দক্ষিণ সিকিমের রিনচেনপং যেন ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকে সর্বদা। হট্টগোল, ভিড়ভাট্টা নেই। আছে বাঙ্ময় নৈঃশব্দ। দূরে জাগরুক হয়ে থাকে কাঞ্চনজঙ্ঘা। শায়িত বুদ্ধের অবয়বটি কী স্পষ্ট। লিখছেন রঞ্জন ভদ্র।
শিলিগুড়ি থেকে জোরথাং ৮৩ কিলোমিটার। এখান থেকে গাড়ি বদল করে যাব পশ্চিম সিকিমের কালুক। সেখান থেকে ৫,৫০০ ফুট উচ্চতার রিনচেনপংয়ে। কালুক থেকে রিনচেনপং ৩ কিলোমিটার। জোরথাং থেকে রিনচেনপং ৩৭ কিলোমিটার। এন জে পি স্টেশন চত্বর থেকে রিনচেনপং ১২৫ কিলোমিটার। পেলিং থেকে ৪০ কিলোমিটার। শিলিগুড়ি থেকে যাত্রা শুরু করে ঘন্টা তিনেক পরে পৌঁছানো গেল জোরথাং। রঙ্গিত নদীর তীর বরাবর দক্ষিণ সিকিমের এই জোরথাং এক বর্ধিষ্ণু শহর।
মকর সংক্রান্তির সময় জোরথাংয়ে বড় উৎসব হয়। মেলা বসে। প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। যাইহোক, জোরথাংয়ে পৌঁছে দেখা গেল বাইরে কাজে যাওয়া আঞ্চলিক মানুষজন ভাইটিকা উৎসব উপলক্ষ্যে বাড়ি ফিরছেন। গাড়ির আকাল। তিনতলা বাসস্ট্যান্ড। যাত্রীপূর্ণ একেকটা গাড়ি হুস হুস করে নেমে আসছে। চেষ্টাচরিত্র করে একটা মারুতি ওমনিতে ঠাঁই হল।
বিষ্ময়কর কাঞ্চনজঙ্ঘা
গাড়ি চলছে। কোনও কোনও বাঁক থেকে দেখা মিলছে তার। রুপোর মতো জ্বলছে। কালুকে পৌঁছালাম। আমাদের সামনে এক তরুণ এসে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করল। গাড়ি তো লাগবেই। রিনচেনপংয়ের পথ ধরল সেই গাড়ি। একটু এগতেই বিকেলের কাঞ্চনজঙ্ঘা ও তার পারিষদবর্গের সুদীর্ঘ রেঞ্জ বিস্ময়াবিষ্ট করে দিল। হোটেলের সামনে গাড়ি দাঁড়াল। পরের দিন একটু এদিক ওদিক বেড়ানোর কথা হয়ে গেল ছেলেটির সঙ্গে। নাম জিজ্ঞেস করতেই এতক্ষণের হাসিখুশি ছেলেটির মুখটা কেমন কঠিন হয়ে উঠল। বিমল গুরুং, সংক্ষিপ্ত উত্তর। আমাদের বহুশ্রুত বিমল গুরুং তখন দার্জিলিংয়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা। পরে শুনেছিলাম, নেতা বিমল গুরুংয়ের নামের সঙ্গে তুলনা করে কালুকের এই তরুণটিকে খেপানো হয়। তাই নাম বলাতে তার অস্বস্তির শেষ নেই।
বৌদ্ধ প্রার্থনা মন্ত্র ঘন্টিপোকা কালোমাণিক
সারাদিন পরে গরম জলে ভালো স্নান হল। চা-টা খেয়ে চারিদিকটায় নজর দেওয়ার আবকাশ পাওয়া গেল। লাভ হল না বিশেষ। এমনিতেই পাহাড়ি অঞ্চলে আঁধার নামে তাড়াতাড়ি। সন্ধ্যা হয়েছে। আকাশে একফালি চাঁদ। চারপাশটায় প্রচুর গাছগাছালি, বোঝা যাচ্ছে। দূরের পুঞ্জাকৃতির আলোক বিন্দুগুলো পেলিং পাহাড়ের আলো বলে জানা গেল। উল্টোদিকে আরেকটা হোটেলে অতিথিরা এসে পৌঁছলেন। রাস্তায় নেমে এলাম। ঝিঁঝিঁর কলতান নৈঃশব্দকে আরও গাঢ় করেছে। আর দূরে আধো জোছনায় জলছবির মতো হিমালয়। বেশ ঠাণ্ডা। পরিবেশের গুণেই মনে হয়, ক্লান্তি উধাও।
