দক্ষিণ সিকিমের একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র রবাংলা বা রাবাংলা একটি ছোট্ট শান্ত সুন্দর পাহাড়ি শহর। অবস্থান গ্যাংটক ও পেলিংয়ের মাঝখানে। হট্টগোলের মধ্যে থেকে সরে এসে দিন দুয়েকের নির্ভেজাল অবকাশ যাপনের জন্য অবশ্যই ৮০০০ ফুট উচ্চতার রাবাংলাকে বেছে নেওয়াই যায়। রাবাংলার বিভিন্ন এলাকা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা,মাউন্ট পান্ডিম,মাউন্ট সিনিয়ালচু এবং মাউন্ট কাবরু চোখে পড়বে।
রাবাংলায় অবশ্যই দেখবেন বুদ্ধ পার্ক। এখানে রয়েছে বুদ্ধের ১৩০ ফুট উঁচু একটি মূর্তি। ২০১৩ সালে গৌতম বুদ্ধের ২৫৫০ তম জন্মদিনে দলাই লামা মূর্তিটির আবরণ উন্মোচন করেন। পার্কের মধ্যেই রয়েছে প্রার্থনা গৃহ ও মিউজিয়াম। স্মারক হিসেবে কেনা যায় জপমালা, বৌদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণের সিডি,থাংকা প্রভৃতি। সুন্দর করে সাজানো পার্কের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগবে। এই পার্কের একাংশ থেকে রাবাংলার প্রধান বাজারে ঢুকে পড়া যায়।
রাবাংলা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে সিকিমের অন্যতম বৃহৎ মনাস্ট্রি। নাম পালচেন চোলিং মনাস্ট্রি (নতুন মনাস্ট্রি)। তিব্বতীয় স্থাপত্য শৈলীর এই মনাস্ট্রি তৈরি হয় ১৯৯৫ সালে। বৌদ্ধ চিত্রকলা ও থাঙ্কার মূল্যবান সব নিদর্শন রয়েছে এখানে। অগাস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে মনাস্ট্রিতে পাং লহবসোল উৎসব আয়োজিত হয়। উৎসব চলে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। এই উৎসবে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বত পূজিত হয়। প্রতিবছর নভেম্বর মাসে এখানে মহাকাল নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।
নতুন মনাস্ট্রি থেকে পাহাড়ি উৎরাই পথে দেড় কিলোমিটার নেমে গিয়ে দেখা যায় পুরনো রালং গুম্ফা। ১৭৬৮ সালে তৈরি এই গুম্ফা ও তার চারপাশের পরিবেশ আপনাকে শান্তি দেবে।
রাবাংলার কেন্দ্রীয় এলাকা থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে (লেগশিপের দিক যেতে) রয়েছে য়ুনগড্রুং কুন্দ্রাকলিং মনাস্ট্রি। এটি একটি বন মনাস্ট্রি এবং সিকিমের একমাত্র বন মনাস্ট্রি। বন ধর্মাবলম্বীরা প্রকৃতি পূজায় বিশ্বাস করে। তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারের আগে থেকেই এই ধর্ম পালিত হত। পরবর্তীকালে বন ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে পড়েছে। এই মনাস্ট্রির ভিন্ন প্রকৃতির স্থাপত্যশৈলী লক্ষ্যণীয়। এখানকার প্রার্থনাচক্র ঘড়িরকাঁটার উল্টোদিকে ঘোরে।
রালংয়ে রঙ্গিত নদীর তীরে রয়েছে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ (হট স্প্রিং )। আঞ্চলিক ভাষায় রালং চা-চু। এই প্রস্রবনের জল বিভিন্ন অসুখের উপশম ঘটাতে পারে বলে আঞ্চলিক মানুষজনের বিশ্বাস। রাবাংলায় থেকেই বেড়িয়ে আসা যায় টেমি টি গার্ডেন, বোরং থেকে।
মেনাম পাহাড়ে ট্রেকিং
