Follow us
Search
Close this search box.

উত্তরপ্রদেশের বিসরখে রাবণের মন্দিরে

উত্তরপ্রদেশের বিসরখে রাবণের মন্দিরে

পারিবারিক কাজের সূত্রে এবার (২০২৫) দীপাবলীর সময়টা দিল্লিতে কেটেছে। ওখানে তখন দিওয়ালির উৎসবের মেজাজ। এখানে-সেখানে আলোর রোশনাই। বাজারগুলো জমজমাট। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ইতিউতি একটু-আধটু ঢুঁ মারা, এরকমটাই চলছিল। এরমধ্যেই জানা গেল, উত্তরপ্রদেশের অন্তুর্গত গ্রেটার নয়ডার বিসরখ নামের এক গ্রামে রাবণের মন্দির রয়েছে এবং সেখানে পুজো-পার্বণও হয়ে থাকে। বিসরখ গ্রামটি রাবণের গ্রাম নামে পরিচিত। দিল্লি বা সেন্টাল নয়ড়া থেকে খুব বেশি দূর নয়।

উত্তরপ্রদেশেরই কানপুর, মধ্যপ্রদেশের বিদিশা ও মন্দসৌর, রাজস্থানের যোধপুর, হিমাচল প্রদেশের কাংড়া, অন্ধ্রপ্রদেশের কাকিনাড়া, মহারাষ্ট্রের গড়চিরালি, কর্নাটকের মান্ড্য জেলার মালভাল্লিতে রাবণের মন্দির রয়েছে। গুগুল খুলে বিসরখের প্রাচীন শিবমন্দিরের কথা জানা গেল, এবং জানা গেল যে ওটাই রাবণের মন্দির। রাবণের পিতাও ওখানে অবস্থান করেন। কাছাকাছি রয়েছি, মন্দিরটা দেখার আগ্রহ প্রবল হয়ে উঠল।

আগের রাতটা কেটেছে নয়ডার একটা হোটেলে। কর্মসূত্রে বর্তমানে নয়ডায় বসবাসকারী এক বাঙালি যুবক কালীপুজোর দিন নয়ডার কালীবাড়ির পুজো দেখতে যেতে বলেছিলেন। পরের দিন অর্থাৎ কালীপুজোর দিন সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়া গেল। নয়ডায় বাঙালি অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন বড় আকারের কমপ্লেক্স তৈরি করেছে। সেখানেই পুজোর আয়োজন। নয়ডার সেক্টর-২৬-এ কালীবাড়ির অবস্থান। সামনের বড় রাস্তাটা কালীবাড়ি মার্গ। ওই কমপ্লেক্সের মধ্যেই আলাদা ভবনের দোতলায় স্থায়ী মন্দির। শান্ত পরিবেশ। পুজোর প্রক্রিয়া চলছে। দুর্গাপুজোও হয় এখানে। চারিদিকে হিন্দির মধ্যে এই কালীমন্দিরে বাংলা ভাষার ছররা উড়ছে। নারী, পুরুষ, শিশুদের জমায়েত। করমর্দন, নমস্কার-প্রতি নমস্কার। বাচ্চাদের নতুন বন্ধুত্ব তৈরি হচ্ছে বোঝা যায়।

কালীবাড়ি চত্বর থেকে বেরিয়ে এলাম। রওনা হওয়া গেল বিসরখের দিকে। গাড়ি চলল ফরিদাবাদ-নয়ডা-গাজিয়াবাদ এক্সপ্রেসওয়ে ধরে। একটা মোড় থেকে গাড়ি ডানদিকের পথ ধরল। ক্রমশ একটা মফস্বল শহরের পরিবেশে ঢুকে পড়লাম। এটা জালালপুর এলাকা। তারপর সরু পাড়ার পথ। গাড়ির চালক ছেলেটি জায়গাটা চেনে না। মথুরার ছেলে। ওর গাড়িতেই ফিরব, এমন কথা দিয়ে ওকে খানিক শান্ত করা গেল। বিসরখকে এখন আর গ্রাম বলা যাবে না। একটু দূরের দিকে তাকালে দেখা যাবে, আকাশচুম্বি সব অট্টালিকার সারি ঘিরে ধরছে বিসরখকে। অবশেষে মন্দির চত্বরে পৌঁছানো গেল। ৪০ মিনিটের মতো সময় লাগল।

