ইটাচুনা রাজবাড়ি:
বর্ধমানগামী কোনও ট্রেনে উঠে পড়ুন। নামবেন খন্যান স্টেশনে। হাওড়া থেকে ঘন্টা দেড়েক সময় লাগবে। স্টেশন থেকে টোটোতে ১০ মিনিট। পৌঁছে যাবেন প্রচুর গাছগাছালি আর জলাশয়ে ঘেরা ইটাচুনা গ্রামে। এ গ্রামেই পেল্লায় ইটাচুনা রাজবাড়ি। প্রসস্ত উঠোনের চারদির জুড়ে বিভিন্ন মহল। বিরাটাকার বৈঠকখানা, সিলিং থেকে ঝুলছে প্রকাণ্ড ঝাড়বাতি। হাতে টানা প্রাচীন পাখা, বনেদি আসবাবপত্র, টানা টানা সব দরদালান, চওড়া চওড়া সিঁডি, ঠাকুর দালান, প্রতি সন্ধ্যায় মন্দিরে আরতি, সব মিলিয়ে অতীত আর বর্তমানের দারুণ মেলবন্ধন ঘটেছে ইটাচুনা রাজবাড়িতে। রাজকীয় পরিবেশে বিশ্রাম, খাওয়াদাওয়া, সঙ্গে গ্রাম দর্শন, কাছেপিঠে বেড়ানো, সব মিলিয়ে ইটাচুনা রাজবাড়িতে আপনার সপ্তাহ শেষের অবকাশ কাটতে পারে রাজকীয় মেজাজে।

একটা চমকপ্রদ ইতিহাস জড়িয়ে আছে ইটাচুনা রাজবাড়ির পরিবারের সঙ্গে। ১৮০৭-এ ঔরঙজেবের মৃত্যুর পরে অরাজগতা মাথা চাঢ়া দিচ্ছে দিকে দিকে। মুঘল সাম্রাজ্য হীনবল। এর মধ্যে ১৭৪২ সালে বাংলায় বর্গী আক্রমণ ঘটল। ভাস্কর পণ্ডিত ও রঘুজি ভোশলের নেতৃত্বে মারাঠা যোদ্ধারা বাংলা আক্রমণ করে, চৌথ বা কর আদায়ের জন্য। ১৭৫২ পর্যন্ত সে আক্রমণ অব্যাহত ছিল। বর্গী আক্রমণ থামলে কিছু মারাঠা যোদ্ধা স্থায়ী ভাবে থেকে গেল বাংলায়। প্রচুর ধন-সম্পদ ছিল তাদের। ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করল তারা। কুন্দনরা ছিল এরকমই এক মারাঠা যোদ্ধা পরিবার। বর্ধমানের ইটাচুনায় বসবাস শুরু করল তারা। ১৭৬৬ সাল নাগাদ কুন্দনরা ইটাচুনায় তৈরি করল এক বিরাট প্রাসাদ। গড়ে উঠল কুন্দনদের জমিদারি। ক্রমশ কুন্দনরা হয়ে উঠল কুণ্ডু। স্বাধীনতার পর জমিদারি ব্যবস্থার অবলুপ্তির আগে পর্যন্ত ২০০ বছর যাবৎ সুনামের সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করেছে কুন্দন তথা কুণ্ডুরা।

আঞ্চলিক মানুষজনের কাছে ইটাচুনা রাজবাড়ির আরেক নাম ‘বর্গীডাঙ্গা’। সেই বর্গীডাঙ্গার কুণ্ডুরা কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতি বা বাঙালিয়ানার অঙ্গীভূত হয়ে পড়েন। কয়েক বছর আগে পেল্লায় রাজবাড়ির একাংশকে হেরিটেজ হোমস্টেতে রুপান্তরিত করেন রাজবাড়ির সদস্যরা। চাইলে রাজকীয় মেজাজে দুটো দিন কাটাতে পারেন ইটাচুনা রাজবাড়ির আতিথেয়তায়। যৌথ পারিবারিক আবহ বিশেষ মূল্য পায় ইটাচুনা রাজবাড়িতে। অতিথিদের থাকার ঘরগুলির নাম এরকমঃ বড় বৌদি, ছোট বৌদি, ঠাকুমা, বড় পিসি, গিন্নি মা, বড় মা, মেজ মা, জ্যাঠামশাই, পিসেমশাই ইত্যাদি। আত্মীয়তাবোধক নামগুলির মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায় অতিথিদের প্রতি আন্তরিকতা।
ইটাচুনা রাজবাড়িতে থাকাকালীন আপনি কি কি করতে পারেন? ইনডোর-আউটডোর খেলাধূলার ব্যবস্থা আছে। সঙ্গে গাইড নিয়ে রাজবাড়ি ঘুরে দেখতে পারেন, ঘুরে দেখতে পারেন ইটাচুনা গ্রামটি, মাছ ধরতে পারেন, সন্ধ্যায় ঠাকুরদালানে আরতি দেখতে পারেন, মন চাইলে বাগান পরিচর্যা করতে পারেন, ঘুড়ি ওড়াতে পারেন। বারবিকিউ, বনফায়ার (শীতের মরশুমে) আয়োজিত হতে পারে।