রাবাংলা থেকে ট্রেক করে পৌঁছানো যায় মেনাম পর্বতের শীর্ষে এবং সেখান থেকে ভালেদুঙ্গা ভিউ পয়েন্টে। ট্রেক পথের দৈর্ঘ্য ১২ কিলোমিটার। ৭৫৪৫ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত রাবাংলা থেকে উঠে আসতে হবে ১০৬১৩ ফুট উচ্ছতার মেনাম শীর্ষে। সহজ ট্রেকিং। পথ বিপজ্জনক নয়। বেশ খানিকটা অংশ চড়াই পথ ধরে উঠতে হয়। চার থেকে সাড়ে চার ঘন্টায় শীর্ষে উঠে আসা যায়। নেমে আসতে ঘন্টা তিনেক সময় লাগবে। মেনাম শীর্ষে টেন্টে রাত্রিবাস করা যায়। সেক্ষেত্রে সঙ্গে টেন্ট নিয়ে যেতে হবে।
শীতে ট্রেকপথের বিভিন্ন অংশে ও মেনাম শীর্ষে বরফ পড়ে। যাঁরা ট্রেকিং শুরু করতে চান বা ট্রেক করতে শুরু করেছেন তাঁদের প্র্যাক্টিসের জন্য তো বটেই, ট্রেকিংয়ে আগ্রহী সকলের জন্যই এটি একটি সুন্দর ট্রেকপথ।
মেনাম পর্বত মেনাম বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্যের অন্তর্ভুক্ত। মেনাম-টেনডং গিরিশিরায় প্রায় ৩৬ঃ৩৪ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে এই অভয়ারণ্যের বিস্তার।
ট্রেকপথ গেছে অভয়ারণ্যের মধ্যে দিয়ে। অরণ্যের মধ্যে রয়েছে প্রচুর ভেষজ উদ্ভিদ। রেড পান্ডা ও হিমালয়ান মোনালের আবাস এই অভয়ারণ্য। এছাড়াও জঙ্গলে রয়েছে গোরাল, কাকর হরিণ, ভাল্লুক ,বনবেড়াল প্রভৃতির মতো জন্তু। ব্ল্যাক ঈগল,সানবার্ড,ম্যাগপাই, ব্লাড ফেজেন্ট প্রভৃতির মতো নানা পাখিও চোখে পড়তে পারে ট্রেক-পথে।পর্বতশীর্ষে রয়েছে একটি বৌদ্ধ গুম্ফা।
মেনাম পর্বত-শীর্ষ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা-সহ পূর্ব হিমালয়ের বিভিন্ন শৃঙ্গ, ভুটান পাহাড়ের জাদুকরী দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে যেতে হয়।
মেনাম শীর্ষ থেকে কিছুটা এগিয়ে গেলে ভালেদুঙ্গা ভিউ পয়েন্ট। সূর্যোদয়ের অবিশ্বাস্য রূপ দেখতে হলে ভোরবেলা এখানে উপস্থিত থাকতে হয়। সেক্ষত্রে রাত কাটাতে হবে ক্যাম্পে,মেনাম শীর্ষে।
ট্রেকিং শুরু হবে মেনাম চেকপোস্ট থেকে। এখন থেকে পারমিট সংগ্রহ করতে হবে। ট্রেকিংয়ের সময় সঙ্গে গাইড রাখা শ্রেয়। চেকপোস্টেই গাইড পাওয়া যাবে। গাইডই টেন্ট ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। রাবাংলায় যে হোটেলে থাকবেন, সেখান থেকেও গাইডের ব্যবস্থা হতে পারে। রাবাংলা বাসস্ট্যান্ড থেকে গাড়িতে মেনাম চেকপোস্ট পৌঁছতে মিনিট দশেক সময় লাগে।
যাওয়ার পথ
এন জে পি স্টেশন থেকে রাবাংলার দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটার, শিলিগুড়ি থেকে ১২৬ কিলোমিটার। গাড়ি ভাড়া করে সরাসরি রাবাংলায় পৌঁছনো যাবে। শিলিগুড়ির এস এন পি বাসস্ট্যান্ড থেকে শেয়ার গাড়িতে নামচি পর্যন্ত এসে সেখান থেকে পুরো গাড়ি ভাড়া করে রাবাংলায় পৌঁছনো যায়। নামচি থেকে রাবাংলায় যাওয়ার শেয়ার গাড়িও পাওয়া যায়।
থাকার ব্যবস্থা
বুদ্ধ পার্ক রেসিডেন্সি : ৭০৪৪৬৬২৭৭৭।
রেনড্রপ গেস্টহাউস : ৯৮৩০১৩৯১৩৫, ৯৮৩৬৩১৩৫৩৫।
হোটেল জুমথাং : ৮১৪৫৮৯৬২১৯।
ক্লাউডস এন্ড রিট্রিট অ্যান্ড কাফে: ৯৮৩০০৫১৫০৯।
রাবাংলা ইকো ভিলেজ : ৯৯৩৩০৯৮১৮৫।
হোটেল ভিউ পয়েন্ট : ৯৮৩১০৪১৩০৪।
সেলেপ হোমস্টে : ৭০২৯৯৯৯৯৯১।
সেভেন মিররলেক হোমস্টে : ৮৯৪৩৮৩৩৭১৫।
টেমি থেকে টেনডং ট্রেক
