যীশুর জন্মদিনটিকে কেন ‘বড়দিন’ বলা হয় , অতি শৈশবেই এই প্রশ্ন নিয়ে যীশুর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তখন পড়তে শিখিনি, কেবল শুনে শুনে জানছি, বুঝতে চেষ্টা করছি । কেউ বলেছিল, এই দিন থেকেই নাকি দিন বড় হতে শুরু করে। অন্য দেশে, আমাদের দেশেও ২৫শে ডিসেম্বর মানে ‘মেরি ক্রিসমাস’, যীশুখৃষ্টের জন্মদিন। ‘বড়দিন’ শব্দটির মধ্যে কিন্তু একটা নিখাদ বাঙালিয়ানা রয়ে গেছে। বড়দিন কথাটা শুনলে আমার মনটা যেমন আনন্দে ভরে যায়, অন্য কোনও শব্দ বা নামে তেমনটা হয় না। বড়দিন যে আমার শৈশব, কৈশোর, এমনকী যৌবনেরও অনেকটা সময় ধরে সেই অমল আলোর দিনগুলি।
আমার শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের বেশ খানিকটা সময় কেটেছে প্রিয় জন্মভূমি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্রের বনগাঁয়। সীমান্ত শহর বনগাঁ। তার সীমান্তে ছয়ঘরিয়া গ্রামে আমাদের পৈতৃক বসতবাড়ি।। বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথে গীর্জা। দাদা-দিদিরা স্কুলে গেলে, বাবা অফিস চলে গেলে মা হলধর ঠাকুরের পুকুরে স্নান করতে যাওয়ার আগে বলে যেত, ‘গীর্জায় বারোটার ঘন্টা বেজে গেল, এবার চান করে নাও।’ ঘড়ি দেখতে শেখার অনেক আগে, একেবারে শৈশবে এভাবেই গীর্জার ঘন্টাধ্বনি শুনে প্রথম সময়কে ধরতে শিখেছিলাম, সময়কে মানতেও শিখতে হয়েছিল।
আমার জীবনে প্রথম স্কুলে যাওয়া ওই গীর্জা-স্কুলে। অ্যাডমিশন টেস্টে ছোটখাটো, ফুটফুটে ফর্সা চেহারার ফাদার তাঁর নরম আঙুল নেড়ে ভাঙ্গা বাংলায় জানতে চেয়েছিলেন মানুষ ইংরেজি কী, মুরগীর ক’টা পা, আর বাড়িতে কে কে আছে। বলে দিয়ে বাঁধা পড়লাম পড়াশোনার বাঁধা নিয়মে। ভর্তি হয়ে গেলাম গীর্জার স্কুলে। বেশ মনে পড়ে, কয়েকদিন স্কুলে যাওয়ার পর, জানা গেল, স্পোর্টস হবে। দু’জনের একটা করে পা পরস্পরের পায়ের সঙ্গে বাঁধা থাকবে। তারপর দু’জন মিলে দৌড়তে হবে। কে আমাকে বলেছিল, দু’জনের পায়ের মধ্যে লোহার রড ঢুকিয়ে দেয়, তারপর দৌড়তে হবে। শিশু মনে কোন যুক্তি কাজ করেনি। ভয় পেয়ে গেলাম, আর কী কান্না, বাড়ি যাব ,আর স্কুলে থাকবো না। কান্না থামাতে ফাদার কোলে করে নিয়ে গেলেন গীর্জার ছাদে ঘন্টা-ঘরে। যে ঘন্টা শুনে জীবনে প্রথম সময়ের ধারনা হয়েছিল তা চোখে দেখলাম। পুজোর ঘন্টার মতোই তো দেখতে, কিন্তু আকৃতিতে কয়েক শতগুণ বড়। সে বয়সে খুব ইচ্ছে করেছিল দড়ি ধরে টান মেরে একবার ঘন্টা বাজাই, বোধ নেই যখন তখন ঘন্টা বাজানো যায় না, ও তো সময় ঘোষণা করে। মুঠো ভরা টিকটিকি লজেন্স নিয়ে আর ঘন্টা দেখে কখন যেন কান্না থেমে গেছে। মাইকেল স্যার বাড়ি দিয়ে গেছিলেন।
আমাদের কাছে দুর্গাপুজোর পর বড় আনন্দের উৎসব ছিল ওই বড়দিন। বনগাঁয় বড় বড় দুর্গা- পুজোর আয়োজন আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে দূরে, আর বড়দিনের উৎসবের ঢেউ এসে পড়ত আমাদের বাড়ির একেবারে উঠোনে। গীর্জা ছাড়াও ওই পাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে ঝুলনের মতো সাজানো হতো মাতা মেরীর কোলে ছোট্ট যীশু, বিচুলি দিয়ে সাজানো গোয়াল ঘর, রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি তারা।