আশেপাশে
রাজবাড়ি থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ২০০ বছরের পুরনো মহানাদ কালিবাড়ি। বলা হয়, রাণী রাসমণি এই মন্দিরে পুজো দিতে এসেছিলেন এবং মন্দিরটি দেখে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির তৈরির ব্যাপারে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। মহানাদ কালিবাড়ি থেকে ২ কিলোমিটার দূরে জটেশ্বর শিব মন্দির। কাছাকাছির মধ্যে দেখে নেওয়া যায় দেবীপুরের টেরাকোটা শৈলীর লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির ও পাণ্ডুয়ার ত্রয়োদশ শতকের ১২৫ ফুট উচ্চতার মিনার। ইটাচুনা রাজবাড়ি থেকে হংসেশ্বরী মন্দির ২০ কিলোমিটার। দেখে নেওয়া যায় দেবানন্দপুরে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মভিটে। কালনার ১০৮ শিবমন্দির রাজবাড়ি থেকে ১ ঘন্টা ১৫ মিনিটের পথ। দেখে আসা যায় গুপ্তিপাড়ার টেরাকোটার মন্দির। বেড়িয়ে আসা যায় চঁচুড়া ও চন্দনগর থেকেও।

মহানাদ কালীবাড়ি

জটেশ্বর শিবমন্দির
থাকার ব্যবস্থা
থাকার জন্য রয়েছে নানা ব্যবস্থা। দ্বিশয্যার ঘরের ভাড়া ২৪৯৯ টাকা থেকে ৪৮০০ টাকা। ৬ জনের থাকা উপযোগী সুইটের ভাড়া ৮৯০০ টাকা। এ ছাড়া আছে মাড হাট, ভাড়া ১৯০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকা। সব ভাড়ার সঙ্গেই জিএসটি যুক্ত হবে। খাদাওয়ার খরচ আলাদা।
যাওয়ার পথ
ট্রেনে গেলে মেন লাইন হয়ে বর্ধমানগামী কোনও ট্রেনে উঠেতে নামতে হবে খন্যান স্টেশনে। হাওড়া থেকে মেমারি বা পাণ্ডুয়া লোকালেও ওঠা যায়। ব্যান্ডেলের পর চতুর্থ স্টেশনে খন্যান। খন্যানের আগের স্টেশন তলাণ্ডু। খন্যান স্টেশনে নেমে অটো, টোটোয় ১০ মিনিটের পথ ইটাচুনা রাজবাড়ি।
নিজেদের গাড়ি নিয়ে সড়কপথে যেতে চাইলে দ্বিতীয় হুগলি সেতু বা দক্ষিণেশ্বর হয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরতে হবে। প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পর বাঁ-দিকে আজাদ হিন্দ ধাবা ও হিন্দুস্থান হোটেল পেরিয়ে বাঁয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে আসবেন বসীপুর। এখান থেকে সোজা রাস্তায় ১৯ কিলোমিটার চলার পরে পৌঁছাবেন হালুসাই। হালুসাই যেতে বাঁয়ে ঘুরে একটু এগলেই খন্যান রেলস্টেশন। এখান থেকে মিনিট দশেকে ইটাচুনা রাজবাড়ি।
হেরিটেজ হোমস্টে, ইটাচুনা রাজবাড়ি, যোগাযোগের নম্বরঃ ৯৬৭৪৫-৩৭৯৪০, ৯৭৪৮৭-০০৮২০।
বালাখানা রাজবাড়ি:
দুটো দিন রাজারহালে কাটাবেন নাকি? তাহলে মহেশগঞ্জ এস্টেটের বালাখানা প্রাসাদের কথা ভাবতে পারেন।
কৃষ্ণনগর স্টেশন চত্বর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যপটের মধ্যে প্রথম দর্শনেই বালাখানা ম্যানশন আপনাকে মোহিত করবে। ১৭৮০ সালে প্রাসাদটি তৈরি করিয়েছিলেন এক ইতালীয় ডাক্তার। পরে বাড়িটি কিনে নেন হেনরি ন্যাসবিট স্যাভি। নীলের ব্যবসা ছিল তাঁর। ১৮৭৫-এ ফের হাতবদল হয় বাড়িটির। কিনে নেন আঞ্চলিক জমিদার পালচৌধুরীরা।

