নেতারহাট থেকে বেতলার পথে
ঘন কুয়াশায় আঁটা নেতারহাট ছেড়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। নেতারহাট থেকে গারু হয়ে বেতলা ৯৩ কিলোমিটার পথ। ঠিক করেছি, পথে যেতে যেতে তিনটে ঝর্ণা দেখে যাব। অন্যথায় আগামীকাল বেতলা থেকে বেরিয়ে এই ঝর্ণাগুলো দেখতে সারাদিন লেগে যাবে। ঘুরে যাব বলে আজ ৪০-৪৫ কিলোমিটার পথ বেশি পাড়ি দিতে হবে। বেশিরভাগটাই জঙ্গুলে পথ। ঘন্টাখানেক চলার পরে কুয়াশা কেটে গেল। শাল-মহুয়ার মগডালে নরম আলোর রোশনাই। বুনো মাকড়সার বিরাটাকার জালে ধরা পড়েছে সূর্য। এখানে সেখানে যেন হিরে থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে আলো। আমাদের প্রথম গন্তব্য লোধ জলপ্রপাত। একটা সরকারি বোর্ড জানান দিল, আর ১৬ কিলোমিটার।
লোধ জলপ্রপাত
বনাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে একটা গ্রাম্য পথে ধরে পৌঁছাতে হয় জলপ্রপাতের কাছে। জঙ্গলের নাম মহুয়াডোর। এবড়ো খেবড়ো রাস্তা। তবে তা বিরক্তির হয়ে ওঠে না চারপাশের অমলিন ও অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে।
৪৭০ ফুট উপর থেকে সবেগে ও সশব্দে অবিরাম নেমে আসছে জলরাশি। বর্ষায় এই প্রপাতের রূপ কী দাঁড়াবে আন্দাজ করা যায়। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাথুরে পথ ধরে একটু কষ্ট করে প্রপাতের নীচের দিকে নেমে গেলে দৃশ্যে-শ্রাব্যে মনপ্রাণ জুড়িয়ে যাবে।
সঙ্গে ছিল পানীয় জলের বোতল। প্রপাতের নীচে যাওয়ার রাস্তার প্রবেশপথে বনবিভাগের এক কর্মী ১০ টাকা জমা নিয়ে টিকিটের পিছনে লিখে দিল, ফেরার পথে ওই বোতোল দেখালে তবে ছাড়, জমা রাখা ১০ টাকা ফেরতও পাওয়া যাবে। পরিবেশ রক্ষায় অভিনব এই প্রয়াসের সাধুবাদ প্রাপ্য। নীচের দিক থেকে জলপ্রপাত দেখে, খানিক সময় কাটিয়ে উপরে উঠে এলাম।
বনপথ থেকে রাজপথে উঠেই পেয়ে গেলাম একটা হোটেল। আমাদের ফরমায়েশ মতো সামনেই বানিয়ে দিল তাওয়া রুটি, আলু-পটলের তরকারি আর ওমলেট। এরপর গাঁয়ের গরুর মোটা দুধের চা। খাওয়াদাওয়া সেরে একেবারে চাঙ্গা।
সুগাবাধ
এবার সুগাবাধ ঝর্ণা। জঙ্গলের পথে একজায়গায় ঝর্ণায় যাওয়ার দিকনির্দেশ রয়েছে, বেখেয়ালে পেরিয়ে যেতে পারে। ওই জায়গাটি থেকে বাঁয়ে দেড় কিলোমিটার গেলেই ঝর্ণা। প্রায় সমতলেই শিলাস্তর ভেদ করে পাথরের বুক চিরে বয়ে চলেছে ঝর্ণা-প্রবাহ। যুগ যুগ ধরে জলস্রোতে পাথর ক্ষয়েছে। কতগুলো পাথরখণ্ড দেখে মনে হয় সেগুলো যেন চোখের গহ্বর। আমার এরকমটা মনে হল। জল যে এভাবে পাথরকে ক্ষতবিক্ষত করতে পারে তা এমনটা না দেখলে বিশ্বাস হয় না। উল্টোদিক থেকে দেখতে গেলে এমনটাই প্রকৃতির ভাস্কর্য গড়ার রীতি। শিলাস্তরে হয়তো রয়েছে কত জীবাশ্মের অস্তিত্ত্ব।
ঝর্ণা দেখে উঠে আসছি, চোখে পড়ল, দুটি পাথর পিঠোপিঠি দাঁড়িয়ে আছে, কতকাল ধরে কে জানে। হথাৎ মনে হল, কত কত কালের মধ্যে দিয়ে আমিও পথ হেঁটে চলেছি এদেরই সঙ্গে। তাই কাটানো গেল কিছুটা সময় ধরিত্রী মায়ের কোলে।
এরপর ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। বুনো গন্ধে ম’ ম’ করছে চারিদিকটা। বিক্রমের গাড়ি চালানোর হাতটা বড় ভালো। পথেই পড়ল মিরছাইয়া ঝর্ণা। ঝর্ণার সামনে একটা পুল। তার ওপর থেকে খুব ভালো দেখা যায় ঝর্ণাটা। পুলটা একটা ফটোশ্যুট পয়েন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফাঁকা পাওয়া দুষ্কর। এরপর শুরু হল আরও গভীর জঙ্গলের পথ। এখানে সেখানে রাস্তার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে নাম না জানা সব ঝর্ণার জলধারা। পথে পড়ল কোয়েল নদীর সেতু। কোয়েল এখানে বেশ প্রশস্ত। গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। পড়ন্ত বিকেলের রোদ্দুরে ঝকমক করছে মিষ্টি নদী কোয়েল।
বেতলার জঙ্গল
অতঃপর পৌছালাম বেতলা জাতীয় উদ্যানের ঠিক বিপরীতে ঝাড়খণ্ড পর্যটন বিভাগের হোটেল বনবিহার-এ। জানলার পর্দা সরালেই জঙ্গল। স্নান-খাওয়া সেরে আশপাশটা দেখতে দেখতে জঙ্গলে আঁধার ঘনিয়ে এল। বাতাসে সেই বুনো গন্ধ আর একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার কলতান।
সকালে ঘুম ভাঙ্গলো দুম দুম শব্দে। শালবনের মধ্যে দিয়ে সবে উঁকি দিয়েছে সূর্য। আমাদের ঘরের জঙ্গলের দিকের বড় জানলায় হানা দিয়েছে হনুমানের দল। জানলায় আঘাত করে ওরাই আমাদের ঘুম ভাঙিয়েছে। সকাল ৬টা থেকে শুরু হয় জঙ্গল সাফারি। বনবিহারের সামনেই বেতলা জাতীয় উদ্যানের প্রধান ফটক। সারি সারি সাফারির জিপ দাঁড়িয়ে। লোকজন তেমন নেই। জানা গেল মাওবাদীরা আজ বনধ ডেকেছে। সাফারি আজ বন্ধ।
বেলা একটু বেড়েছে। গ্রামসভার রাস্তা ছাড়িয়ে উঠে এসেছি রাজ্যসড়কে। উদ্দেশ্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনি ও সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ খ্যাত বনবিভাগের সেই বাংলো ঘুরে দেখা এবং কোয়েল সঙ্গমের জল স্পর্শ করা। ব্যস্ত লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে গাড়ি চলে এল সঙ্গমের কাছাকাছি। কোয়েল ও অরাঙ্গা নদীর সঙ্গম। নদীর তীরে সমুদ্র সৈকতের মতো বালি। কোয়েলে স্নান করছেন অনেকে। অদূরে সিনেমায় প্রদর্শিত সেই রেলব্রিজ। ট্রেন চলেছে নানা লয়ে।
কেয়ারটেকারকে বলেকয়ে প্রবেশ করা গেল বনবিশ্রামাগারের চহুদ্দিতে। কেয়ারটেকার ঘর, ডাইনিং রুম খুলে দিলেন। সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ সিনেমার শ্যুটিং হয়েছিল এখানে। একটা ঘরে যত্ন করে সাজানো আছে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনার সময়ে তোলা নানা মুহূর্ত, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, রবি ঘোষ, সমিত ভঞ্জ, পাহাড়ী সান্যাল, সিমি গ্রেওয়ালের মতো কলাকুশলী এবং সিনেমার নানা দৃশ্যের ছবি। আসার আগে আরেকবার দেখে গিয়েছিলাম ছবিটি। বাংলো চত্বরে এখনো রয়েছে ছবিতে প্রদর্শিত সেই পাতকুয়োটি।
আজকের শেষ গন্তব্য পালামৌ ফোর্ট। কোয়েল-অরাঙ্গার সঙ্গমের কাছাকাছি ষোড়শ শতকে এই দুর্গটি তৈরি করিয়েছিলেন রাজা মেদিনী রায়। খুব সাবধানে উঠলাম নাগপুরী স্থাপত্য শৈলীতে তৈরি গেটের মাথায়। সূর্যও গেল অস্তাচলে। ফিরে এলাম বনবিহারে।
ম্যাকলাস্কিগঞ্জ হয়ে রাঁচির পথে
বেতলা থেকে রাঁচি ১৭৭ কিলোমিটার। ৪-৫ ঘন্টা সময় লাগে। আমরা ম্যাকলাস্কিগঞ্জ হয়ে রাঁচি যাব। ফলে ৬০-৬৫ কিলোমিটার অতিরিক্ত পথ পাড়ি দিতে হবে। জঙ্গল, উপত্যকা, মাঝে মাঝে টিলা পাহাড়, খেত, গ্রাম, এসবের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। পথ চলায় একঘেয়েমি নেই।
৪০-৫০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এলাম পরিত্যক্ত কয়লা খাদান এলাকায়। একটা খাদানকে জমা জলে লেকের মতো দেখতে লাগছে। কন্যা বীপ্সা হাতে করে কখনো কয়লা দেখেনি। কয়লা-কাহিনি বুঝিয়ে বললাম ওকে।