ছোটবেলায় যেমন প্রতিমা তৈরির শুরু থেকে কাছের পুজোমন্ডপে যাতায়াত শুরু হয়ে যেত, মেতে উঠতাম পুজোর আনন্দে, ঠিক তেমনই বড়দিনের তিন চার দিন আগে থেকেই দু’বেলা গীর্জায় যাতায়াত শুরু হয়ে যেত। বেশ বড় আকারের ঝুলন সাজানোর মতো আয়োজন গীর্জা চত্বরে। গোয়াল ঘর, গরু, উট , মাথায় পাগড়ি দেওয়া আলখাল্লা-পরা পন্ডিতদের মূর্তি, সব যত্ন করে সাজানো হতো। ওপর থেকে ঝুলে থাকতো কাগজের অনেক তারা। সব সাজানো হয়ে গেলে বড়দিনের আগের দিন সন্ধ্যায় কাগজের বাক্স থেকে অতি সাবধানে বের করে সাজানো হতো ছোট্ট যীশু আর মাতা মেরী ও পিতা যোশেফের মূর্তি। নানান রঙের আলোকমালায় ভরে যেত গীর্জার বাড়ি, এদিক ওদিক, প্রাচীন নিম গাছ। চব্বিশ ডিসেম্বরের শীতের রাতে মায়ের হাতে তৈরি গরম রুটি, অপূর্ব স্বাদের বাঁধাকপির তরকারি, পাতলা নলেন গুড় রুটিতে মাখিয়ে খেয়ে, আঙ্গুল দিয়ে থালা চেটে ঠাকুমার হাতে তৈরি নকশীকাঁথার ওম গায়ে জড়িয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনায় জেগে থাকতাম অনেকক্ষণ। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়তাম। মাঝরাতে খোল-করতাল বাজিয়ে কীর্তনের সুরে ভগবান যীশুর জন্ম বৃত্তান্ত গাইতে গাইতে যাওয়া স্থানীয় যীশুর অনুগামীদের বড়দিন উদযাপন শুরু হয়ে যেত স্বপ্নের মতো।
বনগাঁর সেই গীর্জার যশোর রোডের দিকে মেন গেট, আর একটা গেট ছয়ঘরিয়া গ্রামে যাওয়ার পথের ওপর। যশোর রোডের দিকে আমাদের বাড়ির অদূরে নানান পসরা নিয়ে যেন মেলা বসে যেত। বাদামভাজা, গজা, পুতুল, খেলনা। বসত বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটানোর দোকান। কাঠের নাগরদোলা। রকমারি মাটির পুতুল, যীশু থেকে নাড়ু গোপাল।
গীর্জার ঘরটি ছিল ইটের তৈরি। টিন বা এসবেসটসের ছাউনি। দেওয়ালে এক দিক থেকে অন্য দিকে পরপর সাজানো ক্রশ কাঁধে নিয়ে চলা যীশুর ছবি। একেবারে পুবের দেওয়ালে ক্রশবিদ্ধ যীশু। সকলের পাপ কাঁধে বহন করছেন। আমরা না বুঝে তাঁকে বিদ্ধ করেছি। হাত, পা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত । ঠিক তার নীচে একটি ফুটফুটে শিশু। তার পাশে কোল পেতে বসে আছেন মা মেরী। আর নতজানু হয়ে বসে আছেন পিতা যোশেফ। তাঁরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন সেই জ্যোতির্ময় শিশুর পানে, সেদিন জানতেও পারেননি তাঁদের এই শিশুটিই আগামীদিনের বিশ্বপিতা।
বড়দিনের দিন বিকেলে বেশ সাজগোজ করে, সোয়েটার গায়ে দিয়ে গীর্জায় যেতাম। সঙ্গে মেলা দেখা। একটু সন্ধ্যা হলেই পুরো বনগাঁ শহর ভেঙে পড়ত সেই মেলায়। একসময় সেই উপচে পড়া ভিড়ের ঢেউ এসে লাগতো আমাদের বাড়ি-সংলগ্ন রাস্তায়। চেনা অচেনা মানুষের রেখে যাওয়া সাইকেলে ভরে যেত আমাদের উঠোন । বিকেল থেকেই নিকট, দূর থেকে আসা চেনা সকলের সঙ্গে দেখা হত। এভাবেই বড়দিনের আনন্দ গীর্জা থেকে এক সময় ছড়িয়ে পড়ত বাড়িময়।
