বসন্তের পুরুলিয়া মানে পলাশের পুরুলিয়া। এ সময় বর্ণবাহারে বদলে যায় তথাকাথিত রুক্ষ ভূমির চালচিত্র। এ বছরও, বনের মাথায় মাথায় জ্বলতে শুরু করেছে পলাশের অগ্নিশিখা। মাঝ-ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের শেষ (কখনো এপ্রিলের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহ) পর্যন্ত চাক্ষুষ করা যায় সে দৃশ্য। সে শুধু তো চোখে দেখা নয়, মজে যাওয়া, দৃশ্যে, অনুভবে। আবার মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে বনে বনে পলাশের সঙ্গে সঙ্গত করে ঝাঁকে ঝাঁকে মহুয়া ফুল।
কোথায় যাওয়া যায় পলাশের বন দেখতে? পুরুলিয়ার প্রায় সর্বত্রই পলাশ ফোটে। তবে কোথাও কোথাও বনতল ফুলে ফুলে ঢেকে যায়। লাল, কমলা, হলুদ বর্ণের বিদ্যুৎরেখা খেলে যায় বনে বনে। পলাশ বনের সাহচার্যেই যদি থাকার ব্যবস্থা হয় বা দু’ পা বাড়ালেই যদি পলাশ বনে ঢুকে পড়া যায়, শরির বেয়ে যদি টুপটাপ ঝরে পড়ে ফুল; সে স্বপ্ন, সে বাস্তবও।
পুরুলিয়ার পুবে বাঁকুড়া, উত্তর-পুবে পশ্চিম বর্ধমান, দক্ষিন-পূর্বে ঝাড়গ্রাম জেলা। অন্য তিন দিকে, মানে পশ্চিম, উত্তর পশ্চিম ও দক্ষিণ পশ্চিমে ঝাড়খণ্ডের সীমানা। ঝাড়খণ্ডের প্রাদেশিক ফুল পলাশ ( বৈজ্ঞানিক নামঃ বুটিয়া মনসপার্মা)। ঝাড়খণ্ডেও প্রচুর পলাশ ফোটে দিগ্বিদিকে। ছোটনাগপুর মালভূমির একটা বড় অংশ ঝাড়খণ্ড এবং সেই মালভূমিই নেমে এসেছে পুরুলিয়ায়। ঝাড়খণ্ডের সীমানা বরাবর বাঘমুন্ডি, বেগুনকোদর, ঝালদা, আরশা, বলরামপুর এবং জেলার দক্ষিণে বান্দোয়ান অঞ্চলে প্রচুর পলাশের বন রয়েছে।
অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশের জঙ্গলগুলিতে, গ্রামে গ্রামে প্রচুর পলাশ ফোটে। পুরুলিয়া শহর থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে ছোট ছোট পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা মুরগুমা লেকের জলে এ সময়ে পলাশের বর্ণচ্ছটা দেখা যায়, সে এক বাড়তি পাওনা। মুরগুমায় থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
বাঘমুন্ডিতে থাকার ব্যবস্থা হলে কাছাকাছির মধ্যে সুইসা গ্রামটি বেড়িয়ে আসা উচিত হবে। খিরাবেরা গ্রামে যাওয়া যায়। বাঘমুন্ডি ব্লকের বিভিন্ন গ্রামেই পলাশের মারকাটারি রূপ প্রত্যক্ষ করা যাবে।
পশ্চিম পুরুলিয়ার ঝালদা মহকুমার অন্তুর্গত তুলিন প্রকৃতই এক পটে আঁকা ছবি। বসন্তের তুলিনে পলাশের অপরূপ সাজটি দেখে বিস্মিত হতে হয়। পুরুলিয়ার ঝালদা-১ ব্লকের অন্তুর্গত এই তুলিন গ্রাম। পুরুলিয়া শহর থেকে দূরত্ব কমবেশি ৫৭ কিলোমিটার। তুলিন থেকে অযোধ্যা পাহাড় ৪২ কিলোমিটার। ঝাড়খণ্ডের মুরি স্টেশন থেকে তুলিন ৩ কিলোমিটার। তুলিনে থাকার ব্যবস্থা হতে পারে ব্রিটিশ আমলের হেরিটেজ বাংলোয়। তুলিনের কাছে তপোবনেও পলাশের উৎসব চাক্ষুষ করা যাবে।
বাঘমুন্ডি থেকে তুলিন অথবা তুলিন থেকে বাঘমুন্ডি যাওয়া যায় পলাশ বনের মধ্যে দিয়েই। গাড়ির চালককে মনের সেই ইচ্ছেটির কথা জানিয়ে রাখতে হবে। বাঘমুন্ডি আর বলরামপুরের সীমানায় আদিবাসী গ্রাম দুয়াদসিনিতেও পলাশের বিরাট আড্ডা। ঝাড়গ্রাম-লাগোয়া বান্দোয়ান শহর থেকে দুয়ারসিনি ১৩ কিলোমিটার।
পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর সাবডিভিশনের বড়ন্তি গ্রাম অল্পদিনেই পরিবেশবান্ধব পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ঋতু থেকে ঋতুতে বড়ন্তির রং বদলায়। বড়ন্তি লেক এখানকার বিশেষ আকর্ষণ বড়ন্তির দণ্ডহিত, ভেটিগ্রাম ও সংলগ্ন গ্রামগুলিতে অবাক করা সব পলাশের বন দেখা যাবে। ওই দণ্ডহিত গ্রামে পলাশবাড়ি ইকোলজিক্যাল রিসর্টের পরিসীমার মধ্যেই সহস্রাধিক পলাশ বৃক্ষ রয়েছে। বন সংরক্ষণ ও বাণিজ্যকে একসূত্রে বাঁধার এই উদ্যোগ প্রশংসার যোগ্য।
পলাশ বনে রঙের উৎসব, আদিবাসী তরুণীর খোপায় পলাশগুচ্ছের দৃশ্য অপরুপ তো বটেই। তারপরেও কথা থাকে। যুগ যুগ ধরে পলাশের সঙ্গে ঘর করছেন আদিবাসীরা। আবিষ্কার করেছেন পলাশ বৃক্ষের ব্যবহারিক নানা গুনও। পলাশ গাছের ফুল, পাতা, বীজ, গাছের ছাল ও শিকড় ওঁরা নানা অসুখের চিকিৎসায় ও রোগ প্রতিরোধে ব্যবহার করেন। শুশ্রুত, চরক প্রণীত আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে পলাশ গাছের নানা অংশ ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের নিদান রয়েছে। পেটের সংক্রমণ, ডায়েরিয়া, চুলের সমস্যা, ডায়াবেটিস ও লিভারের চিকিৎসায় পলাশ গাছের নানা অংশ ব্যবহার করেন আদিবাসীরা। পলাশ পাতার পেস্ট শরীরের ক্ষত সারায়। আদিবাসীরা শুকিয়ে রাখা পলাশ ফুল দিয়ে আচার তৈরি করেন। পলাশ ফুলের নির্যাস ব্যবহার করে চমৎকার শরবৎ তৈরি হতে পারে।
আর ওই যে মহুয়া, তারও হরেক গুন। মহুয়া মানে শুধু রাঢ়বঙ্গের দেশি মদ নয়। আদিবাসীরা চর্মরোগে মহুয়া ফুলের পেস্ট ব্যবহার করেন। হজমের সমস্যায়, মাতৃদুগধের পরিমাণ বাড়াতে, মাথার যন্ত্রনার উপশমে মহুয়ার ফুল ব্যবহার করেন আদিবাসীরা। পলাশের ফল রান্নায় সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পলাশ ফলের বীজ থেকে তেল তৈরি হয়। সেই তেল রান্নায় ব্যবহৃত হয়।
পলাশ, মহুয়া, কেঁড়, কুসুম নিয়ে হরেক কথা। সে পুরুলিয়া-সহ বৃহত্তর রাঢ়বঙ্গ, জঙ্গলমহলের অবাক করা বর্নচ্ছটার কথা।
ফটো সৌজন্য
পলাশবাড়ি ইকোলজিক্যাল রিসর্ট
তুলিন হেরিটেজ বাংলো
ওয়াইল্ডলাইফ এস ও এস
ম্যাপঃ ট্র্যাভেল পুরুলিয়া
পড়তে পারেন
‘অপরূপ বড়ন্তি’
https://torsa.in/beautiful-baranti/
‘পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা পুরুলিয়ার অপরূপ দুই লেক’
https://torsa.in/two-beautiful-lakes-of-purulia/
‘ঝাড়খণ্ড সীমান্তে পুরুলিয়ার তুলিন’
https://torsa.in/tulin-at-jharkhand-border/
‘অফবিট পুরুলিয়াঃ জজহাতু’
https://torsa.in/offbeat-purulia-jojhatu/