Follow us
Search
Close this search box.

দার্জিলিংয়ের চিড়িয়াখানায় খানিকটা সময়, এই গ্রীষ্মে

দার্জিলিংয়ের চিড়িয়াখানায় খানিকটা সময়, এই গ্রীষ্মে

কাজের সূত্রে হঠাৎই ঝটিকা সফরে গিয়েছিলাম দার্জিলিংয়ে। মে মাসের মাঝামাঝি। কলকাতা তাপে পুড়ছে। ওদিকে মেঘ উড়ছে পাহাড়ে, চা-বাগানে, কখনো কখনো সেই মেঘ নেমে আসছে রাস্তায়। ও বাবা, দার্জিলিং শহর, মানে চৌরাস্তা, চক বাজার, গান্ধি রোড, ঘুম, সব মানুষে মানুষে ছয়লাপ। প্রচুর ভ্রমণার্থীর জমায়েত দিকে দিকে। মালুম হয়েছিল ট্রেনের টিকিটের খোঁজ করতে গিয়ে। ওয়েটিং লিস্টগুলো হনুমানের লেজের মতো লম্বা। আমি তো কলকাতা থেকে একটি বেসরকারি পরিবহণ সংস্থার বাসে শিলিগুড়ি এলাম। ফেরার ট্রেনে আমার আসনটি এন জে পি থেকে যাত্রার আগের দিন কনফার্মড হয়েছিল। এ বছর উত্তরবঙ্গগামী বন্দে ভারতের ক্রেজ খুব। এ যেন পুজোর সময়কার দার্জিলিং। জানা গেল সিকিমের গ্যাংটকও এই গ্রীষ্মে জমজমাট।

যাক গে, কাজের কথায় আসা যাক। ঠিক করলাম, কাজটাজ আজ সন্ধ্যার মধ্যে যতটা সম্ভব মিটিয়ে ফেলতে হবে। দুটো রাত্রি থাকা। ওভাবে বেড়ানো তো হবে না। তবে চিড়িয়াখানাটায় একবার যাবই যাব। মলের পূর্ব দিকের ঘোড়ার আস্তাবলের পাশ দিয়ে পাড়ার মধ্যে ঢুকে পড়া রাস্তাটা ধরে একটুখানি হেঁটে একটি পারিবারিক লজে আমার ঠাঁই হয়েছে। দার্জিলিংয়ে যখন, তখন চৌরাস্তা বা দার্জিলিংয়ের মল চত্বর আর কতদূর। মহাকাল মন্দিরের দিকটা মেঘ-কুয়াশায় ঢাকা। ঠান্ডা বাতাস বইছে মাঝে মাঝে। জানা গেল, সকালের দিকে এক পশলা ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়েছে। তাতে কী, মল চত্বর জমজমাট। বাঙালি ভ্রমণার্থীর সংখ্যাধিক্য। একটা উৎসবের পরিমণ্ডল। এক কালে গরমের সময়টায় অরিজিনাল সাহেবরা এই পাহাড়ে কাটিয়ে যেতেন। বাঙালি আর দার্জিলিংয়ের সম্পর্ক তো নতুন নয়। দার্জিলিংয়ের পাহাড়ে পাহাড়ে তারা তাদের উপস্থিতির জানান দেবে, এতে আশ্চর্যেরই বা কী।

শিবের গীত আটকানোর চেষ্টা করছি, পুরোটা হয়ে উঠছে না। সরাসরি পয়েন্টে আসা যাক। পরের দিন সকাল সকাল মল থেকে পশ্চিমের রাস্তাটি ধরে হলুদরঙা সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চটিকে ডাইনে রেখে হাঁটা লাগালাম। সোজা আরও খানিকটা। দার্জিলিংয়ের চিড়িয়াখানা (পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক, পাশেই হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট)।

যত যাই তত মানুষের সংখ্যা বাড়ে। চিড়িয়াখানায় ঢোকার মেন গেটের বাইরে টিকিট কাটার জটলা। পরিবার এসেছে, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা এসেছেন। ভাল কথা এই যে, প্রচুর বাচ্চাকাচ্চাও এসেছে। নিজে চলা বাচ্চা, বাপ-মায়ের হাত ধরা বাচ্চা, কোলেকাঁখের বাচ্চারা, বাবা, কাকা, মামার কাঁধে চড়া বাচ্চা।

গোল বেঁধেছে অন্য জায়গায়। সমবেত জনতার কথাবার্তা, হাসি-মসকরা, হাঁকডাকে এলাকা গরম হয়ে উঠেছে। চিড়িয়াখানার কর্মীরা সাইলেন্স লেখা প্ল্যাকার্ড দেখিয়ে জনতাকে চেঁচামেচি করতে নিষেধ করছেন। তাতে যে খুব কাজ হচ্ছে এমনটা মনে হল না। বিরক্ত হয়েই হোক বা প্রয়োজনে, নিরাপত্তা কর্মীদের কেউ কেউ তীক্ষ্ণ স্বরের নিষেধাজ্ঞামূলক বাঁশি বাজাচ্ছেন মাঝেমধ্যে। বন্য প্রাণীরা কোনও শব্দ মানুষের চেয়ে পাঁচগুন বেশি জোরে শোনে, একথা লেখা আছে চিড়িয়াখানার বোর্ডে।

গাছগাছালি-সহ রেড পান্ডার খাঁচাটা আমার একটা আকর্ষণের জায়গা। দুটির দেখা পেলাম। একটি গাছের ডাল বেয়ে নেমে এল, জীবন্ত সফট টয়ের মতো দেখতে লাগে আমার। আদর করতে ইচ্ছে করে। চিড়িয়াখানার গাছের মাথায় মাথায় মেঘ জমেছে। তার নীচে গুটিসুটি শুয়ে আছে দুটি মেঘলা রংয়ের লেপার্ড। এই স্নো লেপার্ড বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। হিমালয়ের উচ্চতর অংশে এদের বিচরণ। একটি ব্ল্যাক প্যান্থারকে দেখলাম, শুধু লেজটা বাইরে, শরীরটা মনুষ্যসৃষ্ট গুহার মধ্যে। এরাও বিপন্ন। তিব্বতী নেকড়ে দেখলাম দুটো। সকলেই একটু নিরালা বেছে নিয়ে বিশ্রামরত।

কখন চলে এসেছি ভাল্লুকের অর্ধচন্দ্রাকার এরিনার কাছে। হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ার এটি। তাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ছবি তোলার ভিড় জমেছে সেখানে। ভাল্লুককে সঙ্গে নিয়ে সেলফি উঠছে পটাপট। তবে যিনি ছবি তুলছেন তাঁর হাসিহাসি মুখটি দেখতে ভালো লাগে। একটা খুশির ছোঁয়া।

যতোই হোক, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বলে কথা। দূর থেকে দেখলাম এক জায়গায় বেশ কিছু মানুষের জটলা। কাছে গিয়ে দেখা গেল দশাসই চেহারার প্যান্থেরা টাইগ্রিস মানে আমাদের বড় আপন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার এক নাগাড়ে খাঁচার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত হেঁটে চলেছে। নবীন বাঘ। আমার মাথার ওপর কারুর মোবাইল ফোন আঁটা স্টিক। কত কথা হচ্ছে জায়গাটায়। কেউ দূরের কাউকে জোরে জোরে ডাকছে, নানা মন্তব্য। একটা লম্বা রোগা মতো লোক, কাঁধে পুত্র সন্তানই হবে, বাঘের পায়চারি দেখতে দেখতে প্রায় স্বগোক্তির মতো একটা আওয়াজ করলেন, যার মানে দাঁড়ায়, ‘হালুম’।

চিড়িয়াখানায় খাঁচাবন্দি বন্যপ্রাণীর ফটো প্রায় তুলিনি। একটা রেড পান্ডা, মনে হল আমার দিকেই যেন চেয়ে আছে, তার একটা ছবি তুললাম। বাঘটা ক্রমাগত হেঁটে চলেছে, রেস্টলেস, একটা বিরক্তি আছে। বিদ্রোহও নেই কি? প্রচুর ছবি উঠছে সে বাঘের। ভালো লোক টানছে। খাঁচার সামনের ভিড়টা কি একটু নিয়ন্ত্রণ করা যায় না?

প্রসঙ্গত, দার্জিলিংয়ের বার্চ হিল তথা জওহর পর্বতের ৭০০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের কোলে ৬৭ একর এলাকা জোড়া দার্জিলিংয়ের এই চিড়িয়াখানা দেশজুড়ে মোট ১৫০টি চিড়িয়াখানার মধ্যে নানা মাপকাঠির বিচারে শ্রেষ্ঠ চিড়িয়াখানার শিরোপাটি অধিকার করেছে ২০২২-এ। রেড পান্ডা, তুষার চিতা, টিবেটান উলফ, ক্লাউডেড লেপার্ড ছাড়াও ইয়াক, হিমালয়ান থর, হিমালয়ের ভাল্লুক, গোরাল, কাকর হরিণ (বার্কিং ডিয়ার), কস্তুরী হরিণ-সহ আরও নানা পাহাড়ি প্রাণী দার্জিলিং চিড়িয়াখানার বাসিন্দা। বার্লিনের চিড়িয়াখানা থেকে এসেছে কয়েকটি মিসমি টাকিন।

এদিন অনেকেরই দেখা পেলাম না। কেমন যেন সিঁটিয়ে আছে সকলে। ভিড়ের জন্য? মেঘলা আবহাওয়ার প্রভাবও থাকতে পারে।

বন্যপ্রাণীরা কটূ গন্ধ পছন্দ করে না। ইতিউতি কয়েকজনকে সিগারেট খেতে দেখলাম। চিড়িয়াখানার ওয়েবসাইট (http://www.pnhzp.gov.in/) দেখলাম, সেখানে ‘ডু অ্যান্ড ডোন্ট’ বিভাগ চিড়িখানার মধ্যে ধূমপান নিষেধের নির্দেশ পেলাম না।

বেরোচ্ছি চিড়িয়াখানা থেকে বেলা আড়াইটে নাগাদ, দেখলাম লোক যেমন বেরোচ্ছে, তেমন ঢুকছেও গলগল করে। এঁরা মনে হয় লাঞ্চ সেরে ঢুকছেন। আবহাওয়া একই রকমের।উঁচু উঁচু বৃক্ষসকলের মধ্য দিয়ে মেঘ উড়ছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা দূর অস্ত। তবে মেঘ-কুয়াশায় মোড়া, ভিজে ভিজে এই দার্জিলিংয়েরও একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে সে কথা তো মানতেই হবে। ওই একনাগাড়ে খাঁচার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত হেঁটে চলা বাঘটার ছবি বারবার ভেসে উঠছিল মনের মধ্যে।

 

1 Comment

  1. […] দেবযানী সরকারের ‘দার্জিলিংয়ের চিড়িয়াখানায় খানিকটা সময়, এই গ্রীষ্মে’ শীর্ষক লেখাটি পড়তে পারেন এই লিঙ্কেঃ https://torsa.in/some-time-at-darjeeling-zoo-this-summer/ […]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *