ডিসেম্বরের এক রবিবারের সকালে বেরিয়ে পড়া গিয়েছিল। আমি ও আমার স্ত্রী এবং আমার এক দাদার পরিবার মিলে মোট পাঁচজন। গন্তব্য রাবড়ি গ্রাম। অনেকেই হয়তো শুনেছেন এবং গিয়েছেন গ্রামটিতে। আবার অনেকেরই হয়তো জানা নেই এ গ্রামের কথা, যাওয়াও হয়নি। আমার শোনা ছিল , যেয়ে ওঠা হয়নি। এমনিতেই একটি মিষ্টি রোগ আছে আমার, মধুমেহ তথা সুগার। তাই যাওয়ার জন্য পিছন থেকে ঠেলে দেওয়ার লোকের অভাব। আহা, রাবড়ির মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খাব এমন তো নয়, একটা গ্রামও তো বটে, আহা কী নাম, রাবড়ি গ্রাম। অতএব, চালাও পানসি।
রাবড়ির কথা হলে বেনারসের রাবড়ির কথা আসবেই। আমাদের এই রাবড়ি গ্রামের অবস্থান এই বঙ্গেই। কলকাতার প্রায় পড়শি গ্রাম। এসপ্ল্যানেডকে যদি কলকাতার কেন্দ্রস্থল হিসেবে ধরা হয় তবে আমাদের এই রাবড়ি গ্রাম সেখান থেকে ৪০-৪২ কিলোমিটার মাত্র। হুগলি জেলার আঁইয়া পঞ্চায়েতের গাংপুর গ্রামটিই কালক্রমে রাবড়ি গ্রামের পরিচিতি পেয়েছে। ট্রেনে গেলে নামতে হবে ডানকুনি স্টেশনে। গাংপুর ডানকুনি স্টেশন থেকে ২০ কিলোমিটার।
আমরা গিয়েছিলাম দমদমের নাগেরবাজার থেকে, গাড়িতে। বেরতে একটু বেলাই হয়েছিল। যাত্রা শুরু হল বেলা ১১টা নাগাদ। যশোর রোড হয়ে প্রথমে ডানকুনি, তারপর চণ্ডীতলাকে বাঁ-দিকে রেখে জনাই হয়ে গাংপুরের রাবড়ি গ্রামে যখন পৌঁছানো গেল তখন সাড়ে ১২টা।
কলকাতা থেকে ডানকুনি হয়ে অহল্যাবাই রোড ধরে মশাট বাজার চলে আসতে পারেন। মশাট বাজার থেকে বাঁ-দিকের রাস্তাটি চলে গেছে হাওড়ার বড়গাছিয়া। ওই বড়গাছিয়া যাওয়ার রাস্তাতেই পড়বে গাংপুর।
কলকাতার কাছেই। কিন্তু গ্রাম বলতে যা বোঝায় আঁইয়া-গাংপুর তেমনটাই। গোবরজল দিয়ে নিকানো বাড়ির উঠোন, পুকুরে হাঁস, রাস্তার ধারে খোঁটায় বাঁধা ছাগল, বাড়ির উঠোনে সতেজ ধনেপাতার ফলন দেখে মন ভালো হয়ে গেল।
এক জায়গায় গাড়ি রেখে আমরা ঢুকে পড়লাম রাবড়ি গ্রামের অন্দরে। বাঁধানো গলিপথ ধরে সমগ্র রাবড়ি গ্রাম ঘোরা যায়। অনেক বাড়িতেই রাবড়ি তৈরির ব্যস্ততা চোখে পড়ছে। ঢুকে পড়ছি এ-বাড়ি সে-বাড়ি। আলাপ হচ্ছে রাবড়ি-প্রস্তুতকারক পরিবারের সঙ্গে। আর প্রায় সব জায়গাতেই আমাদের রসনাও সিক্ত হচ্ছে রাবড়ির আস্বাদে। এই প্রথম গুড়ের রাবড়ি খেলাম। শীতের মরশুমে তৈরি হয়। চিনির রাবড়ি তো আছেই। সুগার-ফ্রি রাবড়িও পাওয়া যায়। নিপাত যাক মধুমেহ। একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, এই গাংপুর গ্রামের অনেক বাসিন্দার পদবী ‘বালতি’। পদবীটির উৎস সম্পর্কে জানার কৌতূহল তৈরি হয়েছে।
বড় কড়াইয়ে দুধ ফুটে ঘন হচ্ছে ক্রমাগত। হাতপাখা দিয়ে বাতাস করা হচ্ছে কড়াইয়ের দুধের ওপর আর সরের পুরু আস্তরণ জমা হচ্ছে। একটা কাঠি দিয়ে সেই সরের সেই আস্তরণ কড়াইয়ের গায়ে লেপ্টে দেওয়া হচ্ছে। পরে পুরু সরের সেই লেয়ার কেটে কেটে অবশিষ্ট ঘন দুধের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া গেলেই কেল্লা ফতে। তবে কাজটা সহজ নয়। প্রচণ্ড ধৈর্য, মনঃসংযোগ আর সেইসঙ্গে পরিশ্রমের ফসল এই দেবভোগ্য রাবড়ি। জন্মাষ্টমিতে গাংপুরের রাবড়ির চাহিদা অনেকগুন বেড়ে যায়। জন্মাষ্টমিতে দেবতাকে ক্ষীর, রাবড়ি অর্ঘ্য দেওয়ার প্রচলন রয়েছে।
জানা গেল, প্রায় ৭ লিটার দুধ থেকে ২ কেজি রাবড়ি তৈরি হয়। ওই সাত লিটার দুধে মেশানো হয় ৫০০ গ্রাম চিনি। কলকাতা, হাওড়ার নামী সব মিষ্টির দোকানে সরবরাহ হয় গাংপুরের রাবড়ি। পারিবারিক নানা অনুষ্ঠানেও রাবড়ি পাঠানো হয় গাংপুর থেকে। এই মুহূর্তে গাংপুরের প্রায় ৫৫টি পরিবার রাবড়ি তৈরি করে থাকে। দুধের সরবরাহ আসে নানা গ্রাম থেকে। সামগ্রিক ভাবে গাংপুরের রাবড়ি-অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে অনেকগুলো পরিবার। পাশাপাশি চলে চাষ-আবাদের কাজ। মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে রাবড়ি তৈরি করতে পারেন। মহিলারা সূক্ষ্ম হাতে রাবড়ি তৈরি করেন, পরিবারের পুরুষেরা শহরে সেই রাবড়ি সরবরাহ করে থাকেন।
আরেকটা কথা তো এখনো বলাই হয়নি। প্রধাণত, রাবড়ির জন্য বিখ্যাত হলেও, গাংপুর গ্রামে তৈরি হয় উৎকৃষ্ট মানের সরভাজা ও ঘি। তারও চাহিদাও কম কিছু নয়।
রাবড়ি একটু একটু করে চেখে দেখেছিলাম অনেকগুলো বাড়িতে। কিন্তু দুপুরে তো কিছু খেতে হয়। এক ঘরে গুড়ের রাবড়ির অর্ডার দিয়েছিলাম। সেই বাড়ির কাকিমা বললেন, তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণ করতে প্রায় আড়াই ঘন্টা সময় লেগে যাবে। ফলে দুপুরের খাওয়াদাওয়ার সময় পাওয়া গেল। ধারেকাছে কোনও রেস্তোরাঁর সন্ধান পাওয়া গেল না। গাড়ি নিয়ে কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে গিয়ে রাস্তার ধারের একটা দোকানে সাদামাটা মধ্যাহ্নভোজন সারতে হল।
একটা কথা আমার মনে হয়েছে, গাংপুর গ্রামে বা তার কাছাকাছি একটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন খাবার জায়গা তৈরি হলে খুব ভালো হয়। একটা হোমস্টের ব্যবস্থা হলে তো আরও ভালো। সেক্ষেত্রে বিশ্রাম নেওয়া, প্রয়োজনে রাতে থাকার ব্যবস্থাটাও হয়। অনেকেই তো এই গ্রামটিতে বেড়াতে আসেন। এখন যাঁরা রাবড়ি গ্রামে যাবেন, তাঁদের কিছু খাবারদাবার সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়াই সমিচীন হবে।
যাইহোক, খাওয়াদাওয়া সেরে ফিরে এলাম রাবড়ির গ্রামে। ঘরে ঘরে তুমুল ব্যস্ততা। একেই শীতের মরশুমে, রাবড়ির চাহিদা এমনিতেই বেড়ে যায়, তার উপর সামনেই বর্ষশেষের উৎসব। সদ্য-তৈরি হওয়া রাবড়ি ও ঘি সঙ্গে নিয়ে পড়ন্ত বিকেলে আমরা গৃহাভিমুখে যাত্রা করলাম।
দরদস্তুরঃ
চিনির রাবড়ি ৩০০ টাকা কেজি।
গুড়ের রাবড়ি ৪০০ টাকা কেজি (পাওয়া যাবে শীতের মরশুমে)।
সুগার-ফ্রি রাবড়ি ৪০০ টাকা কেজি।
সরভাজা ১০ টাকা পিস।
সরের ঘি ৭০০-৯০০ টাকা কেজি।
গ্রীষ্মের মরশুমে পাওয়া যায় আমের রাবড়িও।