নাসিক সাপুতারা ভান্ডারদারা হয়ে মাথেরনের পথে
২০১৯ সাল। দিনটা ২৬ জুলাই। আমরা ১৩ জনের একটি দল মুম্বই মেলে (১২৩২১) নাসিকের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। এই ভ্রমণটি নাসিক দিয়ে শুরু করার একটা বিশেষ কারণ হল, কয়েকবার গুজরাত ভ্রমণ হলেও ওখানকার সর্বোত্তম শৈল শহর সাপুতারা সবসময়ই নাগালের বাইরে থেকে গেছে। নাসিক থেকে সাপুতারার দুরত্ব মাত্র ৮২ কিলোমিটার, ফলে এবার আর ওই অপূর্ব সুন্দর হিল স্টেশনটিকে হাতছাড়া করতে চাইনি।
পরের দিন সকালে নাসিক পৌঁছে আশেপাশের দর্শনীয় স্থানগুলো কিছুটা দেখে নিলাম। তার পরের দিন, অর্থাৎ ২৮ তারিখ প্রাতরাশ সেরে সাপুতারার উদ্দেশে রওনা হওয়া গেল। ওই ৮২ কিলোমিটার রাস্তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমরা সবাই দারুন উপভোগ করতে পেরেছিলাম আবহাওয়ার সৌজন্যে। সেদিনের আকাশ, ভারাক্রান্ত মেঘের মধ্যে থেকে মাঝে মাঝেই বৃষ্টিপাতের কারণে কাছের বা দুরের পাহাড়, অরণ্যের রূপমাধুর্য পূর্ণমাত্রায় আত্মপ্রকাশ করেছিল। সাপুতারার মোহময় রূপের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরোটাই তার বিশাল লেককে ঘিরে। জায়গাটা যদি আরাবল্লী পর্বতের ওপর মাউণ্ট আবুর নক্কী লেককে কিছুটা মনে করায়, তাহলে বাকিটা কোদাইয়ের লেককে মনে করাবে।
পরে আমরা নাসিকের কালারাম, কপলেশ্বর, জৈন মন্দির, পঞ্চকুটির আর গোদাবরী নদীর পারে, যেখানে কুম্ভমেলা আয়োজিত হয়, সে সব জায়গাগুলো বেড়িয়ে ত্রম্বোকেশ্বরের সরকারি টুরিস্ট গেস্টহাউসে এসে উঠলাম। এখানে দুদিন থাকার সুবাদে সবাই জ্যোতির্লিঙ্গম দর্শন করার সুযোগ পেলেন। এখান থেকে আমরা রন্ধ্যা জলপ্রপাত দেখতে গিয়েছিলাম।
প্রায় দুঘন্টার ওপর সময় লাগল। কিন্তু যেমন তার পরিবেশ, তেমনই অসাধারণ জলপ্রপাত। এই অপরূপ জলপ্রপাতটিকে বিভিন্ন দিক থেকে দেখার সুবিধার জন্য রেলিং দিয়ে পথবেষ্টনী করা আছে।
প্রসঙ্গক্রমে একটা কথার উল্লেখ অবশ্যই করা প্রয়োজন, সেটা হল, ত্রম্বোকেশ্বরের এই সরকারি টুরিস্ট রেস্ট হাউসে থাকার উপযোগী সুবিধাগুলো থাকলেও কমপ্লেক্সটি কেমন যেন অবিন্যস্ত, ঘরগুলো রিসেপশন থেকে অনেকটা দূরে দূরে। কোন ইন্টারকম সিস্টেম না থাকায় প্রতিনিয়ত আমাদের গিয়ে যোগাযোগ করতে হতো। দ্বিতীয়ত, এদের খাওয়ার ব্যবস্হা, অন্তত তখনকার সময়ে, নিম্নমানের মনে হয়েছিল। তৃতীয়ত, আশেপাশে দোকানপাট না থাকার অসুবিধাটাও আমাদের ভোগ করতে হয়েছিল।
পরের দিনের গন্তব্য ভান্ডারদারা। যাওয়ার পথের প্রকৃতির রূপমাধুরী, সত্যি কথা বলতে কী আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল। আমরা যে পথ ধরে চলেছি তার ডান দিকের ৫০০/৭০০ মিটার ব্যবধানে সারি দেওয়া পাহাড়গুলো থেকে নেমে এসেছে রাশি রাশি ঝর্ণার ধারা। শুধু নর্থ সিকিম কেন, ভারতবর্ষের আন্য কোথাও নেই একসঙ্গে এত ঝর্ণা। অবশেষে ভান্ডারদারায় আর্থার লেকের কাছে পৌঁছলাম। সকলের ইচ্ছেতে ঠিক হল, আগে আমরা এই আর্থার লেক পরিক্রমা করে তারপর খাওয়াদাওয়া করব। ভ্রমণার্থীরা যখন পরিস্থিতি আর পরিবেশের সাথে একাত্ব হয়ে ওঠেন, তখনই বেড়ানোর আসল রূপ-রস উপভোগ করা যায়। যে কোনও জায়গাতেই হোক না কেন, বেড়ানোর ক্ষেত্রে এই মানসিকতার খুব প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। অন্যথায় প্রচুর পয়সা খরচ করে বেড়ানো হয়তো হয়, কিন্তু বেড়ানোর নির্যাসটা অধরাই থেকে যায়।