পথের দু’পাশে উঁচু-নিচু টিলা, গুল্ম জাতীয় গাছপালার ঝোপঝাড়, তারপর যতদূর চোখ যায় জনমানবহীন ধূ ধূ প্রান্তর। আরও কিছুটা এগনোর পরে মাঝে মাঝে চোখে পড়তে থাকল সামনে একটা করে বাক্স নিয়ে বসে আছে একজন করে লোক। গাড়ি থামিয়ে আলাপ করলাম এরকম একজনের সঙ্গে। পুরুলিয়ার লোক। গায়ে গায়ে লেগে আছে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা আর ঝাড়খণ্ড রাজ্যটি। বাক্সের মধ্যে মৌমাছির চাক। ওঁরা মধু বিক্রির আশায় বসে আছেন।
পথ চলতি চালু একটা ধাবার সামনে গাড়ি দাঁড় করানো হল। চায়ের বিরতি। লিট্টি তৈরি হচ্ছে। আটার মণ্ডের মধ্যে ছোলার ছাতুর পুর দিয়ে ডুবো তেলে ভাজা। ঘিয়ে চোবানো লিট্টি এই গ্রাম্য পথে অমিল। তা হোক গে, আমরা ক্ষুধার্থ, ওই লিট্টি আর চা দিয়ে তখনকার মতো ক্ষুধা মিটল।
রাজ্যসড়ক ধরে ঘন্টাখানেক চলার পরে রাঁচির পথকে ডানদিকে রেখে ধরলাম ম্যাকলাস্কি যাওয়ার পথ। মনকাড়া সৌন্দর্য এ পথের। প্রায় চার কিলোমিটার এগনোর পরে সাক্ষাৎ হল ছোট্ট পাহাড়ী নদী ডোগাডেগির সঙ্গে।
পথে পড়ল জাগৃতি বিহার। এ জায়গাটা অতীতে ছিল ইংরেজদের অবকাশ যাপনের জায়গা। কেমন একটা গা-ছমছমে পরিবেশ। কয়েকটা গেস্ট হাউস, হোমস্টে আছে এখানে। এখান থেকে রাঁচির পথে ৬ কিলোমিটার যেতে পড়ল ডুলি গ্রাম। এখানে পাশাপাশি রয়েছে রাধাকৃষ্ণের মন্দির, মসজিদ, গুরুদ্বারা ও গীর্জা। সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রয়াস। তবে সংরক্ষণের অভাব চোখে পড়ে।
রাঁচিতে আমরা ঝাড়খন্ড টুরিজমের বিরসা বিহারে থাকব। শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে বিরসা বিহার। রাঁচি স্টেশন থেকে ২ কিলোমিটার। বিরসা বিহারে ওঠার আগে আমরা রাঁচি স্টেশন থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে টুপুদানা এলাকার ডুংরি গ্রামে দেশের অন্যতম পুরনো টিবি স্যানিটোরিয়াম দেখে যাব। এটি রামকৃষ্ণ মিশনের এক পুরনো সেবাকেন্দ্র। এ গ্রামের জমিদার লাল হালদারনাথ সহদেও মিশনের সন্ন্যাসীদের আবেদনে সাড়া দিয়ে ১৬৮ একর জমি দান করেছিলেন। পরে ওবেরিয়া গ্রামের জমিদার রামপ্রতাপ নায়েক দান করলেন আরও ১১৭ একর জমি। একত্রে ২৮৫ একর জমিতে স্যানিটোরিয়ামের শিলান্যাস হয় ১৯৪৮ সালে। গড়ে উঠল ইতিহাস সৃষ্টিকারী টিবি স্যানিটোরিয়াম।
রাঁচির বিবেকভাইয়ের এখানকার অধ্যক্ষ মহারাজের সঙ্গে খুব জানাশোনা। ও বলে দিয়েছিল, আমরা যাব। গেটে প্রহরীর অনুমতি নিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম স্যানিটরিয়ামের বিশাল এলাকার মধ্যে। শান্ত সমাহিত পরিবেশ। ঢুকেই বাঁদিকে শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মন্দির।
দর্শন সেরে মহারাজকে ফোন করলাম। আন্তরিক আহ্বান জানালেন মহারাজ। ঘন্টাখানেক ছিলাম। শুনছিলাম এখানকার বিপুল কর্মকাণ্ডের কথা। পরে এলে এখানে থাকবার জন্য হার্দিক অনুরোধ জানালেন মহারাজ । মায়াবতী গেছি শুনে মহারাজ বললেন, নির্জনবাসের জন্য এটা দ্বিতীয় মায়াবতী। স্যানিটোরিয়ামের কিছুটা অংশ আমাদের ঘুরিয়ে দেখাতে চেয়েছিলেন মহারাজ। বাদ সাধল বৃষ্টি। আবার আসব বলে বিদায় নিলাম। ঝাড়খণ্ড সরকারের পর্যটন বিভাগের হোটেল ‘বিরসা বিহার’-এ উঠব আমরা।
ফটোঃ লেখক (সবচেয়ে উপরের ছবিটি ব্যতীত)
প্রথম পর্বের লেখাটি পড়তে পারেন এখানে https://torsa.in/around-ranchi-on-pujo-holidays/
শেষাংশ পরের পর্বে