে। মাছের ঝোল, আঞ্চলিক মুরগি, তা-ও নয় ঠিক আছে গহন, বনের প্রান্তে বসে আলুপোস্ত? হ্যাঁ, এমনটাই। কয়েকজন বাঙালি ভ্রমণার্থী জন্য এমন ব্যবস্থা। এখানকার পর্যটন-পরিষেবায় আন্তরিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সুচারু পেশাদারিত্ব। এটা লক্ষ্যণীয়।

পরের দিন, ৩০ ডিসেম্বর, ওই রিসর্ট থেকে একেবারে লাঞ্চ সেরে নাগপুরে ফিরে এসেছিলাম। রাতের জন্য উঠলাম ওই হোটেল লেজেন্ড ইনেই।সকাল ৭.২০-তে নাগপুর থেকে বর্ষশেষের কলকাতাগামী বিমান উড়ল।

অনলাইনে সাফারি বুক করা যাবে এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমেঃ https://www.mytadoba.org

ফটোঃ লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *