ভোর ৪টে নাগাদ দরজায় টোকা পড়ল। বাইরে ঘোর অন্ধকার। শব্দ বলতে গঙ্গার কলধ্বনি শুধু। ছেলেটির পিছন পিছন ‘তেরা মঞ্জিল’ মন্দিরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। বাইরে বেশ ঠান্ডা। অক্টোবর মাস। লক্ষ্মণ ঝুলা হেঁটে পেরিয়ে চলে এলাম গঙ্গার পশ্চিম তীরে। ওখানে গাড়ি রাখা ছিল। সঙ্গী ছেলেটি গাড়ির চালক। ও আমাকে নীলকণ্ঠ পাহাড়ে নিয়ে যাবে। পাহাড়ের উপর নীলকণ্ঠ মহাদেবের প্রাচীন মন্দিরের অবস্থান।
গাড়ি চলতে শুরু করল পাহাড়ের প্যাঁচানো পথে। আঁধার তখনো কাটেনি। দূর থেকে ঋষিকেশের মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সে শব্দ ক্রমশ অন্তুর্হিত হল। একদিকে গঙ্গার প্রবাহ, আরেকদিকে জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়। ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটার জন্য গাড়ির জানলা খোলা যাচ্ছে না। খুললে জঙ্গুলে আঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। হেডলাইট জ্বালিয়ে দু-একটা গাড়ি চলে যাচ্ছে উল্টোপথে। লোকজন দেখা যাচ্ছে না।
দু-রাত ঋষিকেশে কাটানো হয়েছে। থাকার ব্যবস্থা হয়েছে ত্রয়ম্বেকশ্বর তথা ‘তেরা মঞ্জিল’ মন্দিরের প্রথম তলের একটি ঘরে। তের তলার মন্দির বলে জনপ্রিয় নাম ‘তেরা মঞ্জিল’ মন্দির। ঋষিকেশের ছবিতে ত্রিকোন আকৃতির বৃহদায়তন এই মন্দিরটি চোখে পড়বে। আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছে বড় আকারের একটি ঘর। আরামদায়ক খাট-বিছানা, সোফা ইত্যাদি দিয়ে সাজানো ঘর। বিরাট বিরাট কাঁচের জানলা। সে জানলা দিয়ে গঙ্গার প্রবাহ দেখা যায় সর্বদা। পাশেই লক্ষ্মণ ঝুলা। বেলা একটু বাড়লেই লক্ষ্মণ ঝুলা লোকে লোকারণ্য। ঘর থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়ে একটা ছোট দরজা টপকে নুড়ি পাথর বড় আকৃতির পাথর পেরিয়ে চলে আসা যায় গঙ্গার কিনারে। অতি শীতল জল। ডুব দিয়ে স্নান করে উঠলে কী আরাম।
এ দু-দিনে ঋষিকেশের রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছি প্রচুর। প্রচুর বিদেশীর আড্ডা ঋষিকেশে। এক তো শান্ত পরিবেশ। দুই, প্রচুর যোগা কেন্দ্র রয়েছে ঋষিকেশে। সাহেবরা যোগা শিখতে আসেন এখানে। যোগা টিচার্স ট্রেনিংয়ের কোর্স করা যায়। দেশীয় পর্যটকরা বিশেষ রাত কাটান না এখানে। ট্রেকিং, রাফটিং করেন যাঁরা, তাঁরা থাকেন। সকাল থেকে দলে দলে লোক ঢোকে ঋষিকেশে। হরিদ্বার থেকে দিনে দিনে ঋষিকেশে বেড়াতে আসেন প্রচুর পর্যটক। রাম ঝুলা, লক্ষ্মণ ঝুলা, মন্দির, আশ্রম ইত্যাদি বেড়িয়ে সন্ধ্যায় হরিদ্বার বা অন্যত্র ফেরেন। হরিদ্বার থেকে ঋষিকেশ ২৫ কিলোমিটার।
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে ফের শান্ত ঋষিকেশ। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় সন্ধ্যা পেরতেই। বিদেশি পর্যটক চোখে পড়ে। বিদেশিদের পছন্দসই পোশাক বিক্রি হয় ফুটপাথের দোকানগুলোতে। সন্ধ্যার পর থেকেই ঋষিকেশ চলে যায় নিরালায়। তখন উপত্যকার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা নদীর ধ্বনি শোনা যায় স্পষ্ট। কোথাও কোথাও কাফেতে প্রধাণত বিদেশি তরুণ-তরূণীদের আড্ডা চলে। তারপর ঋষিকেশ নিঃঝুম। গঙ্গার পারে কিছুটা সময় চুপ করে বসে থাকা গেলে নদী প্রবাহের কত ধ্বনি শোনা যায়।
আঁধার ফিকে হয়েছে। ফুটে উঠছে এক স্নিগধ সকাল। পাহাড়, নদী, জঙ্গল, হালকা কুয়াশা, একটা নতুন সকাল। পাহাড়ের উপর ৪৩৬৩ ফুট উচ্চতায় নীলকণ্ঠ মহাদেবের মন্দির। মন্দির চত্বর থেকে সূর্যোদয় দেখলাম। দিকচক্রবাল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল আলো। ভোর যেন ফুটে উঠল আলোয়, রঙে। পূজা সামগ্রীর কয়েকটা দোকান। খুলছে সবে। লোকজন আসতে শুরু করলেন। আঞ্চলিক মানুষ বলেই মনে হল। আমি পাহাড় থেকে নেমে এলাম।
ঋষিকেশ থেকে নীলকণ্ঠ মহাদেব মন্দিরের দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার। ভোরবেলা নীলকণ্ঠ পাহাড়ে উপস্থিত থাকার জন্য একটা রাত ঋষিকেশে থাকতে হবে। গাড়ির ব্যবস্থাও করে রাখতে হবে। গাড়িতে গিয়ে উৎরাই পথে ট্রেক করে নীলকণ্ঠ পাহাড় থেকে গঙ্গার তীর ধরে ঋষিকেশে ফিরে আসার ব্যবস্থা হতে পারে।
ফটো সৌজন্য
উত্তরাখণ্ড পর্যটন
ক্যাম্পিং ইন ঋষিকেশ
ঋষিকেশ ওয়ান্ডার স্কাই
উত্তরাখণ্ড হেভেন