অনেক ইতিহাসের সাক্ষী বালাখানা ম্যানশন। পেল্লায় প্রাসাদের পাঁচটি বড় বড় উঁচু সিলিংয়ের ঘর গেস্টরুম হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়। অ্যান্টিক আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো ঘরগুলোতে পরিপূর্ণ স্বাচ্ছন্দ্যের আধুনিক সব উপকরণ রয়েছে। লিভিং রুম, ডাইনিং রুম, বিলিয়ার্ড রুম, আর বড় বড় থামওয়ালা ২০০০ বর্গফুটের বারান্দায় আপনার পদচারণা এক অন্য অনুভূতির জন্ম দেবে। ওই বিলিয়ার্ড টেবিলটির বয়স নয় নয় করে আড়াইশো বছর। বিশাল বারান্দার আরামকেদারায় একটি বই আর এক পেয়ালা যথার্থ দার্জিলিং চা নিয়ে বসুন,ছুটি সার্থক হবে।
১৬ একর জায়গা জুড়ে এস্টেট। প্রাসাদ ছাড়াও রয়েছে বিরাট ফল,ফুল,সবজির বাগান,কৃষিজমি। খেতে,বাগানে বেড়াতে পারেন। এস্টেটের মধ্যে যত্রতত্র ছড়িয়ে রয়েছে বেঞ্চ। সেখানে বসে বিশ্রাম নিতে পারেন।

এস্টেটের পেছনদিকে দিয়ে বয়ে চলেছে জলঙ্গী নদী। সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ সিনেমার একটি দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল এখানে, জলঙ্গীর পাড়ে। এস্টেটের পেছনদিকে একটি পরিত্যক্ত এয়ারস্ট্রিপ চোখে পড়বে। এখান থেকে মহেশগঞ্জ এস্টেটের জমিদার রণজিৎ পালচৌধুরী তাঁর টাইগার মথ এয়ারক্র্যাফট নিয়ে আকাশে উড়তেন।
বালাখানার রসুইঘরের সুখ্যাতিও যথেষ্ট। ইংলিশ ব্রেকফাস্ট, কন্টিনেন্টাল ও ইন্ডিয়ান ডিনার আর ষোলোআনা বাঙালি ঘরানার মধ্যাহ্নভোজে জিভ,মন দুই-ই মজে।
মহেশগঞ্জ এস্টেট থেকে মায়াপুর ৪ কিলোমিটার , বল্লাল ঢিপি ৪ কিলোমিটার, জগন্নাথ মন্দির ৪ কিলোমিটার, হাতে বোনা টাঙ্গাইল শাড়ির জন্য বিখ্যাত শান্তিপুর, ফুলিয়া ৩০ কিলোমিটার।
কলকাতা থেকে বালাখানার দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটার। নিজেদের গাড়িতে সাড়ে ৩ ঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া যায়। ট্রেনে গেলে নামতে হবে কৃষ্ণনগর স্টেশনে। এখন থেকে বালাখানা ১২ কিলোমিটার। জানিয়ে রাখলে এস্টেট থেকে অতিথিদের জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

থাকার খরচ:
এবছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত দু’জনের জন্য দিনপ্রতি ৫০০০ টাকা। এরমধ্যে সকালের চা, প্রাতরাশ ও বৈকালিক চায়ের খরচ ধরা আছে।
১০ বছরের কম বয়সের সর্বাধিক ২টি বাচ্চার বছর জন্য আলাদা খরচ লাগে না। ১০ বছরের বেশি বয়সের ১ জন সদস্যের জন্য ১৫০০ টাকা অতিরিক্ত। এসি ব্যবহার করলে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। সঙ্গে ড্রাইভার থাকলে তাঁর খাওয়া-দাওয়ার জন্য দিনপ্রতি ব্যয় হবে ৮০০ টাকা।
ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে ঘরভাড়া বাড়ে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ঘরভাড়া কমে।
১লা এপ্রিল থেকে ৩০শে জুন পর্যন্ত বালাখানা বন্ধ থাকে।
প্রতিটি আমিষ মিলের খরচ ৫০০ টাকা। প্রতিটি নিরামিষ মিলের খরচ ৪০০ টাকা। প্রাতরাশের খরচ ঘরভাড়ার সঙ্গে ধরা থাকবে । যোগাযোগের নম্বরঃ ৯৮৩১৩২৮৪৮৬, ৯৮৩১২৭০৮০৭।