হোটেলের রেস্তোরাঁয় নৈশাহার সেরে একটু আগেভাগেই শয্যা নেওয়া গেল। ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে, মোরগের ডাকে। পরে দেখেছি, রিনচেনপংয়ের প্রায় প্রতি বাড়িতেই মুরগি পালন করা হয় ছোট আকারে। বিস্তৃত খেত বলে তো কিছু নেই এরকম পার্বত্য এলাকায়। পাহাড়ের ধাপে চাষবাস। বাড়িতে মুরগিপালন অর্থনৈতিক কারণেই। অতিথিদের ফরমায়েস অনুসারে হোটেল থেকে মোরগ কেনা হয়। ডিম বাড়ির সদস্যদের প্রাণীজ প্রোটিনের যোগান দেয়। অন্ধকার কাটেনি তখনো। একটা সমবেত প্রার্থনার সুর কানে এল। জালনায় এসে দাঁড়ালাম। একদল বৌদ্ধ সন্ন্যাসী শ্রুতিমধুর প্রার্থনা মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে চলেছেন। রাত শেষে রিনচেনপংয়ের প্রথম দৃশ্য।
অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। আলো ফুটছে। কাঞ্চনজঙ্ঘায় রঙের ছোপ লাগলো। একটা শান্ত, সুন্দর সকাল। এই শান্ত পরিবেশটাই রিনচেনপংয়ের বৈশিষ্ট্য। শোনা যায় নানা পাখির ডাক। বিভিন্ন পাখির দেখা মিলবে এখানে। আর কাঞ্চনজঙ্ঘা জাগরুক হয়ে থাকে সারাদিন। কাঞ্চনজঙ্ঘার দীর্ঘ রেঞ্জ দেখা যায় রিনচেনপং থেকে। কাঞ্চনজঙ্ঘা, পাণ্ডিম, সিম্ভো, জাপুনো, কাব্রু, রাটোং, জানো পর্বতের শৃঙ্গগুলির সমাহারে শায়িত বুদ্ধের দীর্ঘ অবয়ব খুব ভালো দেখা যায় রিনচেনপং থেকে।
বেলা দশটা নাগাদ বিমল চলে এল তার বাহন নিয়ে। সাইটসিয়িং ঠিক বলব না। একটু ঘুরেফিরে দেখা আর কী জায়গাটা। এখানে একটা কথা বলে রাখি, রিনচেনপংয়ে শপিং ইত্যাদির কোনও সুযোগ নেই। হৈ চৈ যাঁদের খুব পছন্দ, রিনচেনপং তাঁদের জন্য নয়। কাছাকাছি আধা শহর কালুক। এখানে কিছু দোকানপাট, রেস্তোরাঁ রয়েছে। হোটেল আছে কয়েকটি।
বিমল প্রথমে আমাদের নিয়ে গেল জঙ্গলে ঘেরা একটি জলাশয়ের কাছে। পয়জন পোখরি নামে পরিচিত। গ্রীষ্মে, শীতে পোখরিতে জল থাকে না। দৃশ্যত জায়গাটা যে খুব আকর্ষণীয় এমন নয়। তবে ঐতিহাসিক দিক থেকে পয়জন পোখরির যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। সিকিমের চোগিয়াল রাজার সঙ্গে ব্রিটিশ বাহিনীর যুদ্ধ হয়েছিল এই অঞ্চলে। চোগিয়াল বাহিনীকে সমর্থন করে উপজাতীয় লেপচারা অঞ্চলে পানীয় জলের একমাত্র উৎস এই পোখরিতে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। বিষাক্ত জল পান করে ব্রিটিশ বাহিনীর বেশিরভাগ সেনার মৃত্যু হয়। ইংরেজ বাহিনী পিছু হটে। গাছগাছড়া থেকে বিষ তৈরি করা হয়েছিল। আঞ্চলিক মানুষজনের মতে, জায়গাটি ভুতুড়ে। রাতবিরেতে এখানে কেউ আসে না।
রিনচেনপং বেড়াতে গেলে এখানকার মূল মনাস্ট্রির (রিনচেনপং মনাস্ট্রি) আঙিনায় গিয়ে দাঁড়াতেই হবে। ৫৫০০ ফুট উচ্চতায় রিনচেনপং মনাস্ট্রি চত্বর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য এককথায় অসাধারণ। এটি সিকিমের তৃতীয় প্রাচীনতম মনাস্ট্রি। গুম্পার মধ্যে রয়েছে অতিবুদ্ধ বা আদি বুদ্ধের বিরল মূর্তি। মূর্তির গাত্রবর্ণ নীল। ধ্যানে উপবিষ্ট বুদ্ধকে আলিঙ্গন করে রয়েছেন এক নারী। বৌদ্ধ-তন্ত্রের নিদর্শন। রিনচেনপং এলাকায় রয়েছে আরেকটি মনাস্ট্রি। এটি গুরুং মনাস্ট্রি বা রিশুম মনাস্ট্রি নামে পরিচিত।