সিকিমের ডামথাং ও টেমি বাজারের মধ্যে ৪৪০ একর এলাকা জুড়ে সবুজ মখমলের মতো চায়ের বাগান। সিকিমের একমাত্র চা-বাগান। টেমি টি গার্ডেন। ৩৯০০ থেকে ৫৯০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের ঢালে টেমি টি গার্ডেনের বিস্তৃতি। কাঞ্চনজঙ্ঘার দীর্ঘ রেঞ্জ দেখা যায় এখান থেকে। দেখা যায় তিস্তার গভীর গর্জ। আর বুক ভরে নেওয়া যায় অক্সিজেন। বসন্তে এদিক সেদিক ছেয়ে থাকে রডোডেনড্রন ও ম্যাগনোলিয়া ফুলে। রাবাংলা থেকে টেমি টি গার্ডেন ১৮ কিলোমিটার।
টেমি টি গার্ডেন থেকে টেনডং ট্রেক
টেমি টি গার্ডেন থেকে টেনডং পর্বত শীর্ষে ট্রেক করা যায়। প্রকৃত ট্রেকিং শুরু হয় ডামথাং বাজার অঞ্চল থেকে। দক্ষিণ সিকিমের ছোট একটা গ্রাম ডামথাং। টেমি টেমি টি গার্ডেন থেকে ৮ কিলোমিটার। চা বাগানের ধার দিয়ে পথ। চাইলে এ পথটা গাড়িতেও যাওয়া যায়। হেঁটে গেলেও ভালো লাগবে। সেক্ষেত্রে ট্রেকিংয়ের মোট পথ একটু দীর্ঘ হবে। হেঁটে গেলে ডামথাংয়েই দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে নেওয়া যায়। প্যাকড লাঞ্চও সঙ্গে নিতে পারেন।
ডামথাংয়ের উচ্চতা ৭,২০০ ফুট। আর টেনডং শীর্ষের উচ্চতা ৮,৫০০ ফুট। ঘন সবুজ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে টেনডংয়ে ওঠার পথরেখা। প্রথমে পাথর বসানো কিছু সিঁড়ি বেয়ে খানিকটা উঠতে হবে। তারপর শুরু হবে ঘন জঙ্গলের নিরালা পথ। রেড পান্ডা, হিমালয়ান ভাল্লুক, লেপার্ড আছে এ জঙ্গলে। আর আছে নানা প্রজাতির পাখি। শুধু পাখির ডাক আর কখনও কখনও বাতাসে গাছের আন্দোলনের শব্দ। এ ছাড়া নিঃশব্দ জঙ্গলের অন্দরমহল।
কিছুটা পর থেকে পথ চড়াই হয়। তখন একটু থেমে থেমে উঠতে হবে। ক্রমশ উঠে আসবেন টেনডং পাহাড়ের শীর্ষে। একটি ছোট গুম্পা রয়েছে টেনডং শীর্ষে। টেনডংয়ে রয়েছে দিকছেন সালহুন গুম্পা। টেনডং শীর্ষ এবং এই গুম্পা বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। টেনডং শীর্ষ থেকে দেখা দেবে পূর্ব হিমালয়ের সুদীর্ঘ রেঞ্জ। বৌদ্ধ লামারা এখানে মনঃসংযোগ করতে আসেন। আপনিও খানিক্ষণ শান্ত হয়ে বসতে পারেন। শরীর বিশ্রাম পাবে। মন শান্ত হবে।
টেমিতে যাওয়ার পথ :
এন জে পি বা শিলিগুড়ি থেকে সাড়ে ৩-৪ ঘন্টায় টেমি টি গার্ডেন পৌঁছানো যায়। এন জে পি ও শিলিগুড়ি থেকে দূরত্ব যথাক্রমে ১১৩ ও ১১০ কিলোমিটার। গাড়ি ভাড়া করে সরাসরি আসা যেতে পারে। এন জে পি বা শিলিগুড়ি থেকে শেয়ার গাড়িতে নামচি পর্যন্ত এসে সেখান থেকে প্রাইভেট গাড়িতে টেমি টি গার্ডেনে পৌঁছানো যায়। এন জে পি ও শিলিগুড়ি থেকে বাসও আসছে নামচিতে।
থাকার ব্যবস্থা :
চেরী রিসর্ট, টেমি টি গার্ডেন। দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ৩০০০ টাকা এবং এক শয্যার ঘরের ভাড়া ২৭০০ টাকা থেকে শুরু। ফোন নম্বর : ৮০১৬৪৮৮৭৩৭, ৯৮০০০১৩৬৬৬।
টেমি টি বাংলো :
চা বাগানের মধ্যে রয়েছে একটি বাংলো, থাকার ব্যবস্থা রয়েছে এখানেও। বুক করতে হয় সিকিম পর্যটন উন্নয়ন নিগমের মাধ্যমে। ফোন নম্বর : ৩৫৯২২০১৩৭২। তথ্য পাওয়া যাবে এই ঠিকানা থেকেও : সিকিম হাউস , এল এ ব্লক, প্লট নম্বর-৪, সেক্টর -৩, সল্টলেক-৭০০০৯৮ (সাই গেটের বিপরীতে)। বুকিং হতে পারে এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও : www.sikkimstdc.com