সবে ক্লাস ইলেভেনে উঠেছি, বন্ধুরা আসবে। সকলে মিলে বড়দিনের আনন্দে মেতে উঠব। বড়দিনের আনন্দের সঙ্গে যোগ হল বড় হয়ে ওঠার উদ্দীপনা। বন্ধুরা মিলে উৎসবে গা ভাসানোর আবেশে মন টলমল হয়ে উঠত। তারপর বয়সে আরও খানিকটা বেড়ে উঠলে ডাক্তারি পড়তে চলে এলাম কলকাতায়। কিন্তু বড়দিনের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার আনন্দে মরচে পড়েনি মোটেই। বন্ধুরাও চলে আসত অনেকে। এরপর এল আমার জীবনসাথী। ছুটির দিন বিকেলে কোথায় যাই, সে-ও ওই গীর্জা। আমরা দু’জনে বসে গল্প করতাম আর ভাইঝিরা সব দৌড়োদৌড়ি করে খেলত গীর্জার মাঠে। এরপর একটা সময় এল যখন ভাগ্নী-ভাইঝি-মেয়ে সবাইকে নিয়ে গীর্জায় বেড়াতে যাওয়া, রবিবারের প্রার্থনা সভায় সবাই যখন বাইবেল পড়েন আমরা চুপ করে বসে থাকি। নতুন কেউ আমাদের বাড়িতে এলে তাকে গীর্জা দেখাতে নিয়ে যাওয়া আতিথেয়তার মধ্যেই পড়ত। এভাবেই আমার জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে গেল বনগাঁর ছয়ঘরিয়ার গীর্জা।
এখন অনেক বড় হয়েছে সেই গীর্জা, সেন্ট যোশেফ চার্চ, সামনে বড় বড় মূর্তি বসেছে, নিয়নের আলোয় চারিদিক আলোকময়। বড়দিনের মেলায় হারিয়ে যাওয়ার ঘোষণা হয় লাউড স্পিকারে, আমাদের বাড়ির মোড়ে পুলিশ আর ভলেন্টিয়াররা বড়দিনের ভিড় সামলাতে হিমসিম খায়। অনেক দোকানপাট, বেচাকেনার হরেক সামগ্রী।
পার্কস্ট্রিটের আলোকসজ্জায়, অগণিত মানুষের ভিড়ে দু-একবার গিয়েছি। সেলফি তোলায় ব্যস্ত মানুষ। অবোধ শিশু জানতে চেয়েছিল,’এখানে কোথায় যীশু জন্মেছিলেন?’ সে প্রশ্ন ভেসে গেছে মানুষের কোলাহলে, আড়ম্বরে।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বনগাঁর গীর্জায় বিচুলির মধ্যে সাজানো ছোট্ট ঘরে শিশু যীশুকে দেখবার। ওই শৈশবেই বেথলেহেমকে (যীশুর জন্মস্থান, বর্তমানে প্যালেস্তাইনের অন্তর্গত) মনে মনে এনে ফেলেছিলাম প্রায় চারশ বছরের পুরনো গ্রাম ছয়ঘরিয়ার সেই সাজানো ছোট্ট গোয়ালঘরে। মা মেরীকে খুব চেনা লেগেছিল, মনে মনে ভেবেছিলাম এভাবেই কোন এক শীতের রাতে কোলে নিয়ে আমাকে গরমের ওম দিয়েছিল আমার মা, আর বাবা দাঁড়িয়ে ছিলেন অদূরে ।
এখনও ঘুমঘোরে ২৫শে ডিসেম্বর দিনটিতে আমাকে আশ্রয় দেয় বনগাঁর গীর্জা। ২৪ শে’র মাঝরাতে, ২৫ এর শুরুতে খোল করতালের যুগলবন্দি এখনো মনের কানে শুনতে পাই। ভেসে আসে ভগবান যীশুর নামগান। এখনো বনগাঁর বাড়ির উঠোন ভরে যায় সাইকেল আর বাইকে। ঘুমঘোরে দেখি কখন সিংহাসন থেকে নাড়ু গোপাল হামাগুড়ি দিয়ে নেমে এসে গোয়াল ঘরে মা মেরীর কোলে শুয়ে পড়ে চুপটি করে হাসছে, আবার দৌড়ে সিংহাসনে উঠে তাকিয়ে আছে মিটিমিটি। কী অবলীলায় কৃষ্ণ আর খ্রীষ্ট একাকার হয়ে যায়। ঘুম ভাঙলে দেখি অমল আলোয় চারিদিক আলোকময়। এ আমার অনুভব, ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারি না। এক অলৌকিক আলোকবর্তিকা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।