একটা ছোট রাস্তার দু’দিকে দুটি মন্দির চত্বর। একটি বহু প্রাচীন শিব মন্দির। অন্যটি পরে তৈরি শিব-পার্বতী মন্দির। শিবমন্দির চত্বরে ঢুকে পড়লাম। প্রবেশদ্বারের মাথায় গণেশের মূর্তি। অবশ্যম্ভাবি ভাবে চোখ টানবে মূল শিব মন্দিরের দেওয়ালের গায়ে অন্য নানা দেবদেবীর সঙ্গে বড় আকারের দশানন রাবণের মূর্তিটি। মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে শিবনিঙ্গের পূজা চলছে তখন। পূজারির সঙ্গে কথা বলা গেল না। মন্দির চত্বরের উল্টোদিকে আরেকটি টানা লম্বা আকারের একতলা বাড়ি। ওটাও মন্দির। পরপর বভিন্ন দেবদেবী। সামনে দিয়ে যাতায়াতের পথ।

এই মন্দিরের মধ্যে ঢুকতেই মুখোমুখি এক অচেনা মূর্তি। একটা ছোট্ট প্লেটে নাম লেখা, বিশ্বশ্রবা মুণি। ইনি রাবণের পিতা। একটি শিবলিঙ্গের মুখোমুখি উপবিষ্ট ঋষিমূর্তিটি। বিসরখ জায়গাটির নামের সঙ্গেও বিশ্বশ্রবা নামটির যোগাযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, রাবণও শিবের উপাসক ছিলেন।

এই মন্দিরের গৌরী-শঙ্কর তথা শিব-পার্বতীর যুগল মূর্তিটি যেন আঞ্চলিক এক পরিবারের কর্তা-গিন্নির প্রতিরূপ। লোক-গাঁথার একটি পংক্তি যেন। মন্দিরে রয়েছে ধন-সম্পত্তির দেবতা কুবেরের মূর্তি। রাবণের বৈমাত্রেও ভাই এই কুবের। মন্দিরের অন্যপ্রান্তে কালীমূর্তি। সেখানে আঞ্চলিক কয়েকজন মহিলাকে দেখা গেল। এখানে দেবদেবীকে খই নিবেদনের প্রচলন রয়েছে। প্রতি মূর্তির পাদদেশে খই ছড়িয়ে রয়েছে। একটা কুকুরকে সেই খই খেতে দেখলাম মূর্তির সামনে থেকে। এটাও এই মন্দিরের প্রচলিত দৃশ্য বলে জানা গেল।

বিসরখের এই মন্দিরটি নানা দিক থেকেই অন্যরকম। দেশজ আঘ্রাণটা বেশ পাওয়া যায়। ঘোড়ায়-টানা রথে সূর্যদেবের মূর্তি রয়েছে। দেবতার পাকানো গোঁফ। দুই ঘোড়ায় টানা এক চাকার রথ। এরকমটা সাধারণত দেখা যায় না। নবগ্রহের মন্দির রয়েছে, সেখানে নবগ্রহের ওপর দৃষ্টি রেখেছে যম। একটা বোর্ডে হিন্দিতে লেখা রয়েছে ‘শনি চালীসা’র মন্ত্র।