এই আর্থার লেকের সৃষ্টি উইলসন ড্যাম আর প্রভারা নদী থেকে। লেক ঘিরে রয়েছে ছোট-বড় অনেকগুলো ট্রেকিং রুট, ২০০ বছরের পুরনো রত্নাগড় ফোর্ট, নেকলেস জলপ্রপাত। আরও অনেক ঝর্ণার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় আশেপাশে। ভান্ডারদারা, মালসেজ, মাথেরন, লোনাভালা, খান্ডালা, সেশাদ্রি, এই সবই বেড়ানোর আদর্শ সময় জুলাই-আগস্ট মাসে। অর্থাৎ বর্ষার মরসুমে। ভান্ডারদারা এবং আর্থার লেক ঘিরে এই পাহাড়শ্রেণীর নাম কালসুবাই পর্বতমালা।
আমরা ভান্ডারদারার শ্রেষ্ঠ প্রপার্টি, একদম আর্থার লেকের সামনে অবস্থিত সরকারি টুরিস্ট কটেজে ছিলাম। আমি বেড়ানোর অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কিছু অসাধারণ জায়গাতে পয়সার অর্থাৎ খরচের কমবেশি তারতম্য নিয়ে খুব মাথাব্যথা না করাই ভালো। এটাই কিন্তু সেই জায়গাটা ভালোলাগা আর না লাগার গুপ্ত চাবিকাঠি। আর্থার লেকের পারের আমাদের এই আস্তানাটি ছিল চমৎকার।
এই সার্কিটে যে বৃষ্টিস্নাত হওয়ার জন্যই আমরা এসেছি সেটা কলকাতাতেই আমাদের জানা ছিল। তাই সাপুতারা, ভান্ডারদারায় আমরা বৃষ্টিকেও পুরোদস্তুর আমাদের বেড়ানোর সঙ্গী ও উপভোগের উপকরণ করে নিয়েছি।
আজ ৩০ জুলাই। সকাল সকাল উঠে ব্রেকফাস্টের পর্ব শেষ করে রওনা দিলাম মাথেরনের পথে। মালসেজ ঘাটের মধ্যে দিয়ে এই পথ। বর্ষাস্নাত পাহাড়, অরণ্যের যে সব দৃশ্যের সাক্ষী হলাম তা আজীবন ভোলবার নয়। চোখ ফেরানোর সুযোগ নেই, পুরো পথটাই এমন। এইভাবে আড়াই ঘন্টার ওপর সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। আমরা মাথেরনের পাদদেশে যেখান থেকে ছোট ট্রেনের দুলকি চলন শুরু হয়, সেই নেরালে এসে পৌঁছলাম। আমরা আমাদের টেম্পো ট্র্যাভেলারেই মাথেরনের পাহাড়ি পথে উঠতে শুরু করলাম। মিনিট ৪৫ বাদে মহারাষ্ট্র টুরিজমের আস্তানাতে পৌঁছালাম। এখানেও রিসেপশন থেকে থাকার জায়গা মিনিট ৭/৮-এর মতো দুরত্বে। স্ট্যান্ডার্ড রুমের সাইজ অত্যন্ত ছোট, বাধ্য হয়ে আমাদের বাড়তি পয়সা খরচ করে ঘর পাল্টাতে হল। গাড়ি পার্কিংয়ের সমস্যার জন্য আমাদের গাড়িটিকে প্রপার্টি চত্বরে রাখতে দেওয়া হয়নি, অতএব চালককে নেরালে গিয়ে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। মাথেরনে আমরা দুদিন থাকব। যে পর্যন্ত আমাদের গাড়ি আসতে পেরেছিল, সেই জায়গাটার নাম দস্তুরি নাকা। এখান থেকে মাথেরনের দুরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার।
ফটোঃ লেখক
ক্রমশ
লেখকের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরঃ 9433456266, 9007966182
1 Comment
[…] দুই পর্ব পড়ার লিঙ্ক প্রথম পর্বঃ https://torsa.in/maharashtra-in-monsoon-first-part/ দ্বিতীয় পর্বঃ […]