রিনচেনপং থেকে বেড়িয়ে আসা যায় ছায়াতাল (১৮ কিলোমিটার), হি ওয়াটার গার্ডেন (১৩ কিলোমিটার)। বার্সে রডডেনড্রন স্যাংচুয়ারি (৩০ কিলোমিটার)। মার্চ-এপ্রিল মাসে রডডেনড্রন ফুলে ছেয়ে যায় গোটা বার্সে অঞ্চলটি। সিংসোর ব্রিজ রিনচেনপং থেকে ২৭ কিলোমিটার। সিংসোর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে উত্তরে গ্রাম। উত্তরে এখন সিকিমের জনপ্রিয় পর্যটন ঠিকানা। চাইলে ভ্রমণসূচিতে রিনচেনপংয়ের সঙ্গে উত্তরেকে যুক্ত করে নেওয়া যায়। অর্থাৎ উত্তরেতেও থাকার ব্যবস্থা করা যায়। উত্তরে, রিনচেনপং-কালুক, ছায়াতাল ও পেলিংকে অন্তভুর্ক্ত করে সপ্তাহখানেক সময় নিয়ে পশ্চিম সিকিম ভ্রমণের একটা সুন্দর পরিকল্পনা করা যায়।
বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম কালুক। এই কালুক থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা-সহ পূর্ব হিমালয়ের দীর্ঘ রেঞ্জ দেখা যায়। তখন সন্ধ্যা। আগেই বলেছি, কিছু দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ আছে কালুকে। মূল চত্বরটা আলোকিত হয়ে আছে। একটা দশাসই চেহারার কালো পাহাড়ি কুকুর পিছু নিল। একটা বিস্কুটের প্যাকেট কিনে খেতে দিলাম ওকে। আঞ্চলিক এক মহিলা দাঁড়িয়েছিলেন সামনে। বললেন, দোস্তি হো গিয়া, সারে কালুক, রিনচেনপং ঘুমা দেগা আপকো। কথাটা অমূলক নয়। রিনচেনপং ছাড়া পর্যন্ত কুকুরটি আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই ছিল, যতক্ষণ আমরা পায়ে হেঁটেছি।
দুর্দান্ত ভেজ মোমো আর চা খেয়ে, কিছুটা সময় কালুকে কাটিয়ে আমরা রিনচেনপংয়ের পথ ধরলাম। রাস্তায় টিমটিমে আলো। ডাইনে গাছপালার ঘন জটলা। সেখানে চাপ চাপ অন্ধকার। আকাশে আধেক চাঁদ। দূরে সেই জলছবির মতো কাঞ্চনজঙ্ঘা। শব্দ বলতে শুধু ঝিঁঝিঁর কলতান আর ঘন্টিপোকা সৃষ্ট ঘন্টাধ্বনি। ঠিক যেন ঘন্টা বাজছে, এমনই আওয়াজ করে বড়সড় দেখতে পোকাগুলো।
সকালে ঝকঝক করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। পাখি উড়ছে। গাছে গাছে ফুল। গাড়ি চলে এসেছে। কালোমানিক এসে দাঁড়িয়েছে। এই নাম দিয়েছি ওর। বুঝেছে আমরা চলে যাচ্ছি। গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। হোটেলের এক কর্মী জানালো, আপনারা চলে গেলেই ও কালুক ফিরে যাবে। সারমেয়টির কোনও হাঁকডাক নেই। গাড়ির দিকে তাকিয়ে বসে রইল।
আমরা পেলিংয়ের পথ ধরলাম। ডেন্টাম রোড ধরে গাড়ি চলেছে। পথের বাঁকে বাঁকে ঝিলিক দিয়ে উঠতে থাকল কাঞ্চনজঙ্ঘা।
রিনচেনপঙের কয়েকটি হোটেল
হোটেল ল্যান্ডস্কেপঃ ফোন- ৭৫৯৫৯-৭৯৫৪৭। হোটেল রিনচেনপং নেস্টঃ ফোন-৭৪৩২০-২১৫০৯। হোটেল রিনচেনঃ ফোন-৭৪৩২০-২১৫০৯। ডেনজং রেসিডেন্সিঃ ফোন- ৯০৫১৫-৪৩৬৫২। ইয়াং-সে রিট্রিটঃ ফোন-৯০০৭৬-০৬৬৩৫। ম্যান্ডারিন ভিলেজ রিসর্ট(কালুক), ফোন-৯৭৩৩০-৯২২৩০, ৮৬৭০৩-৭১৮২৬। গ্রিন হিল রিসর্ট (কালুক), ফোন-৭০৪৪৬৬২৭৭৭।