জানা গেল, দশেরায় যখন দিল্লির রামলীলা ময়দান ও অন্যত্র এবং উত্তর ভারত-সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাবণের কুশপুতুল পোড়ানো হয়, তখন বিসরখে শোক পালন করা হয়। রাবণকে এখানে একজন জ্ঞানী ও বীর হিসেবে মান্য করা হয়। এ ধারণা, এই ব্যতিক্রমী ধর্মাচরণ বিসরখের বহু দিনের। শ্রাবণ মাসে মন্দিরে ভিড় হয়। টুরিস্টরা যে এখানে খুব আসেন এমনটা নয়। তবে শুধু মন্দিরটিকে কেন্দ্র করেই এখানে পর্যটনের ব্যবস্থা হতে পারে। এই মন্দিরে রাম, হনুমানজি, রাবণ, রাবণের পিতা, এদের সকলেরই মূর্তি পূজিত হয়ে থাকে। বিবিধের মাঝে মিলন মহানের ধারণা বিসরখের মন্দিরে খুব স্পষ্ট।

২০১১ সালের জনগননা অনুসারে, উত্তরপ্রদেশের জালালপুরের বিসরখ গ্রামে ২৪ শতাংশ দলিতের বসবাস। আদিবাসী, দলিত জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে রাবণ আরাধনার প্রচলন রয়েছে, এটা লক্ষ্য করা যায়। বিসরখের বেশিরভাগ জমির মালিকানা ‘উচ্চবর্ণের’ অধিবাসীদের হাতে। উভয়ের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে দ্বন্দের নানা ঘটনার উদাহরণ রয়েছে। রাবণের আরাধনা কি প্রতিবাদের ধর্ম? সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছিল আমাদের গাড়ির তরুণ চালক বাবুলাল যাদব, একসময় হঠাৎ বলে উঠল, “ইহা শিবজি কী বড়ী ভূমিকা হ্যায়”। মথুরার বাবুলাল মোক্ষম কথা বলল একটা। সত্যিই তো, লোকদেবতা হিসেবে আসমুদ্রহিমাচল প্রতিষ্ঠিত শিব। রাবণকে শিব আরাধনা থেকে ঠেকানো যায়নি।

ওই বাবুলালের ভূমিকা বড় হয়ে উঠল। ফেরার তাড়া দিয়ে চলেছে। এলাকার পথ ধরে একটু হেঁটে আসার ইচ্ছে ছিল, সে আর হয়ে উঠল না। বিসরখে রাবণের নামে দোকানপাটও আছে বা ছিল। ফেরার পথে লাইটপোস্টে, অন্যত্র বাবাসাহেব আম্বেদকরের ছবি চোখে পড়েছে।

নয়ডা সেক্টর-৮১ মেট্রো স্টেশন বিসরখের নিকটতম মেট্রো স্টেশন। বিসরখ এই স্টেশন চত্বর থেকে সাড়ে ৪-৫ কিলোমিটার। গাড়ি ভাড়া করে আসা যায়। দিল্লি, নয়ডায় উবেরের সার্ভিস বেশ ভালো। ভাড়ার হার কলকাতার তুলনায় কম। দিল্লি থেকে মেট্রোতেই সেক্টর-৮১ স্টেশন চলে আসা যাবে। দিল্লির বড় মেট্রো স্টেশন রাজীব চক থেকে প্রথমে নীল লাইনের ট্রেনে নয়ডা সেক্টর-৫২’য় চলে আসা যায়। সেখান থেকে জল-রঙের (অ্যাকোয়া) লাইনের ট্রেন ধরে নয়ডা সেক্টর-৮১ মেট্রো স্টেশন পৌঁছে যাওয়া যাবে। নিউ দিল্লি মেট্রো স্টেশন থেকে ইয়েলো লাইনের ট্রেনে রাজীব চক স্টেশনে চলে আসা যায়।

ফটো (ওপর থেকে)
শিবমন্দির চত্বর।
মন্দিরের প্রাচীরগাত্রে রাবণের মূর্তি।
রাবণের পিতা বিশ্বশ্রবার ঋষির মূর্তি।
গৌরী-শঙ্কর মূর্তি।
কুবেরের মূর্তি।
শিবের দিকে নির্নিমেষে চেয়ে আছে নন্দী।
নবগ্রহ মন্দিরে যম।

ফটোঃ লেখক।

Comments are closed.